Debdutta Banerjee

Inspirational

3  

Debdutta Banerjee

Inspirational

ইচ্ছে পূরণ

ইচ্ছে পূরণ

7 mins
800


পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের মিঠেকড়া রোদের ঝলক এসে পড়ছিল ঠিক মৌরির মুখে। একটা বালিশ চাপা দিয়ে আরামের ঘুমটার শেষ পরশটা নিতে চাইছিল ও। কিন্তু আম গাছের ডালে দুটো কাকের দাম্পত্য কলহে বাধ্য হয়ে বিছানা ছাড়তেই হল। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে মৌরি যত ভাবে দেরি করে উঠবে, ঘুমটা যেন ওকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় কোথায়।এখন কিছু দিন পড়ার চাপ নেই। ধীরে সুস্থে সকালের জলখাবার খেয়ে মৌরি সবে গল্পের বইটা হাতে নিয়েছিল, তখনি ফোনটা বেজে উঠল। তিতানের ফোন, একটা খারাপ খবরে মিষ্টি সকালটা ভারি হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। অর্ণব স‍্যার আর নেই। শেষ তিনদিন ধরে হাসপাতালে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন স‍্যার। কথা বন্ধ হয়ে গেছিল।

অর্ণব স‍্যার মৌরির বাবাকেও পড়িয়েছেন। ওদের স্কুলের হেডস্যার ছিলেন। অবসর নিয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই। তারপর থেকে ঘরে দুস্থ: বাচ্চাদের পড়াতেন। মৌরিরা গেলেও দেখিয়ে দিতেন পড়া।

মৌরিদের পাড়ায় মাঠের ধারে ওঁঁর ছোট্ট এক চালা বাড়িটা, সামনে একটা পেয়ারা গাছ। একাই থাকতেন উনি। ঠিকা কাজের লোক মালতী মাসি দুবেলা রেঁধে দিত। এর আগে স‍্যারের কোনো বড় অসুখের কথা কখনো শোনেনি মৌরি। বরঞ্চ কারো অসুখ বিসুখে স‍্যার ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মৌরির বাবার যখন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে, অপারেশনের সময় স‍্যার রক্ত দিয়েছিলেন। ওদের পাশে ছিলেন সর্বক্ষণ। সার কোনো বিপদ বা বাধা মানতেন না, সব সময় বলতেন ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।

খবরটা পেয়েই মৌরি বাকি বন্ধুদের খবর দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেলো।

তাপস কাকু, বুলু কাকু ওঁরাই এলাকার মাথা, আপাতত ওঁরাই সামলাচ্ছেন সবটা। স‍্যার তো বিয়ে করেননি। নিজের বলতে তেমন কেউ নেই। বাড়িটা আগেই লাইব্রেরী করবেন বলে দানপত্র করে ক্লাবকে দিয়েছিলেন। দুটো ঘর তো বইয়ের আলমারিতে ঠাঁসা। পড়ার বই ছাড়া দেশ বিদেশের কত গল্পের বই ছিল স‍্যারের সংগ্ৰহে। নেশা বলতে ছিল ঐ বই পড়া। মৌরিরা ওখানে বসে প্রচুর গল্পের বই পড়েছে কত বিকেলে।

হাসপাতালের সামনেটা গিজগিজ করছে লোকের ভিড়ে। একের পর এক শিক্ষক , রাজনীতিবিদ, এলাকার মাথারা আসছেন স‍্যারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ফুল দিয়ে স্বর্গ-রথ সাজানো হচ্ছে বাইরে। বুলু কাকু ফোনে কাউকে চন্দন কাঠের ব্যবস্থা করতে বলছেন কানে গেল মৌরির।

হঠাৎ ওর মনে হল কিছু একটা ভুল হচ্ছে। পনেরো বছরের মেয়েটা অত বড়দের ভিড়ে ঠিক মনে করতে পারছিল না আসল কথাটা। তবুও বার বার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে সবাই।

তিতান একটা সাদা ফুলের মালা নিয়ে এসেছে। বাবাও খবর পেয়ে অফিস না গিয়ে ফিরে এসেছে সোজা হাসপাতালে। দুস্থ: বাচ্চা গুলো কাঁদছে বাইরে বসে। স‍্যার ওদের প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতেন। রোজ সকালে ওদের পড়া শেষ হলে জলখাবার দিতেন। কখনো গুড় মুড়ি , কখনো রুটি তরকারি, আবার কখনো ডিম-সেদ্ধ কলা পাউরুটি। বিশেষ দিনে মিষ্টিও থাকত সাথে। শিক্ষক দিবসে সবাইকে মাংস ভাত খাওয়াতেন। সারের সেই এক কথা ''ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।''

ওঁঁর কাছে পড়ে রিকশাওয়ালা মাধব-দার ছেলে আজ আই-আইটি পড়তে গেছে সরকারি সাহায্যে। ঠিকা কাজ করে যে মালতী মাসি তার মেয়ে ময়না উচ্চ মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিল গতবছর।এখন কলেজে পড়ছে।

 

স‍্যার যে এমন হঠাৎ চলে যাবে কেউ বোঝেনি। ঘুসঘুসে জ্বর আর শ্বাস কষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কিছুদিন আগে। তার সাথে ধরা পড়েছিল হার্টের কিছু সমস্যা।

কিন্তু মৌরির মাথায় একটা চিন্তা ঘুরে ঘুরে আসছিল শুধু। কি যেন একটা কথা স‍্যার বলেছিলেন, কি যেন একটা শেষ ইচ্ছা ....,

হঠাৎ বাইরে একটা চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে গেছিল ও। বাবাও বেরিয়ে এসেছে। বুলু কাকু হাসপাতালের নিয়মকানুন পূরণ করছিল। তাকেও ডেকে আনল কেউ। খালের ধারের আবদুলের মা রোকেয়া এসে হঠাৎ বলেছে, স‍্যারের চোখ দুটো নাকি আবদুলের ভাই রফিকুল কে দিয়ে গেছিলেন স‍্যার। কেউ ঐ মহিলার কথায় পাত্তা দিতে রাজি নয়‌ ।

হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যায় মৌরির।

গত বছর একটা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বিষয় ছিল মরণোত্তর দেহ দান। মৌরি ঠিক গুছিয়ে লিখতেই পারছিল না। স‍্যারকে একবার দেখিয়ে নিতে গেছিল। স‍্যার খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিলেন দেহ দানের গুরুত্ব। শুধু লক্ষ লক্ষ চোখের কর্নিয়া প্রতিদিন পুড়ে নষ্ট হচ্ছে এদেশে। অথচ যদি শুধু আইনত চক্ষু দান করতে সবাইকে বাধ্য করা হয় দেশে কেউ অন্ধ থাকবে না আর। প্রতিনিয়ত সচেতনতার অভাবে এভাবে নষ্ট হচ্ছে কত অঙ্গ । হার্ট, কিডনি এমনকি হাত পায়ের মতো অঙ্গ আজকাল দান করা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য এই দেহ দান এক জরুরী পদক্ষেপ। এদেশে মেডিকেল স্টুডেন্টরা পর্যাপ্ত দেহ পায় না পড়াশোনার জন্য। এমন আরও অনেক টুকরো টুকরো আলোচনা হয়েছিল সেদিন বিকেলে। একে একে সব মনে পড়ে মৌরির।

অবসর গ্ৰহনের দিন স‍্যার স্কুলেও বলেছিলেন কথাটা। তখন অবশ্য মৌরির মাথায় ঢোকেনি। ছোট ছিল অনেক। তবে সেদিন বিকেলে স‍্যার ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন সব। বলেছিলেন যে উনিও দেহদান করেছেন। সব কাগজ ওঁঁর ঘরেই রয়েছে। যদি ওঁঁর কিছু হয়ে যায় ওঁঁর দেহটি যেন পুড়িয়ে না ফেলে দান করে দেওয়া হয়। অঙ্গ প্রত্যঙ্গর মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকবেন উনি এই সমাজে। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল মৌরি। কিন্তু এত দরকারি কথাটা ও কি করে ভুলে গেছিল মাথায় আসে না!!

ছটফট করে ওঠে বাচ্চা মেয়েটা। খুব কি দেরি হয়ে গেলো ? এত বড়দের ভিড়ে ঠিক কাকে বলবে ও এই প্রয়োজনীয় কথাটা!!

ওদিকে আবদুলের মাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে তাপস হালদার। এত বড় একজন গুনি মানুষের মরদেহ নিয়ে এখন মিছিল হবে। প্রথমেই স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ক্লাব, ওঁঁর বাড়ি ঘুরিয়ে সারা শহর ঘোরানো হবে। টাউন হলে রাখা হবে কিছুক্ষণ শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। নানারকম আলোচনার মাঝে মৌরি ছুটে যায় নিজের বাবার কাছে।

-''বাবা, স‍্যার তো মরণোত্তর দেহ দান করেছিলেন। তুমি জানতে তো বাবা। '' মৌরির কচি গলার আওয়াজে বেশ কয়েকজন ঘুরে তাকায়।

-''বাবা, বিজয়ার পর যেদিন স‍্যারের বাড়ি প্রণাম করতে গেলাম স‍্যার টেবিলের ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল দেখিয়ে তোমায় বলেছিলেন সব। মনে নেই!! বলেছিলেন ওঁর কিছু হলে .....''

মৌরির বাবা দিপেন বাবু মেয়েকে চুপ করতে বলে অসহায়ের মত চারদিকে তাকান। একটা চাপা গুঞ্জন উঠেছে ততক্ষণে আশেপাশে। একজন নার্স এগিয়ে আসে এবার। বলে -''উনি আমারও স‍্যার, ভর্তির দু দিন পর আমাকেও বলেছিলেন একথা।বাচ্চা মেয়েটি ঠিক বলছে। ''

-''কিন্তু আমরা এখন কি করে এসব ব্যবস্থা করবো। তাছাড়া এসব কাগজ পত্র তৈরি হতে আরও দেরি হয়ে যাবে। উনি এলাকার একজন সম্মানীয় নাগরিক। সসম্মানে ওঁঁর শেষ যাত্রার আয়োজন করেছি আমরা। হিন্দু শাস্ত্র মতে ...''

বুলু কাকুর কথার মাঝেই মৌরি বলে ওঠে -'' কিন্তু স‍্যারের শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানাবো না আমরা ? উনি কখনো চাননি ওঁর দেহ পঞ্চভূতে মিশে যাক। উনি বলতেন ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়... ''

বেশ কয়েক জোড়া জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় মৌরিকে।

দিপেন বাবু মেয়েকে থামাতে চান। বাচ্চা মেয়েটা আবার এসবে কেন জড়াচ্ছে!!

 বুলু সেন আর তাপস হালদার নিচু স্বরে কিছু আলোচনা করে নেয়। ওদিকে আবদুলের মায়ের সাথে খালপারের বেশ কয়েকজন চলে এসেছে। ওদের কথা মত স‍্যারের চোখ স‍্যার দান করে গেছেন রফিকুল কে।

-''তোরা কি মানুষটাকে মরেও শান্তি দিবি না? নিংরে তো নিয়েছিস সারা জীবন। নিজে খেয়ে না খেয়ে তোদের খাইয়েছেন। নিজের জন্য ভাবেননি। চিকিৎসাও করাননি। তোদের ছেলেমেয়েরা কি করে ভালো থাকবে তাই দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো মানুষটা। এবার তো শান্তিতে স্বর্গে যেতে দে। '' বুলু সেন চিৎকার করে ওঠে। সব গুঞ্জন থেমে যায় নিমেষে। ওঁঁর মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই।

মৌরি তিতান আর বাকি বন্ধুদের দিকে তাকায়। বাবার দিকে তাকাতেই বাবা ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলে। 

-''মৌরি কিন্তু ঠিক বলেছে, স‍্যার দেহ দান করেছিলেন। আমি সাক্ষী ছিলাম। '' ভিড়ের ভেতর থেকে এগিয়ে আসে রথীনদা, ওদের স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক।

-''সে সব বুঝলাম, কিন্তু... আচ্ছা ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলি, দু ঘণ্টা মত তো পার হয়েছে। চোখ দুটো যদি .... কই গো আবদুলের মা, কাগজ আছে নাকি কিছু?''

আবার একটা গুঞ্জন ওঠে।

মৌরি ছুটে যায় ডাক্তারের ঘরে। হয়তো এখনো সময় আছে, এখনো স‍্যারের শেষ ইচ্ছা পূরণ হবে ।

ডাক্তার বাবু বললেন - ''সব বুঝলাম। কিন্তু পেপার কোথায়? আমি একবার ঐ কাগজ দেখে ফোন করে দেবো ঠিক জায়গায়। আপাতত উনি এসিতে রয়েছেন। কিছুটা সময় আছে হাতে। ''

মৌরি ছুটে এসে তিতানকে বলে -''তুই স‍্যারের বাড়ি চলে যা সাইকেল নিয়ে। পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে স‍্যার চাবি রাখতেন। বসার ঘরের টেবিলের ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল আছে। ওটা নিয়ে আয়। তিতানের সাথে মিঠুন, অরূপ, শ্রাবণ ও ছুটে যায়।

বুলু কাকু আর তাপস কাকু মৌরির বাবাকে ডেকে কিছু বলছিলেন। উনি বেশ জোর দিয়ে বললেন -''দেহ দানের মধ্যে দিয়েই স‍্যার না হয় অমর হয়ে থাকবে। আসুন, বিভেদ ভুলে সবাই মিলে ওঁর শেষ ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা জানাই। রফিকুল যদি দৃষ্টি ফিরে পায়, স‍্যারের চোখ দিয়েই ও পৃথিবী কে চিনবে। ''

রুমাল বার করে মুখ মোছেন বুলু সেন। তাপস হালদার বসে পড়ে একটা চেয়ারে। ফুলে সাজানো কর্পোরেশনের স্বর্গ রথের ধূপ-কাঠির ধোয়া বাতাসের গায়ে আলপনা আঁকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজ এসে পৌঁছে যায়। বাকি ব্যবস্থা ডাক্তারবাবুরাই করেছেন। অর্ণব স‍্যারের শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ওঁঁর দেহ দান করা হয়। চোখ দুটো অবশ্যই ওঁঁর কথা মত রফিকুল পাবে। 

 বাইরে সবার মুখে মুখে তখন মৌরির নাম। বড়রা অনেকেই জানতেন কিন্তু সাহস করে বলতে পারেননি। একটা বাচ্চা মেয়ে আজ সবার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ খুলে দিয়েছে।মৌরির মনে মনে ভাবে সার তো এটাই শিখিয়ে ছিলেন যে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আজ ও সেটাই প্রমাণ করল। 

বাড়ি ফেরার পথে অর্ণব সারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মৌরির চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে যখন ও স‍্যারকে জানাতে এসেছিল তখন স‍্যার বলেছিলেন “কথাগুলো ভুলে যাস না, মনে রাখিস সারা জীবন”।

 হঠাৎ ওর মনে হয় কেউ ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছে যেন। এ এক চেনা স্পর্শ। দু ফোঁঁটা জল গড়িয়ে পরে ওর শ্যামলা গাল বেয়ে। মনে মনে ও বলে 'সার, আপনি ঠিক বলেছিলেন ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।' এরপর স্কুলে গিয়ে রথীন সারের থেকে জেনে নিতে হবে কত বছর বয়স থেকে দেহ দান করা যায়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational