হৃদয় অবাধ্য পুরুষ
হৃদয় অবাধ্য পুরুষ




হৃদয় অবাধ্য পুরুষ
প্রিয় আমার 'ঈশ্বরী' গায়ত্রী,
১.
"যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি
ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে ,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে
চিঠি লিখব না ।"
চিঠি লিখতে বসে কখনও সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।দু চারটা লাইন ,তারপর একটু মন খারাপ এবং এক কাপ চা। জীবনসায়াহ্নে এসে একটা চিঠি ও পোস্ট করে উঠতে পারলাম না! ঠিক যেভাবে আমেরিকায় চলে যাওয়ার আগে, তোমাকে বলে উঠতে পারলাম না,তোমাকে ঠিক কতটুকু ভালোবাসি। "আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।" একসাথে আছি স্মৃতির পাতায়!ভেবে দেখো একবার-
"তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি ।আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা ।"
২.
ছিপছিপে সেই পাতলা গড়নের মেয়েটা অদ্ভুত নিঃশব্দে আমার পাশ দিয়ে চলে যেতো। শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ যেন অনন্তের দিকে। হিন্দু হোস্টেলে যখন থাকতাম তখন কতই না বয়স আমার।সদ্য কিশোরের কালো গোঁফের রেখার মতো ক্ষীণ হয়ে আসতো দিগন্ত রেখা। স্কুল ছুটির ঘন্টাধ্বনি শোনার জন্য মন আনচান করতো। জানালায় অপেক্ষার মুহূর্তগুলোতে মন ছুটে যেতো আলো মাখা নরম রাস্তাতে। ঐ রাস্তাটিতেই তুমি ধীরে ধীরে হেঁটে আসতে। তখন তোমার বয়স হয়তো বারো কিংবা তেরো। আমায় দেখে মুখটা বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে। লজ্জা রাঙা পানের বরোজের মতো। আমার মনে ভীত খরগোশের উপমাটি ধরা দিতো আর আমি হোস্টেলের অন্দরে ফিরে যেতাম।
৩.
মুখ ফুটে কখনো কিছু বলতে পারলাম না। চোখের পাতায় কিছু নীল হলুদ আলোর রেখা চৈত্র মাসের ভরারোদে মুছে গেল জীবন থেকে।আমেরিকা যাওয়ার দিনটা খুব দ্রুত এগিয়ে এল। কান্না জমা মুখ।নীল আকাশ।একটা এরোপ্লেন হয়ে 'প্রকৃত সারস' উড়ে গেল!
৪.
বিয়ের প্রশ্ন ঠাঁই পেতো না মনে।কাছের মানুষ বলতে কেউ কোথাও নেই। তুমি ও নেই। জ্বরের ঘোরে তবুও তোমার হাতের স্পর্শ পাই ঠান্ডা জলপটিতে।তিতো হয়ে আসা মুখে যেন তুমি খাইয়ে দিচ্ছো রান্না করে আমার প্রিয় খাবার।পাগলামিতেই তোমাকে প্রতি বার ফিরে পাই, তোমার চেনা শব্দ কিংবা ডাক ধরা দেয় ভোরের পাখির কাকলিতে কিংবা শীতের ভোরে শুকনো পাতায় খসখস শব্দ করে চলে যাওয়া কোনো
বন্যপ্রাণীর পদধ্বনিতে। এক একবার মনে হতো ভগ্নপ্রায় বিষণ্ণ হৃদয় সমস্ত সুন্দরতম সৃজনের ঝর্ণা বয়ে আনে। ব্যথার অন্তস্থল হয়ে ভেসে আসে মধুরতম শব্দমালা। জলে ভেজা চোখের কোণে ধরা দেয় অন্তরঙ্গ প্রকৃতির একান্ত রূপ রস গন্ধ। প্রিয় ঈশ্বরী, তোমার স্মৃতি ভীড়ে যায় কবিতার বন্দরে। এই বিরহেই আমার তোমার মহান প্রেম কাব্যের জন্ম হয়। 'অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহ ব্যথা ভালো।'
৫.
মহানগরীর কল্লোল থেকে দূরে চলে এলাম শিমুলতলায়। প্যালেস্তার খসে গেছে, দেয়ালে দেয়ালে নোনা লেগে গেছে। হাড় পাঁজরা সব বেরিয়ে আসে। গাছগাছালিতে ভরা খাল আর মাঠে চোখ ক্ষনিকের জন্য জুড়িয়ে আসে।মনের ভিতরে বুদবুদের মতো হতাশা বড়ো হতে হতে কখনো কখনো দু লাইন কবিতার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।কোনো কোনো রাতে মরার ইচ্ছা প্রবল হয়ে আসে। আমার অগোছালো ঘর, আধপোড়া বিড়ির বিক্ষিপ্ত জ্যামিতিক বিন্যাস,ক্ষয়ে আসা জীবনের গলিত মোমবাতির আলোয় ঘুম ঘুম চোখে তোমার টুকরো টুকরো ছবিগুলো জুড়ে হলদে হয়ে যায়। ক্যালেন্ডারের দিন গুলোর ছাপ আবছা হয়ে আসে। আমি যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি। ক্লান্ত জীবনের ক্ষয়ে আসা বিস্বাদ মূহুর্তে ভরপুর। মৃত্যু বয়ে আনে অখণ্ড অবসর ছুটির দুপুর। এ জন্মে নয় হয়তো পরের জন্মে। 'ফিরে এসো চাকা।'
৬.
তুমি বলতে, ‘' কবিদের অপেক্ষায় মানায়।’
অগ্রহায়ণ-পৌষ পেরুলো, তার বাংলোর কার্নিশে
কোন উদ্ভিদের আশ্বাস দেখেছো কি হে দক্ষিণের বাতাস?"
ইতি,
তোমার বিনয় মজুমদার।