Gopa Ghosh

Inspirational

5.0  

Gopa Ghosh

Inspirational

গোলাপ তুমি

গোলাপ তুমি

6 mins
856


বাসন্তী এক ঝটকায় সুবলের হাতটা ছাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে ওঠে

"সকাল থেকে চার বাড়ি কাজ করে আর সোহাগ পেতে আমার একটুও ভালো লাগে না বুঝেছ?"

সুবল তাও হার মানে না, পেছন থেকে বাসন্তীর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বলে

"এত চটছিস কেনো? তোর চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেও সবাই বরের সাথে সোহাগ করে, তুই ভাবিস কি আমি শুধু ঘরে বসে থাকি?"

এবার বাসন্তীর গলা আরো জোর হয়

"চুপ কর হারামজদা, সারাদিন বসে বউয়ের পয়সায় খাচ্ছিস আবার সোহাগ দেখাচ্ছে, এত যদি দরদ তো কুলি গিরি করে সংসার টা টান দেখি"

সুবল এক ঠেলা মেরে বাসন্তীর কাছ থেকে সরে আসে।

"শালা মেজাজটা একদম বিগরে দিলো, যা তোকে আর দরকার নেই"

"যা যা তোর কত যাওয়ার জায়গা আছে আমি জানি, আবার রাতে এখানেই আসতে হবে"

সুবল শার্ট টা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

বাসন্তীর আরো দু বাড়ি কাজ ছিল কিন্তু শরীরটা ভালো না লাগায় আর যেতে ইচ্ছে করছিলো না। গা টা কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ছেলেটা পড়তে গেছে এসে ভাত খাবে মনে পড়ায় আবার উঠে বসে। এখন মনে হলো জর টা বোধহয় বাড়ছে। তবু উঠে কেরোসিনের ডিবে টা বের করে স্টোভ এ তেল ভরতে যায় কিন্তু তেল যা আছে তাতে হয়ত ভাত টুকুই হবে। সুবল থাকলে মন্টুর জন্য একটা ডিম আনতে বলতো কিন্তু ওর আর বাইরে যেতে ভালো লাগছিলো না তাই আলু সিদ্ধ দিয়ে ভাত বসিয়ে দিলো।

সারাদিন ঘরে বসে থাকে তাও কুড়োর কুটি টি নাড়বে না ওর ঘরের মানুষটা। সুবলের উপর যেনো রাগটা হু হু করে বাড়ছিল। এখন বাসন্তীর মাঝে মাঝে মনে হয় বেশ তো ছিলো মা মেয়েতে, দু বাড়ি রান্না করে মা প্রায় অর্ধেক সংসার টেনে দিত আর ওর কাজের টাকায় বাসন্তী ওর অনেক সখ পূরণ করত পারতো, যা এখন অতীত। বিয়েটা করে ভেবেছিল আর গতর খাটিয়ে রোজগার করতে হবে না, বর সংসার চালাবে আর ও গুছিয়ে সংসার করবে ।যেমন নতুন বাড়ির বৌদি সারাদিন শুধু ঘর সাজাতে ব্যস্ত থাকে, আর বাজার থেকে হাজার জিনিস কিনে আনে ঘর সাজানোর জন্য। দাদাবাবু অফিস থেকে ফিরে বউয়ের প্রশংসা য় পঞ্চমুখ। সত্যি বৌদির ভাগ্যটা খুব ভালো। বাসন্তীর এসব দেখে নিজের কপালটার উপর খুব খুব রাগ হয় কিন্তু কি আর করবে শুধু মন্টু কে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করতে পারলে ওর শান্তি। ভাতটা ফেন গেলে ও আবার খাটে শুয়ে পড়ে। আজ যেনো দু চোখের পাতা কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না। কাল সকালে এক বাড়ি কাজের ছুটি, দাদা নাকি বৌদিকে কি একটা চমকে দেওয়া উপহার দেবে। এক মাসটা বৌদি বলেছে ভালোবাসার মাস , তাই নাকি ভালোবাসার মানুষ একে অপরকে উপহার দেয়। বাসন্তী ভাবে সুবল তো এসব জনেও না আর ওর কাছে পয়সাও নেই , উপহার তো দূরের কথা।

বাসন্তীর ঘুম ভাঙলো মন্টুর ডাকে

"কি গো মা, দরজা টা না বন্ধ করেই ঘুমিয়ে গেছো, যদি বাইরের লোক ঢুকে পড়তো?"

"ঘুম এসে গেছে বুঝতে পারি নি, তুই একটা ডিম এনে দে, শুধু আলু সিদ্ধ ভাত করেছি, কেরোসিন বেশি নেই, কাল একবার স্কুল যাওয়ার আগে এনে দিস বাবা, নইলে রান্না হবে না" বাসন্তী কথাটা বলে বিছানার নিচে থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বার করে মন্টুর হাতে দেয়। মন্টু টাকাটা নিয়ে হাওয়াই চটি টা গলিয়ে বেরিয়ে যায়।

বাসন্তী সিদ্ধ আলু ছাড়িয়ে আলু ভাতেটা মেখে ঢাকা দিয়ে রাখে। ছেলেটা সেই কখন দুটি মুড়ি খেয়ে পড়তে গেছে খিদে তো পাবেই। কিন্তু এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়, দোকান টা রাস্তার মোড়েই। কিছু বিপদ ঘটলো না তো। মা এর মনটা যেনো কু গাইলো। সুবল তো ঝগড়া করে গেলে রাতে নেশা করেই আসে তাই ওর আসার কোনো আশা নেই। মাঝে নেশাটা খুব বেড়ে গিয়েছিল। একদিন খুব ঝামেলা করে মন্টুকে নিয়ে মায়ের বাড়ি চলে যাওয়ার পর অনেক দিব্যি দিয়ে ফেরত এনেছিল আর মন্টুর মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল সপ্তাহে একদিন ছাড়া আর নেশা করবে না। তবে যেহেতু আজ ঝগড়া হোয়েছে তাই আজ সুবল খেয়েই আসবে এটা ও ভালো করেই জানে। নিজের শরীর খারাপের কথাটা বাসন্তীর আর মনে রইলো না। ঘরটা বন্ধ করে রাস্তায় বেরোলো। মুদির দোকান টা রাস্তার মোড়ে। একটু এগিয়ে যেতেই মন্টুর বন্ধু বিশুকে দেখতে পেল,

"এই বিশু মন্টু কি তোর সাথে কোথাও গেছে?"

"না তো মাসি তবে ওকে আমি পড়া থেকে ফেরার সময় দেখেছি, ও কি তারপর থেকে আর বাড়ি আসে নি?

"না না পড়ে তারপর বাড়িতে এসেছিল কিন্তু ওকে একটা ডিম কিনতে পাঠিয়েছি অনেকক্ষন হয়ে গেল কি যে হলো বুঝতে পারছি না"

এবার বাসন্তীর গলাটা যেন একটু ধরে এল।

"ও বোধহয় কালু দের বাড়ি গেছে কারণ পড়ার সময় কালু বলছিল ওদের বাড়িতে আজ কেরাম খেলার প্রতিযোগিতা হবে"

বিশু এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে বাসন্তীর হাতটা ধরে কালুর বাড়ি নিয়ে যেতে গেল কিন্তু বাসন্তী ওকে কালু দের বাড়ি একবার গিয়ে দেখার জন্য বলল

"বিশু তুই একবার কালু দের বাড়ি গিয়ে দেখ না বাবা আমি বরং বাড়িতে যাই যদি ফিরে আসে বেচারা খিদের পেটে ছটফট করবে"

"আচ্ছা আমি দেখছি"

বলেই বিশু কালু বাড়ির উদ্দেশ্যে এক ছুট লাগালো। বাসন্তী ওখান থেকে বাড়ি ফিরল বটে কিন্তু মনটা খুব ছটফট করতে লাগলো। বাড়িতেও বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না আবার মুদির দোকানের দিকে হাটতে লাগল। মুদি দোকানি ভজুকে দেখেই বলে উঠলো

"ভজু আমার ছেলে কি তোর দোকানে একটু আগে ডিম কিনতে এসেছিল?"

ভজু এক খরিদ্দারের টাকা ফেরত দিতে দিতে বলল

"তোর ছেলে আমার দোকানে আসেনি কিন্তু আমি ওকে বেশ কিছুক্ষণ আগে বড় রাস্তার দিকে যেতে দেখেছি, তুই বরং সুবল কে পাঠিয়ে বড় রাস্তার দিকে দেখ"

সুবলের নাম শুনে ওর আবার গা পিত্তি জ্বলে উঠলো

"সে মহারাজ কি সবসময় বাড়িতে থাকে যে বলব?"এটা বলেই বাসন্তী নিজেই হন হন করে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকল।

কিছুটা হাঁটার পর দেখল সুবলের সাথে মন্টু হেলতে-দুলতে বাড়ির দিকে আসছে। ওর প্রাণটা ঠাণ্ডা হলেও মাথাটা অনেক বেশি গরম হয়ে গেল।

"কী রাজপুত্তুর বাবার সাথে শহর দেখতে বেরিয়ে ছিলিস, আর একটা ডিম কিনতে কি দু ঘন্টা লাগে, আমাকে কি এতটাই বোকা ভেবেছিস তোরা ? সত্যিই আমার হাড় মাস দুজনে মিলে কালি করে দিলি , আজ চল বাড়িতে দুটোকেই ঝাঁটা পেটা করে বের করবো"

মন্টুর অবশ্য এসব কথা মুখস্থ হয়ে গেছে তাই মন্টুর আর সুবলের আচরণে কোনো পরিবর্তন হলো না বরং ওরা বাসন্তী কে বেশি পাত্তা না দিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো।

যাবার সময় ভজু চেঁচিয়ে বলে উঠলো

"পেয়েছিস তো দুই রত্ন কে যা এবার বাড়ি চলে যা"

ঘরে ঢুকেই মন্টু নিজেই ভাত বাড়তে গেল, সুবল বলে উঠলো

"মন্টু আজ মায়ের শরীরটা মনে হচ্ছে ভালো নেই তুই খেয়ে শুয়ে পড়"

বাসন্তীর শরীরটা সত্যিই আর দিচ্ছিল না তাই ওদের কথায় কর্ণপাত না করে বালিশটা কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ল।


"ও মা একটু উঠবে?"

বাসন্তী ঘুম চোখে দেখে মন্টু তার সামনে দাঁড়িয়ে

"এত রাতে তোর আবার কি ব্যামোয় ধরল বল তো?"

"একবারটি উঠে বস না মা"

মন্টু কাতর কণ্ঠে বাসন্তী কে বলে।

বাসন্তীর বোধগম্য হয়না বাবা ছেলের ব্যাপারটা কারণ দেখে মন্টুর পাশে দাঁড়িয়ে সুবল।

"সারাদিন খেটে খুটে এসে একটু ঘুমাতেও কি তোরা বাপ বেটা মিলে দিবিনা?"

এবার সুবলের পিছনে থাকা হাতটা সামনে এনে বাসন্তীর সামনে একটা লাল গোলাপ ধরে বলে

"নাও এটা তোমার জন্য"

বাসন্তী দেখে মন্টু মিটি মিটি হাসছে।

"এটা আবার তোর বাপকে কে দিল বলতো? বাপের জন্মে কোনদিন গোলাপ কিনে দেয়নি আজ আবার কি করে নতুন নাটক শুরু হলো?

সুবল এবার বাসন্তী কে খুব কাছে গিয়ে গোলাপটা হাতে নিয়ে বলে উঠল

"তুই তো আমার গোলাপ আবার গোলাপ কেন কিনতে যাব?"

মুখে না বললেও বাসন্তীর মন খারাপটা হঠাৎ কেমন করে যেন ভালো হয়ে গেল।

এবার সুবল মন্টুকে কোলে জোর করে বসিয়ে বলে উঠলো

"বাসু এই আমাদের ছোট্ট গোলাপ, জানিস আজ ও ডিমের পয়সা বাঁচিয়ে একটা গোলাপ কিনে আমার আসার অপেক্ষা করছিল কারণ আজ নাকি ভালোবাসার মানুষকে গোলাপ উপহার দিতে হয়, এটা ও কোচিংয়ে গিয়ে জেনেছে, তাই ওর খুব ইচ্ছে হয়েছে ওর বাবা ওর মাকে একটা গোলাপ উপহার দেবে, পয়সা কম থাকলেও মানুষের ভালোবাসা বা ইচ্ছে কম হয়না এটা আজ আমরা ছেলের থেকেই শিখলাম"

বাসন্তী মন্টুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জল ভরা চোখ নিয়ে এক দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational