STORYMIRROR

Monir Chowdhury

Abstract Classics Others

4  

Monir Chowdhury

Abstract Classics Others

গরিবের চাপা কান্না

গরিবের চাপা কান্না

5 mins
397


স্কুল যাওয়ার সময় অবুঝ শিশু রহিম তার রিকশাচালক বাবার কাছে আবদার করে বলছে, বাবা দশটা টাকা দাও স্কুলে নিয়ে যাব। আমার অধিকাংশ বন্ধু‌রা টিফিনের জন্য টাকা নিয়ে যায়। টিফিনের সময় তারা ঐ টাকা দিয়ে বিভিন্ন রকমের জিনিস কিনে খাই। ওরা টিফিনের সময় কতই না মজা করে। তখন ওদের ঐ দৃশ্যগুলো আমাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়‌। এই জন্য তুমি আজকে আমাকে দশটা টাকা দাও না বাবা। টিফিনের সময় কিছু কিনে খাব।


তখন রহিমের মুখে টাকা চাওয়ার কথা শুনে তার বাবা জমির আলী ধমক দিয়ে বললেন, “যেখানে যাচ্ছিস সেখানে যা। আমাকে জালাতন করছিস না তো। আমি টাকা পাবো কোথায়? রিকশা চালিয়ে যা টাকা হয় তোর মা সংসার চালানো জন্য আমার কাছ থেকে সব নিয়ে নেয়। আমাকে এককাপ চা খাওয়ার টাকা তাই দেয় না। সব বাবাই তো চাই তার সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু আমার কাছে টাকা না থাকলে কি করে তোর আবদার মেটাব বল? এমনিতেই সংসার চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতি যেভাবে ধাক্কা খেয়েছে। যার ফলে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া ঢাকা শহরে আগের তুলনায় যানবহন অনেক বেশি হয়ে গেছে। জীবিকার তাগিদে অধিকাংশ শ্রেণীর মানুষ অন্য কাজের পাশাপাশি অবসার সময়ে বিভিন্ন রকমের গাড়ি চালিয়ে টাকা উপার্জন করছে। সেই কারণে দিন দিন আমাদের মত রিকশা চালকদের উপার্জনও কম হয়ে যাচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দৈনন্দিন তিনশো টাকা উপার্জন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।”


সেই মুহূর্তে রহিম তার রিকশা চালক বাবার মুখে করুণ কাহিনী শুনে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার মনের মাঝে কেঁদে উঠে। বিস্মিত হয়ে সে মনে মনে ভাবতে থাকে এমন হবে আগে জানলে তো সাতসকালে বাবার কাছে টাকা চাইতাম না। টিফিনের জন্য টাকা চেয়ে বাবার মনে কষ্ট দিতাম না। প্রতিদিনের ন্যায় স্কুল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খালি হাতে স্কুলে চলে যেতাম। কষ্ট করে না খেয়ে টিফিনের সময়টা পার করতাম। আমার জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো বাবাকে বুঝতে দিতাম না। তারপর রহিম এই সব কথা গুলো বলার পর খালি হাতে স্কুলে চলে যায়।


সেদিন রহিম স্কুল চলে যাওয়ার পর তার বাবা জমির আলী একা একা দুঃখ প্রকাশ করে বলতে থাকেন, “হয়রে পোড়া কপাল আমার, বড় আশা নিয়ে অবুঝ ছেলেটি আমার কাছে আজকে দশটা টাকা চাইলো আমি দিতে পারলাম না। আমার মত হতভাগা বাবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে, না থাকা অনেক ভালো। আজকে যে করেই হোক সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার সময় ছেলেটার জন্য কিছু কিনে আনতে হবে।”


এদিকে জমির আলী একা একা যখন দুঃখ প্রকাশ করছিলেন, তখন তিনার স্ত্রী রান্না ঘর থেকে গলা হাঁকিয়ে খাবার খাওয়া জন্য ডাক দিলেন, “কই গো, অনেক বেলা হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বাহির হও। এমনিতেই চাল,ডাল সব ফুরিয়ে গেছে। হয়তো বা কোন রকম আজকে দিনটা পার হবে। ঘরেরও তো অল্প কিছু টাকা মজুদ আছে। আজকে বাড়ি ফেরার সময় তোমাকে বাজার থেকে চাল, ডাল কিনে আনতে হবে। নয়তো আগামীকাল আমাদেরকে না খেয়ে থাকতে হবে।”


অতঃপর, জমির আলী স্ত্রীর ডাক শুনে সকালের খাবার খাওয়া জন্য রান্না ঘরে ছুটে গেলেন। তারপর তিনি সামান্য কিছু খাবার মুখে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রতিদিনের মত রিকশা নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলেন। কিছু পথ যাওয়ার পর পিছন থেকে একজন ভদ্রলোক জমির আলীকে ডাক দিলেন, “এই যে রিকশাওয়ালা মামা, আপনি আমাকে তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসেন। প্রয়োজন হলে আমার কাছে ডাবল ভাড়া নিয়েন।” পিছন থেকে ভদ্রলোকটির ডাক শুনে জমির আলী ভদ্রলোকটির কাছে ছুটে গেলেন এবং তিনাকে রিকশায় উঠতে বললেন। ভদ্রলোকটি রিকশায় তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লেন। তারপর তিনি বললেন, “রিকশা ওয়ালা মামা, আমাকে তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসেন। খুব দেরি হয়ে গেছে একটু রিকশা জোড়ে চালান।” ভদ্রলোকটির কথায় সাড়া দিয়ে জমির আলী বললেন, “আচ্ছা মামা, রিকশা অন্য দিনের তুলনায় একটু জোড়ে চালাচ্ছি। আমার কোন সমস্যা নেই।”


এভাবে কিছু পথ যাওয়ার পর ভদ্রলোকটি জমির আলীকে জিজ্ঞেসা করলেন, “মামা, আপনার বাড়িতে কে কে আছে? আর এই বয়সে এত কষ্ট করে আপনি কেনে পা দিয়ে পেটেল মেরে রিকশা চালাচ্ছেন? আপনার কষ্ট হচ্ছে না? তখন জমির আলী উত্তর দিলেন, “মামা কি আর করি বলুন, এই বয়সে রিকশা চালানো ছাড়া তো কোন উপায় নেই। আমরা গরিব মানুষ বসে থাকলে তো আমাদের চলবে না। এমনিতেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। দিন দিন খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে। আমাদের মত গরিব অসহায়দের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। দশ বছরে একটা ছেলে আছে ঠিক মত তার আবদারগুলো অভাবের কারণে পূরণ করতে পারি না। জানেন মামা, অবুঝ ছেলেটা আজকে বড় আশা করে স্কুলে যাওয়া সময় আমার কাছে দশটা টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে না থাকার কারণে দিতে পারেনি‌। কোন উপায় না পেয়ে ছেলেটা আমার মন খারাপ করে স্কুলে চলে যায়। ভাবছি আজকে রিকশা চালিয়ে যা টাকা হবে, সব টাকা দিয়ে ওর জন্য নতুন পোশাক কিনে নিয়ে যাব। 


জমির আলীর জীবনবৃত্তান্ত শুনার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে ভদ্রলোকটি বললেন, “এখানেই দাঁড়ান মামা, আমার অফিসে পৌঁছে গিয়েছি। আপনার ভাড়া কত দিতে হবে?” জমির আলী বললেন, “মামা, একশো টাকা দিলেই হবে।” ভদ্রলোকটি তখন মানি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বাহির করে বললেন, “মামা এই নেন আপনার রিকশা ভাড়া।” তখন ভদ্রলোকটি এক হাজার টাকা রিকশা ভাড়া দিতে দেখে জমির আলী বললেন, “মামা, আমার ভাড়া মাত্র একশো টাকা, এক হাজার টাকা নাই। আমি একশো টাকার বেশি নিতে পারব না। আমার ন্যায্য ভাড়া যেইটা আপনি সেই ভাড়াটা দিন মামা।” “আরে মামা, আমি আপনাকে খুশি করে দিচ্ছি ধরেন তো টাকাগুলো, এই টাকা দিয়ে আপনি আপনার ছেলের জন্য নতুন পোশাক কিনে নিয়ে যাবেন।”


অবশেষে জমির আলী টাকাগুলো নিতে বাধ্য হলেন। তারপর তিনি সেই টাকা দিয়ে ছেলের জন্য নতুন পোশাক কেনাকাটা করলেন এবং বিকালের দিকে খুশি মনে রিকশা চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বাড়ি ফেরার সময় জমির আলী মনে মনে ভাবছিলেন, অনেক দিন পর ছেলেটার জন্য নতুন পোশাক কিনে নিয়ে যাচ্ছি। নতুন পোশাক পেয়ে ছেলেটা বুঝি খুব খুশি হবে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠবে। এই কথাগুলো ভাবার এক পর্যায়ে জমির আলী দেখতে পেলেন, কিছু মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছে। একজন অপরজনের সাথে কি যেন বলাবলি করছে।


তখন জমির আলী রিকশা স্লো দিয়ে একজনকে জিজ্ঞেসা করলেন, “এই যে ভাই, এখানে কি হয়েছে? এতো মানুষ এখানে কি করছে?” তখন সেই লোকটি জমির আলীকে বললেন, “রিকশাওয়ালা ভাই, এখানে কিছুক্ষণ আগে একটা বিরাট দূর্ঘটনা ঘটেছে। এই দূর্ঘটনায় দশ বছরে একটা ছেলে মারা গেছে। ছেলেটা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল।” লোকটির কথা শুনে জমির আলী চমকে উঠলেন। তাড়াহুড়ো করে রিকশায় থেকে নেমে ছেলেটাকে এক পলক দেখার জন্য ছুটে গেলেন। তিনি ছেলেটার কাছে গিয়ে দেখেন, মাটি পড়ে থাকা দশ বছরে ছেলেটাই নিজের সন্তান। তখন জমির আলী নিজের ছেলেকে দেখে দিশেহারা হয়ে গেলেন এবং সেই মুহূর্তে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract