জন্ম যার পাঁকে
জন্ম যার পাঁকে
পতিতাপল্লীর ঘরে ঘরে আলো ঝলমল করছে। উৎসব শুরু হয়েছে সেখানে,চলবে রাতভোর। গান-বাজনায় মুখর পল্লী,ছুটোছুটি,হাঁকডাকে সরগরম। সাজগোজ শুরু হয়েছে রোদ পড়ার আগেই,চকমকে ঘাগরা চোলি আর নকল সোনা,হীরের গয়নায় নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা চলছে পল্লীর মেয়েদের,মানে দেহোপজীবিনীদের। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব মেয়েরা এখানে এসেছে,বরং বলা ভাল,ধরে আনা হয়েছে। নানা ছল,চাতুরী করে ধরে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দেহব্যবসায়। স্বেচ্ছায় কেউ এখানে আসেনি,কত চোখের জলে গড়ে উঠেছে এই পতিতাপল্লী। প্রথম প্রথম কান্নাকাটি,খাওয়াদাওয়া বন্ধ করলেও পরে সবাই মেনে নিয়েছে তাদের ভাগ্যকে। এখন তারা সেই সব পুরনো কথা আর মনে রাখে না,আর তাই সাজগোজের প্রতিযোগিতায় উঠেপড়ে লাগে খদ্দের ধরার চেষ্টায়। কত ছোট ছোট মেয়েরা নিজেদের শরীরকে পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই দালালের খপ্পরে পড়ে হাজির হয় এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। অশিক্ষিত,অভাবী ঘরের মেয়েদের কাউকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে, কাউকে সিনেমায় নামানোর প্রলোভন দেখিয়ে,কাউকে বা চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসে দালালেরা এখানে,আর তাই পুলিশি ঝামেলাও লেগে থাকে পল্লীতে। এ কাজে গ্রামের কিছু মহিলাও যুক্ত থাকে যাদের সহজে বিশ্বাস করে মায়েরা মেয়েদের ছেড়ে দেয় তাদের সঙ্গে,সেই সুযোগে তারা ভুলিয়ে ভালিয়ে সরল মেয়েগুলোকে তুলে দেয় কখনও দালালের হাতে,কখনও এই নিষিদ্ধপল্লীতে মোটা টাকার বিনিময়ে। পল্লীর সর্দারনীকে এই নিয়ে প্রায়ই পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হয়,জেরার সম্মুখীন হতে হয়। নারী এখানে ভোগ্যপণ্য,আদিমকাল থেকেই নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে,এখনও চলছে তা। একদিকে নারী স্বাধীনতার স্লোগান চলছে আজকাল অন্যদিকে উচ্চমূল্যের বিনিময়ে নারী ভোগ্যপণ্যে পরিণত হচ্ছে। পুরুষেরা ভোগ করে,আবার ঘৃণাও করে এইসব নারীদের। নারীরা এখানে শুধুই নারী,তারা মানুষ নয়,দেহটাই বিবেচ্য তাদের ।
পল্লীর চারিদিক আলো ঝলমলে হলে কি হবে,এই আলোর মাঝেও রয়েছে কত কালো। গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে হলেও সোমার পড়াশোনা করার বড় শখ ছিল। ছোট থেকেই মনোযোগী ছাত্রী সোমা,টিউশন নেবার ক্ষমতা ছিল না বলে এর ওর কাছ থেকে বুঝে নিত পড়া। বরাবরই ভাল রেজাল্ট করত বলে স্কুলের দিদিমণিরাও ওকে অনেক সাহায্য করতেন। অভাবের ঘরে পড়াশোনা করাটাও যে বিলাসিতা,তা বোঝার মত বয়স তখনও হয়নি ওর। সবে ১৬,সামনে মাধ্যমিক,খুব শীগগির একটা পাস হয়ে যাবে তাহলে। কিন্তু দালালের চোখ পড়ল উঠতি সোমার দিকে,বেশ ডাগরডোগর হয়েছে তখন ও। বাবাকে টাকার লোভ দেখায়,বলে,"আজ বাদে কাল বিয়ে তো দিতেই হবে,মেয়ের বিয়ের খরচই কি কম নাকি,তার চেয়ে মেয়েকে আমার হাতে তুলে দাও,মেয়েও ভাল থাকবে,তুমিও টাকা পাবে,তাছাড়া মেয়েও মাসে মাসে টাকা পাঠাবে,তোমরা ভাল থাকবে"।সোমাকে তুলে দিল বাবা দালালের হাতে। স্বপ্নগুলো ডানা মেলার আগেই তাদের ডানাগুলো ভেঙে গেল। কত কেঁদেছিল সোমা তখন স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায়। তার স্বপ্নদের এমন পরিণতি হবে ভাবেনি সে কখনও। বারবার বলেছিল,"বাবা,আমায় পড়তে দাও,আমি পাশ করে চাকরী করে তোমাদের খাওয়াবো,আমায় ক'টাবছর সময় দাও"। বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদেছিল সোমা,সে কান্নার আওয়াজ তার বাবার কানে পৌঁছায়নি সেদিন। নির্বিকার চিত্তে তুলে দিয়েছিল নিজের আত্মজকে দালালের হাতে,ছিন্নভিন্ন হতে। পরে মেনে নিয়েছিল সোমা,না,ঠিক মেনে নেয়নি,নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাবা হাঁপানি রোগী,কাজ করতে পারে না,মা মুড়ি ভেজে,ধান সেদ্ধ করে যা পায়। গ্রামে কাজের লোকই বা ক'জন রাখে যে মা করবে? আরও তিনটে ছোট ছোট ভাইবোন,ওর পরে দুটো ভাই,সবার ছোট বোন,হয়তো বোনটারও পরে এই পরিণতি হবে,ভেবে শিউরে ওঠে সে। সোমা বাড়িতে তার রক্ত ঝরিয়ে রোজগার করা টাকা পাঠায় যাতে সবাই ভালো থাকে,ওর তো যা হবার হয়েইছে। টাকাটা ঠিকই পৌঁছে যায় কেবল ও কেমন আছে কেউ জানতে চায় না তা। ছোটছোট ভাইবোনদের জন্য মনটা খুব খারাপ হয় ওর,যদিও বাবা-মায়ের ওপর দুরন্ত অভিমান।
ভালোই আছে সোমা,বেশ আছে,খাচ্ছে-দাচ্ছে,সাজগোজ করছে, দেহ বেচে টাকা রোজগার করছে,খারাপ কি! এ তো হল অভিমানের কথা, সত্যি কি ভাল আছে সোমা? তবু তাকে অভিনয় করতে হয়,হাসতে হয় খদ্দেরের সঙ্গে,সেজন্যই তো তাকে আনা হয়েছে এখানে। দু'বছর পার হতে না হতেই শরীরে নতুন প্রাণের উপস্থিতি টের পেয়ে সোমা হকচকিয়ে যায়,এখানে সন্তান নিয়ে কি করবে সে,কিভাবে মানুষ করবে তাকে,এই পরিবেশে কেমন তৈরী হবে তার সন্তান,সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল তার। তবুও সময় মত সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। সুন্দর,ফুটফুটে একটি ছেলে,যদিও নাম,গোত্র,পরিচয়হীন। পাঁকে জন্মেও এত সুন্দর তাই সোমা নাম রেখেছিল পঙ্কজ। ছেলেটা ছোট থেকেই অন্যরকম,মাকে বড় ভালোবাসে সে,ছাড়তে চায় না অথচ ব্যবসা বন্ধ করে ছেলে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না,তাই সন্ধ্যে থেকে সর্দারনি মাসি বিলকিস বেগম সামলায় তাকে। অন্য ছেলেপুলেগুলো খেলা করে,টিভি দেখে,মারপিট করে সন্ধ্যা কাটায় আর সোমার ছেলেটা ছাড়া পেলেই বন্ধ ঘরের দরজাগুলোতে ধাক্কা দেয়,'মা মা' করে মাকে খুঁজে বেড়ায়,সে সময় তাকে আটকে রাখতে প্রাণ বেরিয়ে যায় এলাকার পুরুষ মানুষদের। ভীষণ কাঁদে পঙ্কজ মাকে না পেয়ে। মা-ই তার সব,বাবা বলে যে কেউ থাকে তা তখনও তার জানা হয় নি কারণ 'বাবা' ডাকটা ওই পল্লীতে কারও মুখে সে শোনেনি কখনও। মাসি তাই দালালদের সঙ্গে পরামর্শ করে সন্ধ্যেবেলায় পঙ্কজকে পল্লী থেকে সরাবার মতলব করে। ব্যবসার সময় ছেলের কান্নাকাটি কাজের ক্ষতি করবে। এমনিতে সোমার কদর বেশি খদ্দেরদের কাছে,কোনোসময় সে ফাঁকা থাকে না। সোমার কাছ থেকে মাসির রোজগারও হয় বেশ মোটাটাকা,কাজেই তার ছেলের জন্য একটা ভাল ব্যবস্থা হওয়া দরকার। তিন বছরের পঙ্কজের তাই পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়। নিষিদ্ধ পল্লীতে পড়াতে আসতেও কেউ চায় না বদনামের ভয়ে। তাই দালাল রঘুকে দিয়ে পল্লীর বাইরে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার সত্যর কাছে তাকে পড়তে পাঠানো হয় রোজ সন্ধ্যেয়। ছোট্ট পঙ্কজের খুব ভালোলাগে,পল্লীর ঐ পরিবেশের বাইরেও যে একটা জগৎ আছে তা সে দেখল আর সত্যমাষ্টার ফুটফুটে পঙ্কজকে আদর করে পড়াতে শুরু করে। পঙ্কজের পড়াশোনায় বেশ আগ্রহ দেখা গেল,পড়ার মধ্যে থাকলে সে আর মাকে খোঁজে না। অল্পদিনের মধ্যেই সে অনেক শিখে ফেলল। সত্যর ওকে পড়াতে খুব ভালো লাগে,ভাবে পঙ্কজ নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষিত লোকের ছেলে। একবছরের মধ্যে ওকে স্কুলে দেওয়ার উপয
ুক্ত করে তোলে সত্য। জানার আগ্রহ ওর খুব বেশি,পড়তে এসে খুব খুশি হয়,মায়ের কাছে যাবার জন্য আর বায়না করে না সে। পড়া হলে রঘু এসে নিয়ে যায়। পল্লীতে ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে,মাসি ঘুমের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ওর। সকালে উঠে নিজেই বই খুলে বসে পড়ে,এমনকি ওর সমবয়সী যেসব ছেলেমেয়েরা আছে পল্লীতে তাদের ডেকে নিয়ে যা শিখেছে তাই শেখাতে চেষ্টা করে। বেশিরভাগেরই কোনো আগ্রহ নেই পড়াশোনায় তবু পঙ্কজ ওদের ডাকে,কেউ না এলে নিজে নিজেই পড়ে। সত্য ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে,যদিও কাজটা খুব সহজ ছিল না কারণ বাবার নাম,পরিচয় জানা নেই। সত্য ভালবেসে নিজের সন্তানের পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি করে ওকে,এরজন্য সত্যকেও অনেক বিরূপ মন্তব্য হজম করতে হয়। তবু সত্যর মনটা ভরে যায় যখন সবাইকে অবাক করে প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয় পঙ্কজ। সত্যর মনে হয় এ ছেলেকে পিতৃপরিচয় দেওয়া তার সার্থক। এভাবে ও শিক্ষকদের সবার নজর কাড়ে,সবার প্রিয় হয়ে ওঠে। সবাই জানে ও পতিতাপল্লীর ছেলে,স্টাফরুমে ওকে নিয়ে আলোচনা হয়,সবাই বলে পঙ্কজ নাম ওর সার্থক।
পতিতাপল্লীতে যেসব নাম,গোত্র,পরিচয়হীন সন্তানেরা জন্মায় তারা বেশিরভাগ ছোট থেকেই এক একটি দুষ্কৃতী তৈরি হয়,নতুবা পল্লীর দালাল। এসব পল্লীতে মদ,গাঁজা,হেরোইন থেকে শুরু করে সকল প্রকার মাদক ব্যবসা চলে রমরম করে। কতরকমের লোকজন যাতায়াত করে এখানে,তাদের বেশিরভাগই ড্রাইভার,শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ,কিছু তথাকথিত সভ্য,শিক্ষিত মানুষের যাতায়াতও আছে এখানে। চলে খারাপ কথার ফোয়ারা। এসবের মাঝে বড় হলে যা হবার এখানকার ছেলেরা তাই হয়,ব্যতিক্রম পঙ্কজ,ছোট থেকে কোনোদিন সে একটা খারাপ কথা উচ্চারণ করে নি। তার একমাত্র লক্ষ্য তখন পড়াশোনা শেখার। পঙ্কজ যত বড় হয় ক্রমাগত চেষ্টা করে এলাকার ছেলেদের পড়াশোনা শেখাতে, পেরেছে ও কিছু ছেলেকে পড়াশোনায় আগ্রহ তৈরি করাতে। রোজ স্কুল থেকে ফিরে ও তাদের নিয়ে বসে পড়াশোনা করায়,নিজে যেটুকু শিখেছে সেটুকুই শেখায় তাদের। বড় হবার সাথে সাথে ও বুঝতে শেখে ওর মায়ের পেশা,খুব কষ্ট হয় ওর মায়ের জন্য,কষ্ট হয় ওর অন্য মহিলাদের জন্যও। তাদের ছোট ছোট ছেলেরা যারা শুধু খেলা করে বেড়ায়,তাদের ধরে নিয়ে আসে ও,ভাল ভাল গল্প বলে,যেসব গল্প ওর নীতিশিক্ষা বইতে আছে। ছেলেরা ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়,পঙ্কজের লক্ষ্য হল এইসব ছেলেদের লেখাপড়া শেখানো,যাতে তারা ভাল পথে থাকতে পারে,ভবিষ্যতে যেন একেকজন দুষ্কৃতী না তৈরি হয়। ছেলেরা ক্রমে ওর ভক্ত হয়ে ওঠে। এদের পড়িয়ে,শিখিয়ে পঙ্কজের ভারী ভাল লাগে। ওদের ছেড়ে দিয়ে সে নিজে পল্লীর বাইরে টিউশন পড়তে যায়,ফিরে এসে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে মগ্ন হয়ে। পতিতাপল্লীর হইচই,নাচগানের আওয়াজ কিছুই তার কানে পৌঁছায় না। মনে মনে ভাবে আরও বড় হয়ে মাকে যন্ত্রণা থেকে,অপমান থেকে মুক্ত করবে সে। শুধু নিজের মা নয়,পল্লীতে আরো যে মহিলারা আছে সবার সুস্থ জীবন হোক,এই তার ইচ্ছা,সঙ্গে তাদের সন্তানদেরও সুস্থ জীবনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে সে।
পঙ্কজের ইচ্ছা বড় হয়ে সে শিক্ষক হবে,স্কুল গড়বে,এইসব ছেলেদের শিক্ষা দেবে। শুধু মনে ভাবা নয়,ছেলেদের অনেককেই সে পরিবর্তন করে ফেলে ঐ বয়সেই,তারাও পড়াশোনা করতে চায়। সর্দারনি একটা ঘর দিয়েছে ওকে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য। সেখানে দরজা বন্ধ করে ও পড়ায় একঘর ছেলেমেয়েকে। পড়িয়ে ভীষণ তৃপ্তি পায় ও। স্কুল পেরিয়ে কলেজ,অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে পঙ্কজ,এরপর ইউনিভার্সিটি। প্রতিবারই সে টপার,জীবনে দ্বিতীয় হয় নি সে। ঘরভর্তি তার পুরস্কার। ইচ্ছা করলে যেকোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা টাকা মাইনের চাকরি করতে পারে সে কিন্তু তার আদর্শ মানুষ গড়ার। শিক্ষকতাকে পেশা করতে চায় না সে,শিক্ষকতা তার ব্রত। সে তাই বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে একটা স্কুল তৈরি করতে সমর্থ হয় যেখানে পল্লীর সব ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে,এখানে কেউ অচ্ছুত নয়। সত্যমাষ্টারমশাইকে সে হেডমাষ্টার করে তার পিতৃঋণ শোধ করবার চেষ্টা করে। এদের অন্ধকার থেকে আলোয় আনাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সবাই ভালো ছাত্র না হতে পারে ভালো মানুষ হোক। এদের নিরক্ষরতা দূর করতে সে ছিল সদা সচেষ্ট। তার চেষ্টায় এরা ক্রমে মুখের নোংরা ভাষা,যা তারা জ্ঞান পৌঁছে শুনছে,সেসব ভুলতে লাগল। কুপমন্ডুক হয়ে না থেকে ওই পতিতাপল্লীর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বাইরে যে একটা সুন্দর জগত আছে তা তারা জানতে পারল,চিনতে শিখল।
পঙ্কজের মনটা আনন্দে ভরে ওঠে যখন দেখে যেসব ছেলেরা সর্বদা খারাপ কথা বলত,নিজেদের মধ্যে অকারণ মারপিট করত,তাদেরও কত পরিবর্তন হয়েছে শিক্ষার আলোয়। কথায় আছে বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু। সত্যিই তাই,ভাবে পঙ্কজ। আগে ওই পল্লীর ছেলে বলে এলাকার বাইরে গেলে সবাই তাদের দিকে আঙুল তুলত,ঘৃণা করত,ওদের দেখে থুতু ফেলত,যদিও ছেলেদের কোনো দোষ ছিল না,দোষটা ছিল তাদের জন্মের। কিন্তু লেখাপড়া শিখে ভদ্র,সভ্য হবার পর এখন তাদের দেখে লোকে আর তেমন আচরণ করে না কিছুটা যেন সম্ভ্রমের চোখে দেখে। ছেলেরা লেখাপড়া শিখে কয়েকজন শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছে,কেউ বা ব্যাঙ্কে,সরকারি অফিসে চাকরিও পেয়েছে,একজন আবার ডাক্তারও হয়েছে। সে নিজের আলাদা চেম্বার করলেও পতিতাপল্লীর সকলের চিকিৎসা করে বিনামূল্যে। এদের বেশিরভাগই বড় হয়ে পল্লীতে জন্ম যেসব মেয়েদের,তাদেরকে বিয়ে করেছে,পঙ্কজও তাই করেছে। এরা সকলে মিলে ব্রত নিয়েছে তাদের মায়েদের লেখাপড়া শেখাবে,তাই বয়স্ক মহিলাদের পঙ্কজের স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। এছাড়া নানারকম হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে তাদের,যাতে দেহবেচার ঘৃণ্য পথ ছেড়ে তারা এইসব কাজ করে নিজেদের খরচ নিজেরা চালাতে পারে। তাদের হাতের কাজ বাজারে বিক্রির ব্যবস্থাও ওরা করে। সম্মানের সঙ্গে বাঁচুক মায়েরা,এটাই চায় তারা। পঙ্কজের এই মহান ব্রতের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর পুরস্কার পায় সে। সেখানে আজ আর পতিতাপল্লী নেই,সবাই সুস্থজীবন যাপন করে,প্রত্যেকেই সেখানে স্বনির্ভর। সোমার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে,অল্পবয়সে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল,কত কষ্ট ছিল তার মনে,আর যে স্বপ্ন সে কোনোদিন দেখে নি,তার ছেলে তাকে তেমন এক স্বপ্নের জীবন দান করেছে। সে আজ এক গরবীনি মা,ঘরে ঘরে যেন তার পঙ্কজের মত ছেলে জন্মায়।