জীবন সাথী
জীবন সাথী
বয়সটা বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ক্ষমতা কমে এসেছে বলেই না আজ তোমার ওপর এতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি | আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেলো চাকুরী থেকে অবসর নেবার পর থেকেই তোমাকে অনেক কাছের থেকে জানতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনীয়তাকে | এখন মনের আঙ্গিনা জুড়ে শুধু তুমি | তোমাকে ছাড়া আজ আমার জীবন শূন্য | কিন্তু এই যে বোধ, এই যে তোমাকে নতুন করে মনের মানসে উপলব্ধি করার ক্ষমতা জন্মেছে আমার মধ্যে, সেটা যদি প্রথম জীবন থেকেই আসতো তাহলে আজ আর শেষ বয়সে এসে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে হতো না | তুমি যেদিন আমার জীবনে জীবন সঙ্গী হয়ে এলে, তারপর থেকে বেশ কিছুদিন আমি স্বপ্নের দেশে ভেসে বেরিয়েছিলাম | তোমাতেই বিভোর ছিল আমার সমস্ত মন-প্রাণ | ভাবটা ছিল এমনই যেন পৃথিবীর সব পাওয়া হয়ে গেছে | আমি ছিলাম পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত | কিন্তু সেই মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি | সেই আবেশ হারিয়ে যেতেও বেশি সময় লাগেনি | সংসারের আবর্তনের চাকায় সেই রচনা করা স্বপ্নগুলো দলে পিষে একেবারে শেষ হয়ে গেলো | আমার ভালো লাগার ভান্ডটি হঠাৎ করেই খালি হয়ে গেলো | আমার অনুভূতির বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে গেলো | আমার বিচার শক্তির পরিবর্তন ঘটে গেলো | ঘর আর আমার ভালো লাগে না | বাইরের জগতে অনেক আলো, অনেক আশা, অনেক মোহ, অনেক ভরসা দেখতে পেলো উরু উরু মন | ঘর হয়ে গেলো অন্ধকার | সূর্য্যের বা চন্দ্রের কোনো আলোই আর বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দিতে পারছে না ঘরের ভেতরে | স্বপ্নগুলো, আবেশগুলো এক এক করে ক্রোধ, ঘৃণা, বর্বরতায় পরিণত হতে থাকলো | তোমাকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না | চোখের সামনে তোমাকে দেখলেই আমার সারা শরীর রাগে কাঁপতে থাকতো | সান্নিধ্যে আসা তো দূরে থাক, এতো ঘৃণা জাগতো যে মুখ দেখতেই ইচ্ছে করতো না | তোমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে একা থাকার ইচ্ছে জাগতো |
কিন্তু তুমি বোধহয় আমার এই আচরণের মধ্যে নিজেকে নিঃশর্তে বিলিয়ে দিয়ে চুপটি করে নিজের কাজগুলোকে দাঁতে দাঁত চেপে করে যেতে - কোনো একদিন পরিবর্তন আসবে সেই আশায় | তোমার ধৈর্য্য, তোমার সহনশীলতা এখন আমার মনকে উদ্বুদ্ধ করে | আজ জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে যখন পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করি, তখন নিজের ওপর ঘৃণা আর তীব্র ধিক্কারই জন্মাতে থাকে | কি অদ্ভুত মানসিকতা ছিল আমার | অন্যকে হেয় করে, তার স্বভাব চরিত্র এমনকি সংসারের দায়িত্ব বোধের ওপরও প্রশ্ন করেছি বহুবার | বারে বারে তোমাকে লোকচক্ষুর সামনে ছোট করে উপস্থাপনা করেছি , যাতে আমার মতো সকলেই তোমাকে ঘৃণা করতে পারে, তোমাকে সমালোচনায় বিদ্ধ করতে পারে, তোমাকে দুষ্ট চরিত্রের বলে প্রতিস্থাপিত করতে পারে | তুমি কিন্তু তিলে তিলে বিদ্ধ হয়েও জবাব দাওনি কোনো কটূক্তির | দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও তুমি শান্ত থেকেছো, মুখ বুজে তোমার কর্তব্য করে গিয়েছো | তোমার এই নম্রতা, এই জবাব না দেওয়ার মানসিকতা আমার অন্তরে জ্বলে ওঠা আগুনে ঘৃতের কাজ করতো | আমি আরো বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠতাম |
আজকের আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার ওপরেই নির্ভরশীল | তুমি এখনও তোমার নিজের সাংসারিক কাজ নিয়ে মগ্ন থাকো, কাজ করে যাও মুখ বুজেই | কিন্তু আজ আর আমার তোমার ওপর রাগ বা বিরক্তি কিছুই হয় না | আজ ভাবি আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনীয়তা কতটা অসীম | তুমি ছাড়া আজ আর আমার জীবনে কেউ নেই | আমার ভিতরে-বাইরে শুধু তুমি | আজ নিজের প্রতি আমার ঘৃণা হয় | ধিক্কার জানাই নিজেকে | শরীরের রক্ত যতদিন গরম ছিল, তোমার অমর্যাদা করেছি | আজ সে গরমও নেই, সে জেদও নেই, নেই সেই তেজ বা তোমাকে ছোট করে উপস্থাপনা করার প্রবণতা | এখন তুমিই আমার পড়ন্ত বেলার একমাত্র সাথী | আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার একমাত্র কারিগর | আমার জীবন সাথী |