গল্পে অজানা ঋত্বিক
গল্পে অজানা ঋত্বিক
গল্পে অজানা ঋত্বিক
শ্যামল চক্রবর্ত্তী (সবুজ)
এই মহান পরিচালক কে নিয়ে লেখারও আমার সীমিত বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে যেটুকু বুঝেছি সেটাই প্রচেষ্টা মাত্র ।বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে ভাবতেন, শিল্পে যাপন করতেন। কেউ যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন তিনি কে: তিনি বলতেন: ‘আমি এক মাতাল। ভাঙা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল’। বাঙালীর জন্য সিনেমা নির্মাণ করতেন। কিন্তু তার ছবি স্থুল বিনোদন না। তার ভাষ্যে- ‘আমি প্রতি মুহুর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি।’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি বোধের জায়গা করে দিতেন ঋত্বিক। বাঙালির ব্যাথা, বেদনা, যন্ত্রনা ফুটে উঠতো। যে যন্ত্রনা তার নিজেরও। বাংলা ভাগ হয়ে গেলো। যেন এক মায়ের এক জঠর ভাগ হয়ে গেলো। এসবই বলতেন তিনি তাঁর সিনেমায়। সিনেমা তাঁর কাছে প্রতিবাদের ভাষা। ঋত্বিক কুমার ঘটক এক প্রতিবাদী চলচ্চিত্রকার। ছিলেন নাট্যকার, লেখক ও অভিনেতা। তাঁর লেখায়, তাঁর নির্দেশনায়, তাঁর অভিনয়ে প্রতিবাদই ছিলো প্রধান। এক হাতে জ্বলন্ত পাতার বিড়ি আরেক হাতে বাংলা মদের বোতল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন জীর্ণ শীর্ণ রোগা পাতলা এই মানুষটি। পরণে থাকতো পুরনো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। এলোমেলো চুলের সঙ্গে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ঝুলতো ঝোলা। যেই ঝোলায় তিনি ফেরি করতেন শিল্পমাখা হাজার হাজা স্বপ্ন।
ইংরেজি তে যাকে বলে Rebel সত্যজিৎ ও অন্যদিকে উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক জুটি বাঙালি যখন মেতে আছে, ঠিক সেই সময় বাংলা ছবির জগৎ এ এক নক্ষত্র ফুটে উঠলো – ঋত্বিক কুমার ঘটক। অবশ্য নক্ষত্র না বলে ধূমকেতু বা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বলাই ভালো। ! জীবনের বিভিন্ন না পাওয়া, হতাশা, যন্ত্রনা এমন নির্মম ভাবে সেলুলয়েডে এ তুলে ধরতে আমি আর কেউ কে দেখি নি।
“ভাবো, ভাবো…ভাবা practice করো “
সম্প্রীতি "ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম ক্রিটিকস” এর পক্ষ থেকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।দশটি সিনেমা মধ্যে পাঁচটি হিন্দি, তিনটি বাংলা,ফিপরেস্কির এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঋত্বিক ঘটক নির্মিত বাংলা সিনেমা ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৬০ সালে।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার ভারেঙ্গাগ্রামে, তাঁদের দেশের বাড়ীতে। তাঁর থেকে মাত্র সাত মিনিট পরে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর যমজ বোন প্রতীতিদেবী। ডাকনাম ছিল ভবা ও ভবি। পিতা সুরেশ চন্দ্র ঘটক এবং মাতা ইন্দুবালা দেবী। পিতা সুরেশচন্দ্র কর্মসূত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং এরেবারে সাহেবদের মতো জীবনযাপন করেও তিনি কবিতা ওনাটকও লিখতেন। কবি মণিশ ঘটক ছিলেন কবির বড়দা। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন কবির বড়দামনিশ ঘটকের কন্যা এবং কবির থেকে মাত্র দু মাসের ছোটো। সেই সূত্রে মহাশ্বেতা দেবীর স্বামী কবি বিজনভট্টাচার্য ছিলেন কবি ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি জামাই এবং ফ্যাতারু খ্যাত কবি নবারুণ ভট্টাচার্যর তিনিছোটদাদু ছিলেন।১৯৫৫ সালের ৮ই মে রবিবার অর্থাৎ ২৪ বৈশাখ ১৩৬২, সরমা দেবীর সঙ্গে কবি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।তাঁদের দুই কন্যা শুচিস্মিতা ও সংহিতা এবং পুত্র ঋতবান। সরমাদেবীর কাকাবাবু ছিলেন সাহিত্যিক কবিবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবীর বিয়ে হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, গান্ধীজীর ডাকে ভারতছাড়ো আন্দেলনের সৈনিক, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, ভাষা আন্দোলনের যোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর পুত্র বাংলাদেশের খ্যাতনামা অভিনেতা, শিল্প সমালোচক, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ওসাময়িকী সম্পাদক সঞ্জীব দত্তর সঙ্গে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং তাঁর ছোট পুত্র শহীদ দিলীপ কুমার দত্তকে পাক সেনারা তুলে নিয়ে গিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে হত্যা করে ১৯শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে। (মিলনসাগরে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সাতশো কবিতা ও গানের সংকলন . . .)
কবির স্কুলজীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে ময়মনসিংহ মিশন স্কুলে। তারপর কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে পড়া শুরু করেন। ক্লাস ফোর-ফাইভ থেকে পড়েছেন রাজশাহীর গভমেন্ট কলেজিয়েট স্কুলে। রাজশাহীতে কিছুদিন পড়ার পর তাঁকে দাদা মনীশ ঘটক, তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েপদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন স্কুলে ভর্তি করে দেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁকে কানপুরের টেকনিক্যালস্কুলে পাঠানো হয়। সেখানে ঋত্বিক প্রথমবার শ্রমিকদের দুঃখ কষ্ট কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। সেখানেতিনি শ্রমিকদের ওভারটাইম আদায়ের একটি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর পরিবার এতে চিন্তিত হয়েতাঁকে কানপুর থেকে এনে পুনর্বার কলকাতার পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করার পরে, কবি রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজথেকে ইংরেজী অনার্স নিয়ে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা দেননি পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়া) কাজ করবেন বলে। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই তিনি অভিনয় নিয়ে “অভিধারা” নামে একটি পত্রিকা বার করেন এবং একটি অর্ধসমাপ্ত উপন্যাস রচনা করেন, কয়েকটি গল্পের সঙ্গে।বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সবার সাথেই তাঁর চেনা-পরিচিতি থাকলেও তিনি তখনও গণনাট্য সংঘে যোগ দেন নি। ১৯৪৪ সালে বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” নাটকটি দেখার পরেই তিনি গণনাট্য সংঘ বা আই.পি.টি.এ-তে (IPTA Indian People’s Theatre Association)যোগদান করেন। ঋত্বিক ঘটকের পরিচালিত নাটকের মধ্যে রয়েছে “জ্বালা”।শুরু হয় তার সিনেমা তৈরী ও জীবন সংগ্রাম। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে অল্প সময়ের জন্য মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে বসবাস করেন পুণে ফিল্ম ইন্সমটিটিউটের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ও পরবর্তীকালে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে। তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র-ছাত্রিদের মধ্যে উল্লেখনীয় মণি কাউল, কুমার সাহানী, কে.টি. জন, শত্রুঘ্ন সিন্হা, রেহানা সুলতান, মহাজন,ধ্রুবজ্যোতি প্রমুখরা।তাঁর “যুক্তিতক্ক আর গপ্পো” ছায়াছবি নির্মাণের কিছুকাল পর ঋত্বিক ঘটক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় প্রায় তিনটি বছর মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যেই তাঁর লেখালেখি, নাটক ও সিনেমার কাজ চলতে থাকে। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁকে পুনরায় হাসপাতালেভর্তি করা হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক মৃত্যু বরণ করেন।
উপেক্ষা, অভিমান, নিজের অসম্ভব প্রতিভার সঠিক মূল্য না পাওয়া. তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলো ঋত্বিক কে। ঢাকায় থেকে দেশ ভাগের এক রাশ যন্ত্রনা নিয়ে তাঁর গোটা পরিবার চলে আসে কলকাতায়। দেশ ভাগের ক্ষত গভীর ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো ঋত্বিক কে…. তার নিদর্শন আমরা বারংবার পেয়েছি তার ছবিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সিনেমা দিয়ে মানুষ কে আরো শিক্ষিত, আরো সচেতন করে তলা যায়। এটা সত্যি যে এক বড়ো অংশের মানুষের কাছেই ঋত্বিক দুর্বোধ্য, ব্রাত্য এবং উপেক্ষিত — কিন্তু তিনিও তৈরী করতে পেরেছিলেন সেই সীমিত দর্শক গোষ্ঠী যারা তাঁকে স্থান দিয়ে ছিলেন । নিজের প্রত্যেক ছবির মাধ্যমে তিনি যেন নিজেকেই তুলে ধরতে চাইলেন। না, তিনি দেশের স্বাধীনতা কে তাঁর কোনো ছবি তেই উদযাপন করেন নি… বরং প্রাধান্য দিয়েছেন post colonial struggle কে। কি প্রচন্ড সামাজিক দায়বোধ বারে বারে প্রমান করেছেন…দারিদ্র, বেকারত্ব, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সাধারণ মানুষের দুর্দশা, উদ্বাস্তু সমস্যা ও তাদের যন্ত্রনা…. বার ফুটিয়ে তুলেছেন , তিনি ছিলেন এক celluloid rebel সিনেমা কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন…গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি establishment এর অবিচার । কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র নন… তিনি সাধারণ মানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন।
যুক্তি তক্কো গপ্পো, কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম, অযান্ত্রিক, নাগরিক…. এগুলো শুধু মাত্র কতগুলো ছবি নয়… স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক প্রতিচ্ছবি।তবে দেশ ভাগের যন্ত্রণার মতো আর কোনো কিছুই বোধহয় ঋত্বিকের মনে এতটা প্রভাব বিস্তার করে নি। এই প্রভাবের ফলেই গড়ে উঠলো তাঁর সেই অমোঘ trilogy – মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২)। sequence selection ছিল অসাধারণ। সুবর্ণরেখা তে যখন অভিরামের মা, বাগদি বৌ মারা গেলো, ঠিক তার পরের দৃশ্যে ঋত্বিক দেখালেন একটি ছোটো ছেলে দোলনায় দুলছে … অর্থাৎ অভিরামের জীবনটাও দোদুল্যমান হয়ে গেলো। শুন্যে ঝুলতে থাকা অভিরামের ভবিষ্যত প্রতিফলিত হোল একটি ছোটো ছেলের দোলনায় দোলার দৃশ্য তুলে.. এ ভাবা যায় না… কি চমকপ্রদ দৃশ্য ভাবনা! বা ধরা যাক কোমল গান্ধার — ভৃগু যখন বলছে ” ওই যে ছোটো ছোটো বাড়ি গুলো দেখা যাচ্ছে.. ওখানে আমি আর কোনোদিন যেতে পারবো না… ওটা বিদেশ “—ঠিক তারপরেই দেখানো হলো একটি ট্রেন ইঞ্জিন লাইনের ওপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অর্থাৎ এইখানেই শেষ দেশের সীমানা; ওপারে এক কালে যাওয়া গেলেও এখন আর যাওয়া যাবে না। ঋত্বিক তৈরী করলেন এক নতুন cinematic grammar; কি অসম্ভব কল্পনা শক্তি থাকলে শুধু মাত্র শব্দের ব্যাবহারে একটি জড় বস্তুর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায় (অযান্ত্রিক)! তিনি নারী চরিত্রদের ভীষণ প্রাধান্য দিতেন — মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা বা তিতাস একটি নদীর নাম.. এই ছবি গুলিতে নারী চরিত্র গুলিকেই বেশি প্রাধান্য ছিল । আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় যে তিতাস একটি নদীর নামের মতো তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষ আর একটুও বেশি সংবেদনশীল হোক। তিনি চেষ্টা করেছিলেন মানুষ যাতে জীবনের দৈনন্দিন দুঃখ-দুর্দশা- হতাশা – যন্ত্রণার দিক গুলি নিয়ে আরো একটু বেশি সচেতন হয়। Theatre দিয়ে জীবন শুরু করলেও পরে theatre ছেড়ে সিনেমার জগৎ এ আসেন কারন তিনি মনে করেছিলেন যে theatre দিয়ে খুব বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না — সিনেমা দিয়ে যেটা যেতে পারে। আগেও বলেছি cinema is a medium of mass education। কিন্তু মনোরঞ্জন প্রিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শক তাঁকে বুঝতেই পারলো না। ব্রাত্য হয়ে থাকতে থাকতে একসময় চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন ঋত্বিক। কিন্তু posthumous acceptance কাকে বলে ঋত্বিক দেখিয়ে দিয়ে গেলেন! এখন, এই সময় দাঁড়িয়ে মানুষ ঋত্বিক এর ছবি গুলি নিয়ে যেভাবে চর্চা করেন, বার বার মুগ্ধ হন, তাঁর জীবদ্দশায় এর ছিটে ফোঁটাও হয় নি।
হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র ছবি শেষ করতে পেরেছেন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক চাপ, কোনো প্রলোভনের সামনে নতি স্বীকার না করে, শিরদাঁড়া সোজা রেখে নিজের বক্তব্য প্রত্যেক ছবিতে জোরালো ভাবে পেশ করেছেন। এ যেন সিনেমার জগৎ এর নজরুল ইসলামঃ লাথি মার ভাঙরে তালা… যতসব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা….! জীবদ্দশায় ঋত্বিক হয়তো উল্লেখ করার মতন কোনো পুরস্কার পান নি… পান নি সামাজিক পরিচিতি… পান নি সাফল্য.. কিন্তু তিনি যা দিয়ে গেলেন, তাতে সত্যজিৎ এর মতোই বিশ্ব চলচ্চিত্রে তাঁর নাম চির কালের মতন সোনার অক্ষরে খোদাই করা থাকবে।
আদ্যন্ত বাঙালি ছিলেন তিনি পাঞ্জাবি, ঝোলা ব্যাগ, উস্কো খুস্কো চুল, কাঁচা-পাকা দাড়ি, কালো ফ্রেম চশমা, হাতে সিগারেট হয়ে উঠেছিল ফ্যাশন বিবৃতি । যুক্তি তক্কো গপ্পো ছবিটি তে নিজে অভিনয় করলেন… method acting এর ছাপ রাখলেন নিজের অভিনয়ে; কি অসম্ভব প্রতিভাআমাদের দেশের সিনেমা কে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের পরিচালক দের দেখিয়েছিলেন এক নতুন দিশা… জুগিয়ে ছিলেন ছবি করার সাহস। তৈরী করে দিয়ে গেছেন একদল পাগল দর্শক, যারা শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নয়, নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছবি দেখে। আর তৈরী করে দিয়ে গেছেন আমার মতন কিছু উন্মাদ, যারা বার বার ফিরে যায় সত্যজিৎ- ঋত্বিকের কাছে… বার বার মুগ্ধ হয় … বার বার বাকরুদ্ধ হয়!
তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের ছবির মধ্যে রয়েছে রয়েছে . . .“নাগরিক” (তৈরী ১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), “অযান্ত্রিক” (১৯৫৮), “বাড়ী থেকে পালিয়ে” (১৯৫৮), “মেঘে ঢাকা তারা”(১৯৬০), “কোমল গান্ধার” (১৯৬১), “সুবর্ণরেখা” (তৈরী ১৯৬২, মুক্তি ১৯৬৫), “তিতাস একটি নদীর নাম”(১৯৭৩), “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো” (১৯৭৭)।ঋত্বিক ঘটকের স্বল্পদৈর্ঘিক চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে . . .“দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ” (১৯৫৫), “প্লেসেস অফ হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার” (১৯৫৫), “সিজার্স”(১৯৬২), “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান” (১৯৬৩), পুণে ফিল্ম ইনসমটিটিউটের ভাইস প্রিন্সিপাল থাকার সময়ে করা“ফিয়ার” (১৯৬৫) এবং “রঁদেভু” (১৯৬৫), “সিভিল ডিফেন্স” (১৯৬৫), “সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো” (১৯৬৭), “ইয়েকওন” (হোয়াই / দ্য কোয়েশ্চন, ১৯৭০), “আমার লেলিন” (১৯৭০), “পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স অফপুরুলিয়া, ১৯৭০), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে “দুর্বার গতি পদ্মা” (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা, ১৯৭১) মিলনসাগরে,মুক্তিযুদ্ধের কবিতা গানের দেয়ালিকায় এই ছবিটি ।
লেখা কাহিনী ও চিত্রনাট্যের চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে . . .“মুসাফির” (১৯৫৭) ,“মধুমতী” (১৯৫৮), “স্বরলিপি” (১৯৬০), “কুমারী মন” (১৯৬২), “দ্বীপের নাম টিয়ারং”(১৯৬৩), “রাজকন্যা”(১৯৬৫), “হীরের প্রজাপতি” (১৯৬৮)।
অসমাপ্ত ছায়াছবি ও তথ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে . . .“বেদেনি” (১৯৫১), “কত অজানারে” (১৯৫৯), “বগলার বঙ্গদর্শন” (১৯৬৪-৬৫), “রঙের গোলাপ” (১৯৬৮),“রামকিঙ্কর” (১৯৭৫), “আদিবাসিয়োঁ কা জীবন স্রোত” (১৯৫৫)।
তার প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রেয়ছে . . .ভারত সরকারের ১৯৬৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মান। ১৯৫৭ সালে মুসাফির চলচ্চিত্রের জন্য ভারতের ৫ম জাতীয়চলচ্চিত্র পুরস্কারে তৃতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য সার্টিফেকেট অফ মেরিট। ১৯৫৯ সালে হিন্দী ছায়াছবিমধুমতী-এর জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। ১৯৭০ সালে “হীরের প্রজাপতি” চলচ্চিত্রের জন্যশিশুতোষ চলচ্চিত্র পুরস্কার, প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক। ১৯৭৪ সালে “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো” চলচ্চিত্রের জন্যশ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৭৪ সালে “তিতাস একটি নদীর নাম”চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালক বিভাগে বাচসাস পুরস্কার ।
বেলায়াত হোসেন মামুন তাঁর “বাঙালিত্বের অহঙ্কার ঋত্বিক কুমার ঘটক” প্রবন্ধে লিখেছেন .ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে আসার কথা ছিল না। তিনি অনেক কিছু হতে পারতেন। যে কোনোকিছু হয়ে ওঠার প্রতিভা, যোগ্যতা এবং সুযোগ তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি হলেন চিত্রস্রষ্টা। কিভাবে? শুনিতাঁর নিজের কথায় . . .“আমি প্রথমে কবিতা লিখতাম। তারপর গল্প-উপন্যাসের জগতে এলাম। কিন্তু চারপাশের বদমাইশির বিরুদ্ধেঅনেক চিৎকার আমার মনের মধ্যে সম্বিত দিলো। তখন ভাবলাম নাটকের মাধ্যমে মানুষের সামনে ঘটনা।
ছবি নিয়ে চর্চা করা হয় , ভারতীয় সিনেমায় তথাকথিত বাণিজ্য ভিত্তিক ছবির দর্শক সেকালেও বেশি ছিল একালেও তাইইই কিন্তু এরই মাঝে সাধারণ বাঙালি দর্শক যারা ভালো ছবি দেখতে পছন্দ করেন, করেন, সিনেমা কে দর্শন বা মতাদর্শ বলে মনে করেন তাদের কাছে এই নাম ঋত্বিক ধর্মের মতন।প্রথমে theatre দিয়ে শুরু করলেও পরের দিকে চলে আসেন celluloid জগৎ এ। সমসাময়িক পরিচালকের পরিচালক – সময় ছবি করলেও লক্ষ্যণীয় ভাবেই নিজস্ব মৌলিকতায় ভরপুর চলচ্চিত্র তৈরীর শৈলী ।প্রভাব বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী ইতালিও নয়া বাস্তবতা বা Italian Neo Realist ঘরানার ছবি গুলো। মূলত ৩ জন পরিচালক… Roberto Rosellini, Vittorio Di Sica ও Luccino Visconti হয়ে উঠলেন প্রথপ্রদর্শক… সারা বিশ্বের বিভিন্ন পরিচালক এর মতন এঁদের ছবি গুলি প্রভাব বিস্তার করলো ঋত্বিকের মনেও…. বাণিজ্য ভিত্তিক ছবির বিকল্প খুঁজে পেলেন এই মহান পরিচালক… সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরতে লাগলেন বিভিন্ন স্তরের মানুষের অবস্থা।আপনি কেন সিনেমা বানান? এমন উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি একেবারেই পাগল। সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের তো কিছু একটা করে বাঁচতে হয়, তাই না? তাই আমাকে সিনেমা করে বাঁচতে হয়। আসলেই তিনি ছিলেন পাগল। সিনেমার পাগল। শুধু বিনোদন না, তিনি সিনেমা বানাতেন মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে, তাদের অধিকার কি? গণমানুষের অধিকার আদায়ে, শোষণের বিরুদ্ধে শোষকের যন্ত্রণা ও তাদের ফুঁসে ওঠার চিত্র ফুটে উঠত তার সিনেমায়। তিনি বলতেন, সিনেমা আমার কাছে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার।
কিছু অজানা কিছু গল্প ছবি দিয়ে চাইছে না ঋত্বিক কুমার ঘটক প্রথম ছবি ‘অযান্ত্রিক’। তৈরী হয়েছিলো সুবোধ ঘোষের প্রথম ছোটগল্প ‘অযান্ত্রিক’ থেকে। একজন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক নিয়েই তৈরী এই সিনেমাটি।
সত্যজিৎ রায় এ ছবিটি দেখে ঋত্বিককে বলেছিলেন,‘ ঋত্বিকবাবু,সিনেমাটা সময় মত রিলিজ করলে আপনি পথিকৃৎ হতেন ’।‘চলচ্চিত্র সাহিত্য ও আমার ছবি’ নিবন্ধে ঋত্বিককুমার ঘটক ‘অযান্ত্রিক’ সম্পর্কে বলেছিলেন – “ কতখানি সার্থক হয়েছি সেটা আপনারা বলবেন-তবে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। সুবোধ বাবুর মূল বক্তব্যের প্রতি আমি চেষ্টা করেছি বিশ্বস্ত থাকতে। জানি না কতখানি কৃতকার্য হয়েছি।”
একই বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালেই ঋত্বিক মুক্তি দেন তার তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’। মূল গল্প শিবরাম চক্রবর্তীর। মূল চরিত্র কাঞ্চনের চোখ দিয়ে তৎকালীন কলকাতার বাস্তব চালচিত্র দেখা যায়।
এই চলচ্চিত্রে ঐ সময়ের নিম্নবিত্ত মানুষের অভাবের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়। সিনেমাটোগ্রাফিতে ডীপ ফোকাসের ব্যবহার লক্ষনীয়। এই সিনেমার সাথে ফ্রান্সের ন্যুভেল ভাগের বিখ্যাত সিনেমা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ (১৯৫৯) এর কাহিনীর সাদৃশ্য রয়েছে।
১৯৫৯ সালে ‘কত অজানারে’ নামের একটি সিনেমার কাজ অনেকদূর সম্পন্ন করেও অর্থনৈতিক কারণে সেটা আর শেষ করতে পারেননি । সাক্ষাতকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘মানুষের অবক্ষয় আমাকে আকর্ষণ করে। তার কারণ এর মধ্য দিয়ে আমি দেখি জীবনের গতিকে,স্বাস্থ্যকে। আমি বিশ্বাস করি জীবনের প্রবাহমানতায়। আমার ছবির চরিত্ররা চিৎকার করে বলে আমাকে বাঁচতে দাও। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে বাঁচতে চায়-এ তো মৃত্যু নয়,জীবনেরই জয় ঘোষণা।’
১৪ এপ্রিল,১৯৬০; কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের বাংলা ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মাধ্যমেই। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ঋত্বিকের চতুর্থ ছবি আর বক্স অফিসে তাঁর প্রথম সাফল্য। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের বার্ষিক চিত্রবীক্ষণ পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটক জানান, দেশবিভাগের পেক্ষাপটে নির্মিত মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) এই তিনটি চলচ্চিত্র মিলে ট্রিলজি নির্মিত হয়েছে।
তাঁর ভাষ্যে, ‘একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের দেখা হলো-এ ধরনের পুতু পুতু গল্পে আমার রুচি নেই। আমি আপনাদের ঘা দেব এবং বোঝাবো,এ কাহিনী কাল্পনিক নয়। বলবো,চোখের সামনে যা দেখছেন তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য,আমার বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করুন। যদি সচেতন হন এবং আমার উত্থাপিত প্রতিবাদটি উপলব্ধি করতে পারেন,তবে বাইরে বেরিয়ে বাস্তবকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন,তাহলেই স্বার্থক আমার ছবি করা।’
'মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্র সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক বলেন, “ ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নামটি আমার দেয়া, মূলগল্পটি ‘চেনামুখ’ নামে নামকরা একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটার ভেতর কিছু একটা ছিল যা আমাকে খোঁচা দিচ্ছিল, যে কারনে শেক্সপিয়রের ‘দ্য ক্লাউড ক্যাপড স্টার’ নামটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল এবং সাথে সাথে নতুন চিত্রনাট্য লেখায় হাত দিয়ে দিলাম ”।
মেঘে ঢাকা তারা’র মূল গল্পকার শক্তিপদ রাজগুরুর ভাষ্যমতে, “ সাত বছর আমি ঋত্বিকের সঙ্গে ঘর করেছি। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কুমারী মন’,‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে ছিলাম। পরে আমি অন্য কাজে মুম্বাই চলে যাই শক্তি সামন্তের কাছে। আমাদের একটা জমাটি টিম ছিল। কোমল গান্ধারের পর থেকে টিম ভাঙতে শুরু করে।”
এই সিনেমায় ঋত্বিক শব্দ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় হংসধ্বনি রাগ এবং এ রাগভিত্তিক খেয়াল ব্যবহার করেন সিনেমার আবহ সংগীত হিসেবে। ঋত্বিক প্রথমবারের মত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন এই ছবিতে,এছাড়াও বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। ভারতের এক জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার সাম্পতিক জরিপে প্রকাশ যে,নীতার মুখে এ ছবির সংলাপ ‘দাদা,আমি বাঁচতে চাই’ বাংলা ছবির সবচেয়ে প্রচলিত সংলাপ। ঋত্বিক ঘটকের এই সিনেমায় ভারত বিভাজনের সেই করুণ সময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সর্বোচ্চ চর্চিত এই সিনেমাটি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ট ধ্রুপদী সিনেমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ চলচ্চিত্র বিষয়ক মাসিক সাময়িকীতে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এটি ২৩১ নম্বরে অবস্থান পেয়েছে।
তিনি নিজের ভাষায়, ‘বাংলা ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহন করতে পারিনি– আজও পারিনা। ইতিহাসে যা হয়ে গেছে তা পাল্টানো ভীষন মুশকিল, সেটা আমার কাজও নয়। সাংস্কৃতিক মিলনের পথে যে বাধা, যে ছেদ,যার মধ্যে রাজনীতি-অর্থনীতি সবই এসে পড়ে, সেটাই আমাকে প্রচন্ড ব্যথা দিয়েছিল’।
যে সাংস্কৃতিক মিলনের কথা তিনি বলেছেন সেটা তিনি চিত্রায়ণ করেছিলেন তাঁর পরের সিনেমাতে যার নাম ‘কোমল গান্ধার’। ‘কোমল গান্ধার’ চলচ্চিত্রের নির্মানসাল ১৯৬১। উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ বিশেষ। এই রাগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই সিনেমার এই নামকরণ। এ ছবির মূলসুর দুই বাংলার মিলনের। এই ছবিতে দুইটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’ গানটি ব্যবহার করেন,এছাড়াও বিয়ের প্রাচীন সুরের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
‘কোমল গান্ধার’ যেমন সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলে,তেমনভাবে তিনি পরের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ বর্ণনা করে দেশভাগের কুফলসমূহ। ১৯৬২ সালে তৈরী হলেও মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ঋত্বিক তিনটি প্রজন্মের গল্প বলেছেন এই সিনেমাতে। প্রথম প্রজন্ম ঈশ্বর, হরপ্রসাদ। দ্বিতীয় প্রজন্ম সীতা,অভিরাম। তৃতীয় প্রজন্ম বিনু। দেশভাগ ও তার ফলাফলের কারণে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে প্রথম দুইটি প্রজন্মের স্বপ্ন-আকাঙ্খা। তৃতীয় প্রজন্ম মাত্র তাঁর যাত্রা শুরু করেছে,তাঁর ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা আমরা জানি না।তবে তিনি চেয়েছিলেন যেন তা সুন্দর হয়,তাই সিনেমার শেষে লিখে দিয়েছিলেন,‘জয় হোক মানুষের,ওই নবজাতকের,ওই চিরজীবিতের’।
এই ট্রিলজিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি বড় ভূমিকা আছে। একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া আমি কিছুই প্রকাশ করতে পারি না। আমার জন্মের অনেক আগেই তিনি আমার সমস্ত অনুভূতি জড়ো করে ফেলেছিলেন। তিনি আমাকে বুঝেছিলেন এবং সেসব লিখেও ফেলেছিলেন। আমি যখন তাঁর লেখা পড়ি তখন আমার মনে হয় যে সবকিছুই বলা হয়ে গেছে এবং নতুন করে আমার আর কিছুই বলার নেই’।
১৯৬২ সালে বানালেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সিজর্স’ ও ১৯৬৩ সালে ডকুমেন্টরী ‘ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান’। এই সময় ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ নামে একটি সিনেমার কাজ শুরু করলেও আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৬৫ সালের দিকে বাংলা মদ ধরলেন তাঁর এমন জীবনযাত্রার ফলে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হলেন। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। সালের দিকে ঋত্বিক পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন, দু’বছর কাজ করেছেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন আরও ৩ মাস। এখানে শিক্ষকতা করার সময় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত ‘ফিয়ার’ ও ‘রঁদেভূ’ নামের দুইটি সিনেমার সাথে যুক্ত ছিলেন।
তার এই শিক্ষকতা জীবনকে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের উপরেই স্থান দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি মনে করি,আমার জীবনে যে সামান্য কয়েকটি ছবি করেছি সেগুলো যদি পাল্লার একদিকে রাখা হয়,আর মাস্টারি যদি আরেক দিকে রাখা হয় তবে মাস্টারিটাই ওজনে অনেক বেশি হবে। কারণ কাশ্মীর থেকে কেরালা,মাদ্রাজ থেকে আসাম পর্যন্ত সর্বত্র আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আজকে ছড়িয়ে গেছে। তাদের জন্য আমি যে সামান্য অবদান রাখতে পেরেছি সেটা আমার নিজের সিনেমা বানানোর থেকেও বেশী গুরুপ্তপূর্ণ’।
ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই সময়কালে কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে না পারলেও তিনি কিছু তথ্যচিত্র ও শর্টফিল্মের কাজ করেন। এর মধ্যে আছে, সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো(১৯৬৭),ইয়ে কিঁউ(১৯৭০),পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য নিয়ে পুরুলিয়ার ছৌ(১৯৭০), লেনিনের ১০০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার লেনিন(১৯৭০),বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দূর্বার গতি পদ্মা(১৯৭১) এবং আরও পরে ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে তথ্যচিত্র রামকিঙ্কর(১৯৭৫,অসমাপ্ত)।
এ চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহের কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন -
"এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী,আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো,সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল।" … অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে,ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন,তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুনর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে,মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক,তিতাস নায়িকা’।
এই চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে দেখা যায়,চরে গজিয়ে ওঠা নতুন ঘাসের মধ্যে দিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে একটি শিশু। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়। ঋত্বিকের ভাষায়, ‘একটি সভ্যতাকে কি চিরতরে ধ্বংস করে ফেলা যায়? না, যায় না। এর শুধু রূপান্তর ঘটে। এটাই আমি এই ফিল্মের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলাম’।
ছবিটিতে বাংলাদেশের তখনকার তরুণী নায়িকা কবরীকে চরিত্রের প্রয়োজনে বলতে গেলে একেবারে ভেঙ্গেই গড়েছিলেন ঋত্বিক। ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন বাংলাদেশের শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র।
ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রবীর মিত্র এভাবেই বলেন, ‘এই মাকড়া, এই ছোঁড়া এদিকে আয়, এই সব বলেই তিনি(ঋত্বিক) আমাকে ডাকতেন। কখনোই আমার নাম ধরে ডাকতেন না। বলতেন,এডিটিংয়ের সময় তুই আসিস। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি কিছুই বলেন না। কাজের ভেতরেই ডুবে থাকেন। মুখ তুলেন না। ঋত্বিক-দা চলে গেলেন। তার না-বলা কথাটা আমার আর শোনা হয়নি।’
২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা দর্শক,চলচ্চিত্র সমালোচকদের ভোটে এ চলচ্চিত্রটি সেরা বাংলাদেশী ছবির মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে।
ঋত্বিকের মূল্যায়ন, ‘আমি ছাড়া তিতাস হতো না। তিতাস ছিলো আমার স্বপ্ন। আমার মতো মমতা নিয়ে এই কাহিনীকে কেউ তুলে ধরতে আগ্রহী হতেন না’।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল চরিত্র একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচী,যে তাঁর বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগ,রাজনৈতিক পরিস্থিতি,১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সময়ের একটি নির্মোহ-নির্মম সমালোচনাও বটে। সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাঁকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনার কথা,নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে তখন চরম উপহাস,”ভাবো,ভাবো,ভাবা প্র্যাক্টিস করো। ”
এই ছবির ব্যাপারে ঋত্বিক বলেন, ‘১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমি যেমনটি দেখেছি, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে আমি ঠিক সেটাই দেখাতে চেয়েছি।
মাত্র দুইদিনে ঋত্বিক ঘটক এ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঋত্বিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত ছবিতে নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্র জগতে আসার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাঁর মেজদা (সুধীশ ঘটক) ছিলেন ‘টেলিভিশন এক্সপার্ট’। তিনি গ্রেটব্রিটেনে ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছ’বছর কাজ করেন। পরে সুধীশবাবু নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন। বহু ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি,তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাননবালা-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। বাড়িতে আসতেন বড়ুয়াসাহেব থেকে বিমল রায় পর্যন্ত অনেকেই। আর পাঁচজন যেমন ওঁদের ছবি দেখেন তেমনই ঋত্বিক ওই সব ছবি দখে বিশেষ উৎসাহ পেতেন। কারণ দাদার সঙ্গে তাঁদের আড্ডা চলতো বাড়িতেই।
সমাপ্ত
