জীবনের জয়
জীবনের জয়
কিছু ঘটনা স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় মনের মধ্যে । বছর কেটে গেলেও তা ভালো যায় না । মনের এতো গভীরে ঢুকে থাকে । তার মানে এমন নয় দিনের পর দিন সেটা মনে রেখে ব্যথিত হব। ঘরের মধ্যে ধুলো হয়ে গেলে যেমন ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হয়, জীবন যাত্রায়ও সেরম ভাবেই ঝাট দিয়ে ধুলো সরিয়ে দিতে হয়।
মাধুরীও সেরম নিজের জীবনের ব্যথিত স্মৃতি, সময়, ঝেড়ে এবং ফুছে ফেলে দিয়েছে।
মাধুরীর কথা, চলুন শুনি।
"আমি কি পারলাম মা তাহলে সবাইকে উত্তর দিতে হবে??"
মা -- " হ্যা, আমার রিমি পেরেছে নিজের জীবনে এগিয়ে, সবার মুখে তালা লাগিয়ে দিতে।"
মাধুরী সেন আজ একজন বড়ো গায়িকা ।
মাধুরী সেন ছিল,,, অদিতি সেন , আর অরিজিত্ সেনের একমাত্র মেয়ে ।
মাধুরীকে , অদিতিদেবী রিমি বলে ডাকতেন ।
মাধুরী খুব জমাটি মেয়ে ছিল । ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতেও ভালোবাসতো ।
অদিতিদেবী তাই কখনো মাধুরীর ওপর খুব রেগে যেতেন।
মাধুরী পড়াশোনায় ও ভালো ছিলো । মাধুরী ক্লাসে ফার্স্ট হতো ।
তখন মাধুরী ক্লাস ৭ এ পড়ত । একদিন স্কুল থেকে অটো করে মায়ের সাথে ফেরার পথে, একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগতে...........অটোটা সাইডে উল্টে যায় । মাধুরী আর অদিতিদেবীর মাথায় খুব জোর লাগে । মানুষের সাহায্য সব লোক অটো থেকে বেরোতে পারে । মাধুরীর ডানদিকে কপাল থেকে কান পর্যন্ত নীল হয়ে গেছিল ।
তারাতারি, অদিতিদেবী মাধুরীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কারণ এইভাবে মাথায় লাগলে লোকাল ডাক্তারকে না দিখেয়ে, তক্ষুনি হাসপাতালে চলে যাওয়া উচিত। ডাক্তার দেখে বলেন সেরম কিছু হয়নি আর ওষুধ দিয়ে দেন।
১ সপ্তাহ বাদেও যখন মাধুরীর মাথা ব্যথা কমছিল না অরিজিত্ বাবু, মাধুরীকে নিউরলাজিস্টের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার বলে দেন মাধুরীর migraine হয়েছে ।
সবকিছু শুনে অরিজিত্ বাবু থমকে যান ।
বলে ওঠেন-- " অদিতি, একি কোন পাপের শাস্তি?"
অদিতিদেবী -- " এরম করোনা, আমাদের লড়তে হবে ।"
অরিজিত্ বাবুর ট্রানসফার হয়ে গেছিলেন পরে। তাই সংসারটা অদিতিদেবী কেই সামলাতে হতো।
acute migraine এর জন্য মাধুরীর মাথায় কখনো এতো যন্ত্রণা হতো, যে দাঁত খিচিয়ে উঠত। কখনো.....অত্যধিক বমি হওয়ার জন্য মাধুরী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতো । হাতে স্যালাইন চলত ।

মাধুরী তাই প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারত না । বন্ধুর কাছ থেকে সাহায্য নিত ।
মাধুরীকে আগে টিচাররা যত ভালো স্টুডেন্ট বলতো, এখন আর বলে না । অথচ, এতো কষ্টের মধ্যেও মাধুরী ক্লাসে, পরীক্ষাতে fifth হয় ।
অদিতিদেবী একদিন দেখে মাধুরী জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে কি দেখছে, ওর মনও ভালো নেই। অদিতিদেবী বললেন -- " রিমি, কি হয়েছে তোর? মন খারাপ করে আছিস কেন ?........ বল আমাকে ।"
মাধুরী -- " মা, আমি আর ফার্স্ট হতে পারিনা বলে কি..... আমি আর ভালো স্টুডেন্ট নই?"
অদিতিদেবী -- " কে বল্ল তোকে এই কথা??? ভেবে দেখ তো, কতো জন ছেলে, মেয়ে তোর পিছনে আছে । তুই কতো জনকে হারিয়ে দিয়েছিস পরীক্ষাতে। দেখ মনা জীবনের চলার পথে কাঁটা থাকবেই । কিন্তু কাঁটা ফুটলেই যদি থেমে যাস তাহলে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। যদি অজস্র কষ্ট সহ্য করে, ওই কাঁটার ওপর দিয়ে চলে যেতে পারিস, তবেই তুই তোর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবি। জীবন মানেই ভাঙা গড়া।
মানুষের কাছ থেকে পথে এগোনোর সময় অজস্র কথা শুনতে হতে পারে । কিন্তু তা মনে রেখে কাঁদলে চলবে না। যদি তুই ভাবিস যে যতই বলুক আমি এগোবই, তবেই এগোতে পারবি ।"
মাধুরী -- " আমি এগোবই মা। তুমিই আমার মনের বল ।"
অদিতিদেবী-- " এই তো । আমি জানি , আমার রিমির মনে অনেক জোর আছে ।"
মাধুরী তখন ক্লাস ১০ এ পড়ে । কম্পিউটার টিচার পম্পা ম্যামের স্বভাব খুবই বাজে ছিল ।
মাধুরীর শরীর খারাপ ছিল বলে কম্পিউটারের প্রজেক্ট দিতে একবার দেরী হয়ে গেছিল। একদিন পম্পা ম্যাম ক্লাসের মধ্যে, সবার সামনে মাধুরীর ওপর চেঁচিয়ে বলেন -- " তোমার প্রজেক্ট আমার ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল । ওটা একটা প্রজেক্ট হয়েছে?"
মাধুরী-- " কিন্তু ম্যাম, আমি তো ভালো করেই করেছি । আমার শরীর খারাপ ছিল বলে দিতে একটু দেরি হয়ে গেছে ।"
পম্পা ম্যাম-- " চুপ করো । তোমার ওই শরীরের কষ্টের ন্যাকামি, অন্য কাউকে গিয়ে শোনাও। আর আমার মুখের ওপর কথা বলছ, এতো বড় আস্পর্ধা তোমার । তোমায় আমি স্কুল থেকে বের করে দেব, আর একটা কথা বললে । বেরিয়ে যাও ক্লাস থেকে।"
পম্পা ম্যাম এর কথাগুলো মাধুরীর মনে খুব যন্ত্রণা দেয়। ওর কষ্ট তো কেউ বোঝেই না, উল্টে অসুস্থ বলে অপমান করে ।

মাধুরীর মন এতো ভেঙে গেছিল, যে ২ দিন ধরে ও স্কুলে যেতে চাইছিল না । অদিতিদেবী অবাক হয়ে গিয়ে তারাতারি জিজ্ঞেস করেন -- " রিমি কি হয়েছে???"
মাধুরী সবকিছু বলতে , পরের দিন অদিতিদেবী সব কথা প্রিন্সিপালকে গিয়ে বলেন ।
পম্পা ম্যামকে একদিন অদিতিদেবী বলেন -- " এমনভাবে আমার মেয়েকে অপমান করেছেন, যে ওর আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না । আপনি কি?? ওর যদি কিছু হতো আপনি দায়িত্ব নিতেন??? "
পম্পা ম্যাম আর কিছু বলতে পারেন নি।
মাধুরী একদিন অদিতিদেবীকে বলেন-- " মা, আমার জীবনে গায়িকা হওয়ার ইচ্ছা, আমি কি পারবো? আমার রোগের জন্য মানুষ তো আমায় অপমান করে।"
অদিতিদেবী -- " এ পৃথিবীই এরম মা, মানুষ মানুষকে অপমান করতেই ভালোবাসে। তুই তো গান, নাচ দুটোই শিখিস । এগো, তুই পারবি ।"
মাধুরী সবসময় মায়ের কথা মনে রাখত ।
উচ্চমাধ্যমিকে মাধুরী ৮৫ % পেয়ে, মাকে বলে-- " মা, আমায় আর কেউ বাজে কথা শোনাতে পারবে না। আমি প্রমাণ করে দিয়েছি, যে আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট ।"
অদিতিদেবী-- " হমম্ , মনা, এটাই শক্তি ।"
স্কুল লাইফ শেষ হওয়ার পর, মাধুরী, ইঙলিস অনার্স পড়ল ।
তারপর মাধুরী ইঙলিসেই এম.এ করে, একটা স্কুলে টিচারির চাকরি পায়। তার সাথে মাধুরী অনেক টিউশনি ও করত। প্রায় প্রতিদিনই ওর বাড়িতে স্টুডেন্ট আসত।
মাধুরীদের বাড়ির পাসে একজন লোকের বাড়ি ছিলো। ওনার নাম ছিল মোহন শর্মা । উনি ক্লাসিকালের ওস্তাদ ছিলেন । সবাই জানত উনি গানে পন্ডিত। মোহন শর্মা একদিন মাধুরীদের বাড়িতে আসলে, অদিতিদেবী ওনাকে বলেন -- " আরে, দাদা আপনি, আশুন। আমি একটু চা করে আনছি ।"
মোহন শর্মা -- " আরে না না, চা করতে হবেনা । আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম শুধু ।"
অদিতিদেবী -- " চা খেয়েই বলুন না।"
অদিতিদেবী চা করে এনে বলেন -- " এই নিন চা, এবার বলুন ।"
মোহনবাবু -- " আমি শুনি , তোমার মেয়ে খুব সুন্দর গানের রেওয়াজ করে । তানপুরা নিয়ে ও খুব সুন্দর ক্লাসিকাল রাগ গায়। ওর ক্লাসিকালের গলা খুবই ভালো । ওর গানও খুবই ভালো লাগে। আমার মনই চাইল ওকে আরো শেখাই । তবে মাধুরী কি চায় সেটা বেশি প্রাধান্য"
মাধুরীর মুখে হাসি ফুটে উঠছিল । ওর জেন মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে ফুল ঝরে পরছে । মাধুরী তক্ষুনি বলেদিল-- " হ্যা আমি শিখব ।"
অদিতিদেবী -- " কি বলছিস? তোর কাছে সময় কোথায়? তুই স্কুল থেকে ফেরার পরই কতো স্টুডেন্ট চলে আসে তোর কাছে পড়তে । কখন গান গাইবি?"
মাধুরী -- " কেন মা? রবিবার দুপুরে তো কেউ আসেনা । ওইদিন ই করব ।"
অদিতিদেবী --" একটা দিন দুপুরে একটু রেস্ট পাস, ওই সময় গান গাওয়া সম্ভব?"
মাধুরী -- " সবই সম্ভব মা ।"
২ বছর ধরে আরো ক্লাসিকাল শিখে, মাধুরীর গানের গলা আরো সুন্দর হয়ে গেছিল । মোহনবাবু মাধুরীকে অনেক ফাংশানে গাওয়াতে নিয়ে জেতেন । মাইকে গেয়ে, মাধুরীর মনে জোর এসে গেছিল, যে হ্যা, ও আরো এগোতে পারবে ।
মাধুরীর তখন ২৮ বছর বয়স । অরিজিত্ বাবু রিটায়ার্ড হয়ে বাড়ি ফিরল । ওনাকে দেখে সবার ভালো লাগছে । আগে শুধু উনি পুজোতেই আসতেন, আর সারা বছর ওনাকে না দেখতে পেয়ে, সবারই খারাপ লাগতো । মোবাইলে ভিডিও কলিং এ কথা বলা, আর বাড়িতে থাকা তো আর এক নয়।
তখন বাঙলা গানের অডিশ্যান চলছিল ।
মোহনবাবু এসে বলেন -- " মাধুরী, মনের মধ্যে তোর জোর থাকলে অডিশ্যানে চল ।"
অরিজিত্ বাবু একটু অবাক হয়ে গিয়ে বল্লেন-- কিন্তু ওখানে তো প্রচন্ড কম্পিটিশন চলে । তার ওপর ভীরের তো শেষ নেই । আর প্রচন্ড পলিটিক্স ও আছে ।"
মোহনবাবু -- " এতো ভাবলে চলবে না তোকে । ইচ্ছে থাকলে রেওয়াজ কর আরো, আর অডিশ্যানে নাম দে।"
মাধুরী অডিশ্যানে নাম দিতে, ওর নাম লিস্টে ওঠে । গানের কম্পিটিশনেও ওকে অনেক রেওয়াজ করতে হতো । ফাংশানে মাধুরীর গান শুনতে মাধুরীর পরিবার ও মোহনবাবু আসতেন। ওনারা সবাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন অদিতিকে এইভাবে এগিয়ে যেতে দেখে। সবাইকে দেখলে মাধুরী মনে জোরও পেত ।
তখন ফাইনাল রাউন্ড। এতো কষ্ট নিয়েও মাধুরী ফাইনালে উঠে গেছে। এই সময় ওকে প্রায় সারাক্ষণই গান প্রকটিস করতে হচ্ছে । মাধুরীর খুব টেনশনও হচ্ছিল।
মাধুরীর migraine এর রোগটা অনেকটাই শেরে গেছিল, কিন্তু তাও অল্প ছিল । হঠাত্ মাধুরীর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল । তখন আর দাঁত খিচিয়ে ওঠার মতন ব্যথা ছিল না । তবুও খুবই যন্ত্রণা দায়ক ছিল ।

অনেকের সাথে ওখানে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল । তারা মাধুরীকে মাথা ব্যথার ওষুধ দেয়।
মাধুরীকে ছোট থেকেই রোজ ওষুধ খেতে হতো migraine এর জন্য।
পরের দিনই গান গাইতে হবে । ওই মাথা যন্ত্রণা নিয়েই মাধুরী গান প্রকটিস করল। সবাই ওর মনের জোর দেখে খুবই ভালোবাসত।
মাধুরীর মাথা ব্যথা ১দিনে শারতো না। মাধুরী অদিতিদেবীকে ফোন করে বলতে উনি পরের দিন মাধুরীর সাথে দেখা করতে চলে আসেন । পরের দিন মাধুরীর নিজেকে খুব weak লাগছিল।
অদিতিদেবীর খুব খারাপ লাগছিল ।
উনি বললেন -- " এখন তো আর বলতে পারিনা কেন এলি, আমি তোকে আগেও বলেছিলাম, জীবনের পথে কাঁটা থাকবেই । সেই কাঁটার ওপর দিয়ে চলে যেতে পারলেই তুই তোর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবি । এতো দূর যখন চলে এসেছিস, তাহলে আরো পারবি এগোতে। "
মাধুরী-- " মা, মন খারাপ কোরোনা । রোগটা তো আমার আছেই । তাবলে জীবনটাকে তো নষ্ট করে দিতে পারিনা। আমি প্রমাণ করে দেব, আমিও সব পারি । নার্ভের রোগ থাকলেও মানুষ যে হেরে যায় না , দেখিয়ে দেবো । নার্ভের রোগ যাদের আছে, তাদের কোন মূল্যই নেই, এই ভাবনাটাই মুছে দেব ।"
কথাটা শুনে অদিতিদেবীর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছিল । বল্লেন -- " যা...এগো জীবনে। তবে হ্যা, ফার্স্ট হতে পারিশনি বলে কাঁদবি না। সেকেন্ডে, থার্ড টা ও অনেক বড়ো ।"
বড়ো স্টেজে মাধুরীকে গান গাইতে হবে, তার ওপর আরো বড়ো জাজ এসেছেন । একজন গায়িকা । খুবই টেনশনে ছিল মাধুরী ও ওর পরিবারও। মাধুরীর শরীর খুব ভালো ছিলো না। মাধুরীর মাথা ব্যথা অল্প ছিল ।
৪ জোন আছে ফাইনালে। মাধুরীকে এবার ডাকা হলো ।
চিন্তায় পড়লেই মানুষ ঈশ্বরকে ডাকে । মাধুরী ও মাধুরীর পরিবার তাই ই করছে ।
মাধুরী এবার এসে খুব সুন্দর গান গাইল ।

কিন্তু ৪ জোনের গান খুবই সুন্দর হয়েছে ।
নতুন জাজ এবার বলতে চলেছেন কে winner।
নতুন জাজ -- " winner is..........................................
মাধুরী সেন ।
মাধুরী, যে গানটা গেয়েছ সেটা বেশ ক্লাসিকাল বেস্ড গান ছিল । তুমি ক্লাসিকালে খুবই ভালো । "

অদিতিদেবী , অরিজিত্ বাবুর চোখ দিয়ে আনন্দের জল বেরোচ্ছিল , যে তাদের মেয়ে আজ নিজেকে এগিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে । মনে জোর থাকলে, কোন কিছুই যে মানুষকে হারিয়ে দিতে পারে না, তা মাধুরী প্রমাণ করেদিল ।।
