হৃদ-মাঝারে (দ্বিতীয় পর্ব)
হৃদ-মাঝারে (দ্বিতীয় পর্ব)
তুহিনের চোট মাথায় যতটা ভয়ঙ্কর ছিলো, ততটাই ভয়ঙ্কর ছিলো শুভ্রার শরীরের চোট। প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃতপ্রায় তাদের স্বামী স্ত্রীকে নিকটতম নার্সিংহোমের আই সি ইউতে রাখা হয়েছিলো।
তাদের বাড়ির লোকেরা খবর পেয়ে ছুটে আসে। পূজা এবং আকাশও ছিলো সেই দলে। নিজেদের শত কাজ, দায়িত্ব সামলেও দুজনেই হাজির হতো তাদের খোঁজ নেবার জন্য রোজ।
শুভ্রার বাবা ছিলেন ঐ নার্সিংহোম পরিচালন কমিটির মেম্বার ও স্টেকওনার। তাই, দুদিনেই তাঁদের ছেলে মেয়ের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে প্রকৃত সত্যটা জানতে পারলেন তাঁরা।
তুহিনের ব্রেনডেথ হয়ে গেছে, কিন্তু হার্ট সচল আছে। অন্যদিকে, শুভ্রার ব্রেন হ্যামারেজ না থাকলেও, হার্টের যা অবস্থা - প্রায় সিক্সটি পার্সেন্ট ব্লক ছিলো তার ভর্তির সময়, কিন্তু দ্রুত ব্লকেজ বাড়ছে।
এই খবরে ভেঙে পরলেন তাদের বাবা মায়েরা চারজনেই। আর তখনই, প্রকৃত শিক্ষা যে পুঁথি না পড়েও মানুষ অর্জন করতে পারে তার প্রমাণ দিলেন তুহিনের বাবা।
তিনিই ডাক্তারকে বললেন - তুহিনের সচল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করিয়ে শুভ্রাকে বাঁচানোর কথা। শুনে ডাক্তারবাবু নিজেও অবাক হয়েছিলেন একটু - নিজের ছেলের হৃৎপিণ্ড দান করে বৌমার প্রাণ বাঁচাতে চাওয়ার ঘটনা দেখার সৌভাগ্য তাঁর আগে হয়নি।
প্রয়োজনীয় পেপার ওয়ার্কের পর সেদিনই টীম গঠন করে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের ঝুঁকিটা নিয়ে নেন ডাক্তাররা। অপারেশন চলে রেকর্ড সময় ধরে এবং সফলভাবে শেষও হয়।
তুহিনের মৃতদেহ নিয়ে সকলে চলে যান সৎকার করতে। নার্সিংহোমের আইসিইউতে তখন সবে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেঁচে ফেরা শুভ্রা লাইফ সাপোর্টে অচেতন অবস্থায় শুয়ে।
পূজা এবং আকাশ দুজনেই সেদিন ওখানে এসে দেখে গেলো শুভ্রাকে, শুনে গেলো তুহিনের বাবা কিভাবে তার প্রাণ রক্ষা করে গেছেন নিজের ছেলের অঙ্গদান করে।
আকাশ ভীষণ খুশি হয়েছিলো শুভ্রার বেঁচে ওঠার খবরে আর তুহিনের বাবার ঐ সিদ্ধান্তের কথা শুনে। রীতিমত ধন্য ধন্য চলছিলো তখন ওখানে, সে দলে সেও যোগ দিলো।
কিন্তু খুশি হতে পারলো না শুধু পূজা। যার হৃদয়ে নিজের জন্য এতটুকু জায়গা নেই জেনে দিশেহারা উদ্ভ্রান্ত তুহিন বেঘোরে প্রাণ হারালো, সেই শুভ্রার হৃদয়ই প্রতিস্থাপিত হলো কিনা তার হৃদয় দিয়ে?
যার হার্টই ছিলো না, সেই কি করে তার অর্ধসক্ষমতা দেখিয়ে এমন একটা পবিত্র কোমল হার্ট পেয়ে গেলো? পূজার মনে তুহিনের জন্য কতটা ভালোবাসা ছিলো জানা নেই, কিন্তু তার তীব্র ক্ষোভ ছিলো শুভ্রার প্রতি তা স্পষ্ট।
সেদিনের পর থেকে আর কখনও শুভ্রাকে দেখতে বা তার খবর নিতে আসেনি পূজা। সেই দিনই শেষবার তাকে আইসিইউ তে দেখা করে চলে আসার আগে, তার কানে কানে বলে এসেছিলো -
যাকে ভালোবাসতে পারছিলে না, নিজের হৃদয় থেকে মুছে দিয়েছিলে, এখন থেকে তারই হৃদয় নিয়ে বাঁচতে হবে তোমায় সারা জীবন। তুহিন তোমায় সত্যিই খুব ভালোবাসতো শুভ্রা, আশা করি তুমি সেটা বুঝতে পেরেছো।
কিন্তু, আমি জানিনা তোমার মত হৃদয়হীনাকে সে ক্ষমা করতে পেরেছে কিনা, আমি হলে তো করতাম না। অভিশাপ দিতাম - রোজ একটু একটু করে নিজ কৃতকর্মের শোকে দগ্ধে দগ্ধে মরতে বলতাম তোমায়।
তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। যদি বিবেক বলে কিছুমাত্র তোমার থাকে, তো আমার অভিশাপ ঠিক ফল দেবে, তুমি দেখে নিও। চলি, আমায় তুমি বোধ হয় চেনো নি এখনও - আমিই তোমার সেই বন্ধু যে তোমাদের দাম্পত্যকে বাঁচাতে রোজ তোমার সাথে চ্যাট করতাম।
পূজা ওখান থেকে চলে আসার পর, শুভ্রার মনে কি প্রভাব পরেছিলো বা আদৌ তার কথা গুলো সেইসময় তার কর্ণগোচর হয়েছিলো কিনা জানা নেই, তবে সে দ্রুত সুস্থতা লাভ করতে থাকে।
সেদিন পূজার কথাগুলো শুভ্রার অচেতন মস্তিষ্ক শুনতে পারেনি বোধ হয়, শুনেছিলো তার বুকে সদ্য স্থান পাওয়া তুহিনের হৃদয়টা। কথায় বলে না - আবেগ মানুষের হৃদয় থেকে আসে মস্তিষ্ক থেকে নয়।
শুভ্রারও হৃদয় পরিবর্তন হয়েছিলো - আক্ষরিক অর্থেই। সেটা সর্বপ্রথম টের পেলো আকাশ৷ ছয় মাস পর শুভ্রা যখন বাড়িতে ফিরে বিশ্রামরতা, তখনই একদিন আকাশ এসেছিলো তার সঙ্গে দেখা করতে।
যথারীতি, একথা সেকথার পর নিজেদের কথায় আসে তারা। আকাশ তাকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে বলে নিজেদের ভবিষ্যত জীবন নতুন করে শুরু করার জন্য। সে একটা এনগেজমেন্ট রিং নিয়ে এসেছিলো সাথে করে সেদিন।
সেটাই পড়িয়ে দেয় শুভ্রাকে, বলে - অনেক অনেক অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। আজীবন তোমায় পেতে চেয়েছি, তার জন্য নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখিয়েওছি।
এবার তো তুহিনকে ভুলে নতুন করে বাঁচার কথা ভাবো। যা হয়ে গেছে, তা ভুলে যাও। নিজের ভবিষ্যত জীবনের কথা ভাবো। বলো তো আমি নিজে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলি?
তাকে অবাক করে দিয়ে, তখন শুভ্রা বলে - আমি তুহিনের স্ত্রী ছিলাম, আছি, আর থাকবোও। আমার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার যদি অধিকার কারোর থাকে তো তিনি আমার বাবা নন, আমার শ্বশুর।
মনে যদি সৎসাহস থাকে, পারো তো তাঁর সাথে গিয়ে কথা বলো। বলো গিয়ে তাঁকে যে, তাঁর সদ্য বিধবা পুত্রবধূকে তুমি স্ত্রী হিসাবে পেতে চাও, তাকে বিয়ে করে নিজের রঙীন স্বপ্নপূরণ করতে চাও। যাও, বলো গিয়ে তাঁকে!
তার এই উত্তর শুনে, আকাশ স্তব্ধ নির্বাক হয়ে যায়। এইভাবে তার সাথে কোনোদিন কথা বলে নি আগে শুভ্রা! মিষ্টভাষী শুভ্রার মুখের এমন তীব্র শ্লেষ তাকে নাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু, শুভ্রার পরিবর্তিত আসল মূর্তি দেখতে তার তখনও বাকি ছিলো।
আগামী পর্বে সমাপ্য।
