জাতিস্বর
জাতিস্বর


“মেরোনা...আমায় তুমি আর মেরোনা!!” – টুবাইয়ের চিৎকার শুনে হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এল তুলী। এসে দেখে, টুবাই গল গল করে ঘামচ্ছে আর ছটফট করছে। কাল অনেক রাত করে বাড়ী ফিরেছে ও। করোনার প্রকোপে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। করোনা ওয়ার্ডেই ডিউটি পরেছে ডঃ অরিন্দম বসুর, ওরফে টুবাই। কিছুদিন আগে একজন প্রৌঢ় নতুন ভর্তি হয়েছেন করোনা সংক্রমিত হয়ে। উনার অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক হওয়ায়, টুবাইয়ের ফিরতে অনেকটা দেরি হয়েছিল কাল। অনেকদিন ধরেই খুব দখল যাচ্ছে ছেলেটার। তুলী ভাবল হয়ত বেশি স্ট্রেশ থেকেই ও এমনটা করছে। তাই ওকে আর না ডেকে একটা গামছা নিয়ে আস্তে আস্তে ঘামটা মুছিয়ে দিল আর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতেই ও আবার শান্ত অবুঝ শিশুর মতো ঘুমোতে লাগল।
"টুবাই, এই টুবাই..." অনেকক্ষন ডাকছে ওকে মা। সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর ১২ টা। ইতিমধ্যে সমস্ত কাজ সেরে, স্নান করে তুলী পূজো করছে। পূজো সেরে নিচে নামতেই দেখল টুবাই বারান্দায় পায়চারি করছে। ওকে আজ অনেক বেশি অস্থির দেখাচ্ছে। গত এক বছরের দাম্পত্য জীবনে টুবাইকে এতটা বিধ্বস্ত তুলী আগে কখনও দেখেনি। তাই ছুটে এসে জানতে চাইল, "হ্যা গো, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমি বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি..., বলো না তোমার কি হয়েছে?"...."ও এমন কিছু না। খেতে দাও দেখি, আমায় আবার হাসপাতালে যেতে হবে"- এই বলে ও ঘরে গিয়ে সোজা খাবারের টেবিলে বসে পড়লো। ঝটপট খাওয়া সেরে চলে গেল হাসপাতালে। এভাবেই কেটে গেল আরো দিন দশেক।
আজ ১৫ দিন লড়াই করে সেই প্রৌঢ় করোনাকে জয় করতে পেরেছেন। উনার সাথে জয় হয়েছে সেই সকল সাস্থ্য কর্মীদের, বিশেষ করে ডঃ অরিন্দম বসুর, যাদের অক্লান্ত চেষ্টায় আজ তিনি সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরেছেন। দেখতে দেখতে ইতিমধ্যেই আরো দু সপ্তাহ পেড়িয়ে গেল। হসপিটালেও রোগীদের সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে। এই দুসপ্তাহে নতুন করে আর কোন কেস আসেনি। সবাই এখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, একমাত্র ডঃ বসু বাদে। এতদিন ধরে নিজের মনের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করছে টুবাই। না পারছে তুলীকে কিছু বলতে, না পারছে নিজের মধ্যে কথাটা আর চেপে রাখতে। আর মা তো চারদিকের পরিস্থিতি দেখে এমনি সবসময় আতঙ্কিত থাকেন, তার উপর উনার অনেক বয়স হয়েছে। উনাকে টুবাই কিছু বলতেই পারবে না। মাকে নিয়েই টুবাই আর তুলীর ছোট্ট সংসার।
না, আর পারা যাচ্ছে না। একবার গিয়ে দেখতেই হবে আসল সত্যটা। তাই সময় নষ্ট না করে পরদিন সকাল সকাল চলে এল হাসপাতালে। রেজিস্টার থেকে ঠিকানা টুকে নিজেই গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পরল সেই প্রৌঢ়র বাড়ীর উদ্দেস্যে। যতো এগোচ্ছে, ঝাপ্সা পুরনো সব স্মৃতিগুলো ঝলমলিয়ে পরিস্কার হয়ে উঠছে তার চোখের সামনে। হ্যা, এই তো সেই মাঠ, তার সুপরিচিত সব রাস্তা ঘাট। বাড়ীটা ঠিকই চিনতে পেরেছে টুবাই। কাউকেই আর জিজ্ঞাসা করতে হয়নি। কাঁপা কাঁপা পায়ে গিয়ে দরজার সামনে দাড়াল। হাজারো প্রশ্ন তার মনে এখন ঝড় তুলছে। অমনি একজন বয়স্ক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, "কে তুমি বাবা?" সেই মমতাময়ী চোখে চোখ পরতেই টুবাইয়ের ভেতরটা কেমন শিউরে উঠল। মুহূর্তের জন্য ও স্তব্ধ হয়ে গেল। পরক্ষনেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, "আমি ডঃ অরিন্দম বসু। জি.বি.পি. হাসপাতাল থেকে এসেছি, মিঃ মুখার্জীর চেকআপ করতে। উনার চিকিৎসা আমাদের হাসপাতালেই হয়েছে।" বৃদ্ধা তখন সযত্নে টুবাইকে ঘরে নিয়ে বসালেন। সেই ঘরেই এক প্রান্তে একটি বিছানায় মুখার্জী বাবু শুয়ে ছিলেন। ডঃ বসু কে দেখে খুশি হয়ে তিনি উঠে বসলেন।
মুখার্জী বাবুর বিছানার পাশের টেবিলে আজ ও সেই ছবিটি বিরাজমান। ছোট্ট রুমি পুতুল হাতে বসে আছে মায়ের কোলে আর পাশে বসে আছেন তার বাবা, মুখার্জী বাবু। যৌবন কালের ছবি উনার। মাকেও কি অপূর্ব সুন্দর দেখতে ছিল। কেউ হয়ত ভাবতেও পারেনি ভাগ্য বিধাতা কতটা রুষ্ট হয়ে এই ছোট্ট রুমির দূর্ভাগ্য রচনা করেছেন। দম বন্ধ হয়ে আসছিল টুবাইয়ের। তাড়াতাড়ি মুখার্জী বাবুর চেকআপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল টুবাই। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পরল ওখান থেকে। সেদিন ও ছিল খুব বৃষ্টি, আজও আচমকা বৃষ্টি শুরু হলো। মুখার্জী বাবুর বংশ বৃদ্ধির জন্য ছেলের খুব আকাঙ্খা ছিল। তাই রুমিকে তিনি কোনোদিনই ভালোবাসেন নি। বিগত পাঁচ বছরেও যখন রুমির মা আর সন্তান ধারণ করলেন না, মুখার্জী বাবুর সব রাগ এসে পরেছিল তার একমাত্র সন্তান সেই পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে রুমির উপর। তাই তো রুমির মায়ের অবর্তমানে তাকে পুকুরে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে একটুও হাত কাঁপেনি মুখার্জী বাবুর। সেদিনের ঝড় বৃষ্টিতে কেউ শোনেনি ছোট্ট রুমির বাঁচার আর্তনাদ। মেয়ে হয়ে জন্মেছিল বলেই সেদিন এভাবে তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
পূর্ব জন্মে রুমির জীবনের সেই অভিশপ্ত দিনটি এই জন্মে আজও তাড়া করে বেড়ায় টুবাইকে। ভাগ্যের কি পরিহাস। যে বাবা সেদিন ছোট্ট রুমিকে বাঁচতে দেননি, সেই বাবাকেই এই জন্মে ডঃ অরিন্দম বসু আবার নতুন জীবন দান করেছেন। গাড়ীর কাঁচটা মাঝে মাঝেই ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছে। কাল বৈশাখির ঝড় উঠেছে বাইরে। টুবাইয়ের ভেতরেও যে তোলপাড় হয়েছে, সেটা নাহয় সবার অজান্তেই রয়ে গেল তার মনের অন্তরালে।