জীবনযাপন(ত্রয়োদশ পর্ব)
জীবনযাপন(ত্রয়োদশ পর্ব)
" এই এই বড় খোকা ওকে ধর পাল্লাচ্ছে।" আরতির মামার চিৎকারে সবাই সচকিত হয়ে উঠে, দেখে বিল্টু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে দরজার কাছে পর্যন্ত চলে গিয়েছে। দুই ভাই মিলে বিল্টুকে ধরে এনে বসালো আগের স্থানে।
আরতির মামা নিজের সংযম হারিয়ে বললেন "হারামজাদা কোথায় পালাচ্ছিলি তুই? আজ সব হিসেব হবে। "
বিল্টু বিবর্ণমুখে বসে রইলো।
" আজ বাবা তোমাকে সব বলবো, সেবার আমার ছোট খোকার বিয়ের সময় মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে আসলো ওর মা। ভালো লাগবে মেয়েটার। মেয়েটা কত শান্ত তুমি জানো, ওকে নিয়ে সংসার করছো। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বিয়ের দিন সবাই বললো ও বিধবা বিয়েতে যাওয়া ঠিক না। ওর মামী প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু লাভ হলোনা, আরতি মা নিজেই গেলো না বরযাত্রীতে। বাড়ির প্রায় সকল আত্মীয়ই গেল। বাড়ির শেষ বিয়ে বলে কথা। আরতির মা ও মেজো মাসি মানে আমার বড়দি, মেজদি যেতে চায়নি, কিন্তু আরতি জোর করে পাঠালো তাদের। বাড়িতে সেদিন থাকার মধ্যে ছিলো আমার বৃদ্ধ মা-বাবা আর স্ত্রী, মানে তোমার মামী। বাকিরা প্রায় সবাই আমাদের সাথে গিয়েছিল, নয়তো পাশেই আমাদের সব জ্ঞাতি তাদের বাড়িতে ছিলো। আমার ছোট বৌমার বাপের বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, দুই গ্রাম পরেই। তাই কাউকে বারণ করতে পারিনি। সেদিন.. " বলতে গিয়েও আর বলতে পারলেন না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন " তুমি বলো বাকিটা, আমি পারবো না। তাছাড়া তুমি ছিলে সেদিন।"
আরতির মামী কথাটা শুনে বার দুয়েক কেঁপে উঠলেন, মনে হলো সুজিতের। তিনি চোখ বুজে মিনিট খানেক বসে রইলেন।
সুজিত বললো "মামী আপনি বলেন, আমি জানতে চাই। আর আমি সব কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত। "
কথাটা শুনে আরতির মামী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলতে শুরু করলেন।
" সেদিন ছেলেকে বিয়ে করতে যাওয়ার জন্য বিদায় করে দিয়ে গেলাম আমার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে। গিয়ে দেখি আরতি ওদের পায়ে তেল মালিশ করছে আমার শ্বাশুড়ির। উনি বেঁতো রুগী ছিলেন। সময়টা হালকা শীত, মানে ছোট দিনের বেলা হতে সবে শুরু করেছে, তাই রাত নয়টায় বেশ রাত মনে হচ্ছিল। আমি খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম উনাদের জন্য। উনারা অবশ্য আরও আগে খেয়ে নেন, আমি সেদিন কাজের চাপে একদমই সময় পায়নি।আমাকে দেখে আরতি বললো সে খাইয়ে দেবে দাদু দিদাকে, আর আমি যাতে কিছু খেয়ে নিয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিই। কাল সকাল থেকে আবার নিয়ম কানুন সারতে হবে আমাকে। আমি রাজি না হওয়াতে, জোর করে পাঠালো। আমি বাধ্য হয়ে চলে আসলাম ওই ঘর ছেড়ে। ওর খাবার ওর ঘরে পাঠিয়ে, আমি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ঘুম খুব ভালো হয়না বাবা। হঠাৎ একটা দাপাদাপি শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল, ঠিক কয়টা বাজে তখন ঠাওর করতে পারি নি। আমি উঠে বসলাম, দেখলাম শব্দটা থেমে গিয়েছে। আমি নিজের মনের ভুল ভেবে শুয়ে পড়লাম। এবারে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম, ঠিক বুঝতে পারলাম না কোথা থেকে শব্দটা আসছে।আমার কি মনে হওয়াতে বাইরে আসলাম, আমার দুই ঘর পরের ঘরে বাড়ির সব মেয়েদের জন্য থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে তো কারো থাকবার কথা না। আরতি রয়েছে ওর দাদু দিদার কাছে। তবুও কি ভেবে এগিয়ে গেলাম ওই ঘরের দিকে, বিয়ে বাড়ির ব্যাপার। আত্মীয়দের জিনিসপত্র রয়েছে ঘরে। বাড়িতে এই কয়জন লোক থাকলেও,বাইরের ঘরে বাজনাদার আর রাঁধুনিরা রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি এসে কিছু চুরি করে, বলা তো যায়না। এই ভেবে ঘরে উঠে এসে অবাক হয়ে গেলাম,দোর ভেতর থেকে বন্ধ। বেশ অবাক হলাম, আরতি একা শুয়েছে এই কথা ভেবে। আমি দোরের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু একটা শব্দ পেয়ে ফিরে এসে দোরে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলাম, 'এই আরতি কি হয়েছে তোর, মা দরজা খোল।' ভেতরে একটা দাপাদাপির শব্দ পেলাম, আমি বাধ্য হয়ে দোরে কান পাতলাম, কেমন একটা গোঁঙ্গানির শব্দ আসছে।আমি চিৎকার করে উঠলাম। তারপর কিছু বুঝতে না পেরে বাইরের ঘরের দিকে ছুটে গেলাম, বাড়ির অন্দরের দরজা খুলে দিলাম, ওরা আমাদের চিৎকারে ছুটে এলো। আমি কি বললাম জানিনা, দেখি একজন প্রাচীল টপকে পালানোর চেষ্টা করছে, ওরা ওকে ধরে ফেললো। সে কে আমি তখনও জানিনা, আমি ছুটে গেলাম ঘরে। গিয়ে দেখি আরতি মুখে কাপড় গোঁজা, আরতির জ্ঞান নেই, আর ওর সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে.... " বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি।
আরতির মামা স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন।
কিছুটা সময় নিয়ে চোখ নাক মুছে আবার বলতে শুরু করলেন, এদিকে সুজিত বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
" আমি আর একটু দেরী করলে ওকে বাঁচানো যেতো না। আমি চোখে মুখে জল দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক করে বাইরে এসে দেখি ওই ওই পশুটা আমার মেয়েটাকে ওমন করে খুবলে খেয়েছে। আমি বললাম ভালো করে ওকে বেঁধে রাখতে,যাতে না পালাতে পারে। ঘরে এসে দেখিয়ে আরতি আবার জ্ঞান হারিয়েছে। আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। আরতির জ্বর এলো,আমি ওকে কম্বল চাপিয়ে সারারাত জল পটি দিলাম। এদিকে রাত থাকতেই আরতির মামা,মেসোরা ফিরে এলো। মেয়ে আর অল্প বয়সীরা রয়ে গেল। তাদের দেখে আমার ধরে প্রাণ এলো, আমি সবটা বললাম।আরতিকে নিয়ে ছোটা হলো হাসপাতালে। আরতির মামা আর বাবা বাড়িতে মিটিয়ে নিতে চাইলেও,আরতির বড় মেসো বিষয়টা মানতে পারলেন না। তিনি থানা পুলিশ করলেন সবার অমতে গিয়ে, পাশে পেলেন স্ত্রী আর তিন ছেলেকে। আরতির বাবা চেয়েছিলেন এই কশাইটার সাথে বিয়ে দিয়ে সব মিটমাট করতে। কিন্তু এই বিষয়টি আরতির মা মানতে পারলেন না। এই প্রথম স্বামীর কোনো কাজের বিরোধিতা করলেন।কারণ বিল্টু অনেক মেয়ের সাথেই এমন করেছে । "
সুজিত চুপ করে ছিলো এতোক্ষণ এবারে ঝাপিয়ে পড়লো বিল্টুর উপর, এলো পাথারি মারতে শুরু করলো। " তুই মানুষ না, তোকে মেরেই ফেলবো, শালা তুই আরতির এতো বড় ক্ষতি করেছিস, এখনো সাধ মেটেনি? বল কোথায় রেখেছিস। বল.."
" আমি জানিনা সত্যি জানিনা, আরতিকে আমি তো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ও মানেনি,তাই.. "
" তাই মানে, তুই এমন করবি..." বলে জোরে একটা লাথি কষায় সুজিত।
আরতির মামাতো ভাইরা ছুটে গিয়ে আঁটকায় সুজিতকে, যা রেগে আছে মেরেই ফেলবে।
" তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি ওটা নরক দেখিয়ে ছাড়বো। "
" আপনি শান্ত হোন জামাইবাবু। "
সুজিত এবারে আরতির মামীর দিয়ে তাকিয়ে বলে "আরতি আমাকে কেন বললো না এসব, তাহলে তো ভুল বোঝাবুঝি তৈরী হতোনা।"
" না বাবা আরতির কোনো দোষ নেই, আরতির মেসো আইনি লড়াই লড়ে এই নরপশুকে জেলে পাঠায় ঠিকই, কিন্তু আরতির নামে একটা কলঙ্ক ছড়িয়ে যায়। যতই দোষ করুক পুরুষেরা, দোষ কেবলমাত্র মেয়েদেরই হয়। তাই সবকিছু মিটে যেতে আরতিকে ওর দূরসম্পর্কের দিদির বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, ততদূর পর্যন্ত খবরটা পৌঁছায়নি। ওদের বাড়িতে কিছু একটা অনুষ্ঠান ছিল সেসময়। তার আগে আরতির মা দিব্যি দিয়ে দিয়েছিলেন এই ঘটনা আরতি কোনো দিনও না কাউকে বলে। তারপর তোমাদের বাড়ির তরফ থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসে। আমরা মন্দিরে বিয়ে দিই, বেশীজনকে বলিনি যাতে পাঁচকান না হয়। সেদিন আরতি ওর মাকে অনুরোধ করেছিলো যাতে তিনি দিব্যি তুলে নেন আর আরতি তার জীবনের এই নির্মম ঘটনাটি বলতে পারে। মিথ্যা দিয়ে জীবন শুরু করতে চায়নি সে। কিন্তু মেজদি রাজি হয়নি কিছুতেই, উলটে এটা বলে আরতি যদি এখন বলে তার মরা মুখ দেখবে। আর তার মৃত্যুর পরেও যদি কোনো দিনও বলে, তিনি কখনো আরতিকে ক্ষমা করবেন না। আরতি এই কারণে বিয়ে করতেও রাজি হয়নি, ওর বড় মাসি রাজি করায় বহু কষ্টে।"
সুজিতের মাটিটা দুলে উঠল, কি ভুল করে ফেলেছে সে। আরতিকে ও ভুল বুঝেছে। আরতি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো তা প্রতিটি পদক্ষেপে বুঝতে পেরেছে। আরতির স্পর্শতেই সংসারী হয়ে উঠেছে।
সুজিত চিৎকার করে বলে উঠলো "আরতি...." তারপর মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলল। একজন পুরুষ যখন কাঁদে,তখন বুঝতে হবে কতটা আঘাত পেয়ে সে এমন করে কাঁদছে।
সুজিতকে কাঁদতে দেখে সবার চোখ আর্দ্র হয়ে গেল। সুজিত হঠাৎ উঠে মাতালের মতো টলমল পায়ে হেঁটে বিল্টুর সামনে ধপ করে বসে বললো " আমার আরতি কই? বিল্টু বলোনা, আমার আরতি কই? তুমি আর কি ক্ষতি করেছ বলো? "
বিল্টু সুজিতের এই মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেল, পুরুষদের এই রূপ হয় ভয়ংকর।
বিল্টু হাত জোর করে বললো "আমি সত্যি জানিনা, আমি তো কেবলমাত্র ভয় দেখাতে গিয়েছিলাম। আমি জেলে পচে মরছিলাম আর ও সুখে সংসার করছে। তাই সহ্য করতে পারি নি। আমি সেদিন আপনার বাড়ি থেকে চলে আসার পরে সত্যি জানিনা আরতি কোথায়, আগেও কোনো দিনও ওদিকে যায়নি। সেদিন প্রথম আর সেদিনই শেষ, বিশ্বাস করেন।"
" বিশ্বাস!!! " বলে হো হো করে হেসে উঠে সুজিত।
" আমি তো আমার স্ত্রীকেই বিশ্বাস করতে পারিনি, তোকে করবো? তোর মতো জেলখাটা আসামিকে! "
সুজিত এবার বিল্টুর গলাটা চিপে ধরে বললো "ভালো কথায় বলবি, নইলে তোকে মেরে জেলে যাব।"
" আমাকে মেরে ফেললেও আমি এটাই বলব, আমি জানিনা। সত্যি জানিনা।"
আরতির ভাইয়েরা এগিয়ে এসে সুজিতকে নিষ্ক্রান্ত করে বল্লো "জামাইবাবু আমারও মনে হচ্ছে এ কিছু জানেনা৷ জানলে ঠিক বলে দিতো। "
সুজিত পথভ্রষ্ট মানুষের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
চলবে...

