হৃদ-মাঝারে
হৃদ-মাঝারে
শুভ্রা আর তুহিনের সম্পর্কটা এখন তলানীতে এসে ঠেকেছে। অথচ প্রায় বছর সাতেক চুটিয়ে প্রেম করেই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো!
কে বলবে, কখনও দুজন দুজনকে চোখে হারাতো? একমুহুর্তও থাকতে পারতো না কেউ কাউকে ছাড়া! আহা কি ভালোবাসাই না ছিলো দুজনের।
আসলে, প্রেমে পড়া বা ভালোবাসার বাঁধনে ধরা পড়াটা - তাদের কারোর জন্যই নতুন কিছু ছিলো না। সুন্দরী মেয়েদের সাথে সম্পর্ক তুহিনেরও ছিলো বেশ কয়েকটা, আর শুভ্রার প্রাক্তন প্রেমিকের সংখ্যাও - কড়ে গুণেই বলার মত।
দুজনের কারোরই আগের সম্পর্কগুলো না টিকলেও, এই সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো কি কারণে - সেটা বোধ হয় তারাই বলতে পারতো। তবে, মনে হয় তাদের সম্পর্কে ভালোবাসা যতটা গভীর ছিলো, তার ভিত বিশ্বাসে ততটা মজবুত ছিল না।
শুভ্রার বাবা যথেষ্ট ধনী ব্যবসাদার, মাও উচ্চশিক্ষিতা। তুহিনের বাবা মা অবশ্য কেউই সেই অর্থে, না তো উচ্চশিক্ষিত আর নাই কোন সম্পদশালী ব্যক্তি। দুই পরিবারের মধ্যে সত্যি বলতে কি, কোনোদিক দিয়েই কোনো মিল ছিল না।
যাই হোক, তাদের বিয়েতে শুভ্রার পরিবারের কারোরই বিশেষ মত ছিলো না। একই কথা তুহিনের বাড়ির লোকেদের জন্যও প্রযোজ্য।
কিন্তু, তুহিন তখন বেশ ভালো একটা চাকরী করতো বলেই হয়তো, কারোরই মতামতকে তারা বিশেষ কিছু গুরুত্ব না দিয়ে, নিজেরাই বিয়েটা করে ফেলেছিল।
পরে, তাদের ভালোবাসা, সুখী দাম্পত্য দেখে তাদের দুই পরিবারও বেশ খুশি হয়। তাদের মধ্যে সম্পর্কটাও বেশ সহজ হয় এবং ধীরে ধীরে সাবলীল আত্মীয়তা জন্ম নেয়৷
সে'সব প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। এখন তো বেয়াই বেয়ান বলতে দুই পরিবারের লোকেরা একবারে অজ্ঞান। কিন্তু এখন আবার তাঁদের ছেলেমেয়ের সম্পর্কটাই ঠিক নেই আগের মত।
মুশকিলটা তো এখানেই - আমাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা কোনোরকম আত্মীয়তার বন্ধনে জড়ানোর আগে দশ বার ভাবেন, একশ'বার খোঁজ খবর করেন, তারপর সিদ্ধান্ত নেন।
এর ফলে তাঁদের সিদ্ধান্ত ঠিক ভুল যাই হোক না কেন, পরবর্তী জীবন অনেকটা বিপন্মুক্ত নিশ্চিন্ত আরামদায়ক হয়। অনেক সময়েই নবীনরা সেই প্রবীণদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে - সব ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ও না, আবার কখনও কখনও হয়ও!
এখানেই যেমন, শুভ্রা আর তুহিনের পরিবারের লোকেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত ভুল বুঝতে পেরে মধুর আত্মীয়তায় বাঁধা পড়েছিলেন। সাধারণত, ঐ বয়োজ্যেষ্ঠদের চিন্তা ভাবনাগুলো সুদূর প্রসারী হওয়ায়, সম্পর্কে জড়ালে তাঁরা নিজেদের হৃদয় দিয়েই জড়ান - আধুনিক এই নবীনদের মত আবেগের বশে হঠকারী হয়ে নয়।
তাই, শুভ্রা বা তুহিন লজ্জার মাথা খেয়েও কোন ভাবেই নিজেদের বাড়ির লোকেদের বলতে পারে নি - তাদের দাম্পত্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কথা। এক অলিখিত চুক্তি মেনে দুজনেই বাড়ির লোকেদের সামনে, তাদের একই রকম প্রেমের অভিনয় করে যেতে থাকে।
শুভ্রার জীবনে ফিরে এসেছিলো তার প্রথম প্রেম - আকাশ। সে চলে গিয়েছিলো নিজের কেরিয়ার গড়বে বলে তাকে ছেড়ে দূর বিদেশে। আজ প্রায় বছর বারো পর তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা ও ধনরাশি এনে সে ব্যবসা শুরু করতে চলেছে। স্বাভাবিক কারণেই, সে এখন শুভ্রাকে চায়। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবরটা পেয়ে, একটু কিন্তু কিন্তু করেও অবশেষে তার ফিরে আসার খবরটা তাকে জানিয়েই দেয়।
ফোনে এরপর তাদের যোগাযোগ আবার শুরু হয়। সাধারণ নিত্য কথাবার্তা থেকে ধীরে ধীরে তাদের হারানো প্রেম ফিরতে শুরু করে আবার। শুভ্রা অনুভব করে, তুহিনের সাথে বিয়ে করে সে নিজের জীবনে একটা ভুল করে ফেলেছে।
আকাশের কথা কেন যে সে ভুলে গিয়েছিলো, তার জন্য আক্ষেপ করে সে। তার প্রথম প্রেম তার কাছেই ফিরে এসেছে, তবু দুহাত বাড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাতে না পারার দুঃখ, কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে দিনরাত তার মনকে।
এখন তুহিনের খুব সাধারণ কথাবার্তা ইয়ার্কি ঠাট্টাও যেন বড় বিষ লাগে তার। নতুন করে জীবনে তার তখন প্রেম এসেছে, পুরানো প্রেমিকের উপস্থিতি তার কি করে ভালো লাগতে পারতো?
প্রথম দিকে, তুহিন বিষয়টাকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরে, সারাক্ষণ ফোনে 'বিজি টোন' শুনে, আর প্রায়ই একা বাগানে বা ছাদে উদাসী মনে বসে থাকা শুভ্রাকে দেখে, সে কিছুটা বোধ হয় আন্দাজ করতে পারে।
খোঁজ খবর করে আর তার মোবাইলের কল লিস্ট ঘেঁটে, আকাশের ব্যাপারে জানতে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। শুভ্রাকে একদিন সে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসাও করে, কিন্তু শুভ্রা আকাশের বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এড়িয়ে যায়।
ঘটনাক্রমে এইরকম সময়েই তুহিনের সাক্ষাত হয় পূজার সাথে। পূর্ব পরিচিতা হলেও তার সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার আগে। কর্মসূত্রে দুজনেই একই বিল্ডিং এর দুটো পৃথক তলে এখন বসে রোজ।
সেই সূত্রেই তাদের মেলামেশা, কথাবার্তাও শুরু হয়। পূজা নিজেও উচ্চশিক্ষিতা এবং অসামান্য সুন্দরী ছিলো। তার কথা বার্তায় মার্জিত রুচি ও শালীনতা প্রকাশ পেতো। তুহিনের সাথে তার কথা বার্তা আলাপচারিতাও ছিলো অত্যন্ত নম্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
তুহিন আবার সেই সময় নতুন বদলি হয়ে এসেছিলো ওখানে, পূজাও তাই। তুহিনের তখন যে সাংঘাতিক আশাহত বেদনার ঝড় উঠেছিলো অন্তরে, তার বহিঃপ্রকাশ হওয়া আশু দরকার হয়ে পড়েছিল।
তা নাহলে, সে নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না। তার তখন দরকার ছিলো - একজন বন্ধুর, যে তার সব কথা শুনবে, তাকে পাশ থেকে শক্তি সাহস জোগাবে, প্রায় দিশেহারা হতে বসা তার ভবিষ্যত জীবনকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
পূজার কাঁধেই অগত্যা সেই দায়িত্ব এসে বর্তালো খুব স্বাভাবিক ভাবেই। বুদ্ধিমতি পূজা যথারীতি সব খোঁজ খবর নিলো, বিশেষ অজুহাতে শুভ্রার সঙ্গে বন্ধুত্বও করলো। কিন্তু আকাশের ওপর থেকে তার মোহ বা অন্ধ প্রেমকে সে একটুও নড়াতে পারলো না।
শুভ্রার কথা শুনে, সে বেশ বুঝতে পারলো - তুহিন খুব দ্রুত বিবাহ বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। এদিকে তুহিনের যা মানসিক অবস্থা তা'তে এরপর তাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখাই দায় হবে বলে মনে হয় পূজার।
সে তাই ঠিক করে নেয়, শুভ্রাকে মোহমুক্ত করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি সে নিজে তুহিনের পাশে থাকবে তার আপনজনের মত।
তুহিন এই সময় মানসিক দ্বন্দে, দিশাহীন জাহাজের নাবিকের মত, পূজাকেই আঁকড়ে ধরে - তাকেই যেন নিজের শেষ আশ্রয় মনে করে নেয়। শুভ্রার জায়গাটায় ধীরে ধীরে তার মনে বসে যায় পূজা।
এইসময়েই একদিন শুরু হয় তুহিন-শুভ্রার তীব্র কলহ। তাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করে এমন মাত্রাতিরিক্ত স্তরে যে, বাড়িতে আসতে বাধ্য হয় তাদের দুজনেরই গোপন সাথীরা। হ্যাঁ, আকাশ আর পূজা দুজনকেই তাদের বাড়িতে এসে সেদিন নিজের নিজের প্রিয় মানুষকে সামলাতে হয়েছিলো।
পরদিন সকালেই, দুজনে মিউচুয়্যাল ডিভোর্সের মামলা করতে, বাড়ি থেকে বের হলো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন কেউ যাতে কিছু না জানতে পারে, তাই তুহিন গাড়ি চালিয়ে বের হলো, আর গাড়ির সামনের সীটে তার পাশে বসে শুভ্রা।
ফ্লাইওভার থেকে রেলিং ভেঙে নিচেয় পড়ার পর, দুজনকেই মারাত্মক জখম অবস্থায় নিকটবর্তী নার্সিংহোমে ভর্তি করে এলাকার লোকজন।
দ্রুত ফিরছি আগামী পর্বে।
