রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্গীকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্গীকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্গীকার
শ্যামল চক্রবর্ত্তী সবুজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা দর্শন ও কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ স্বনির্ভরতা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন অনবদ্য সৃষ্টি। হস্ত শিল্পের মাধ্যমে ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তোলা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থনৈতিক ধারণা মূলত সহযোগিতা, গ্রামীণ উন্নয়নের উপর কেন্দ্র করে গঠিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নতিও গ্রামের মানুষের জন্য অপরিহার্য। লিওনার্ড এলমহার্স্ট সত্যিই শ্রীনিকেতনের কাজে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর কৃষি অর্থনীতি এবং গ্রামীণ উন্নয়নের জ্ঞান শ্রীনিকেতনের কাজকে নতুন দিশা দিয়েছিল। ইনস্টিটিউট অফ রুরাল রিকনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহে সাহায্য নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
এখন আসা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষি ও হস্তশিল্পে বিশেষ জোর দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে গ্রামীণ ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য কৃষি এবং হস্তশিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের মানুষ যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারে। কৃষিকাজ এবং হস্তশিল্প গ্রামের মানুষকে জীবিকা অর্জনের সুযোগ করে দেয় এবং তাদের অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমায়। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হতে পারে। শুধু তাই নয়, হস্তশিল্প শুধু অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নয়, এটি গ্রামীণ সংস্কৃতিরও ধারক ও বাহক। বিভিন্ন অঞ্চলের হস্তশিল্প সেখানকার ঐতিহ্য, কারিগরি দক্ষতা এবং জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটায়। তাইতো তিনি ঐতিহ্যগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন। হস্তশিল্পের কাজের মধ্যে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে। যখন গ্রামের মানুষ নিজের হাতে সুন্দর জিনিস তৈরি করে, তখন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়ে। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে, যেটা হস্তশিল্প সেই সুযোগ করে দেয়।
কৃষিকাজ মানুষকে সরাসরি প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলে, মানুষের মন ও শরীর সুস্থ থাকে এবং জীবনের প্রতি এক গভীর উপলব্ধি জন্মায়।
শিক্ষাদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। কৃষি ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সরাসরি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজে লাগে, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
সর্বোপরি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। তিনি গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটি holistic বা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং ব্যবহারিক দক্ষতা – এই সবকিছুই সমান গুরুত্ব পায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন এই আদর্শেরই প্রতিফলন। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যা শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ না রেখে তাদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকাশে সাহায্য করবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য সেই সময়ে ৮ হাজার পাউল।এই পুরস্কারের অর্থ তিনি মূলত দুটি প্রধান সামাজিক কার্যক্রমে ব্যয় করেছিলেন শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় যা ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে প্রকৃতি ও শিল্পের সান্নিধ্যে শিক্ষাদান করা হতো। নোবেল পুরস্কারের একটি বড় অংশ এই বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের বেতন প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই বিদ্যালয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জমিদারির প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ১৯০৬ সালে প্রতিসার কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের ১২% সুদে জামিনবিহীন ঋণ দেওয়া হতো। তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ এই ব্যাংকের মূলধন হিসেবে জমা করেছিলেন। যদিও ব্যাংকটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি কারণ দরিদ্র কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি, তবে এটি রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতি আগ্রহ এবং দরিদ্রদের সাহায্য করার ইচ্ছাকে স্পষ্ট করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি। কৃষকদের মহাজনের ঋণের কবল থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যেমন পতিসরের কৃষি ব্যাংক।
এই ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হতো, যাতে তারা বীজ, সার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে এবং তাদের ফসলের উন্নতি ঘটাতে পারে।
তিনি কৃষকদের আধুনিক চাষ পদ্ধতির বিষয়ে জ্ঞানদান এবং সমবায় farming-এর মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে কাজ করার উৎসাহ দিতেন, যাতে তারা বৃহত্তর পরিসরে সুবিধা লাভ করতে পারে।
গ্রাম উন্নয়ন ও অন্যান্য উদ্যোগ:
রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়নের ধারণা শুধু কৃষির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গ্রামের সার্বিক উন্নতির উপর জোর দিতেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা ছাড়া গ্রামের মানুষের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি শান্তিনিকেতনে একটি আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে প্রকৃতি ও শিল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হতো।
গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নতির দিকেও তাঁর নজর ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করার গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করতেন। এটি সম্ভবত তাঁর সামগ্রিক গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ ছিল।
্ রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের প্রসারের উপর জোর দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষ বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করতে পারত।
গ্রাম উন্নয়নের vision ছিল একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা, যেখানে কৃষি ঋণের মাধ্যমে কৃষকদের স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং পরিকাঠামোর উন্নতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অবশ্যই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষকদের আধুনিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান দান এবং সমবায় পদ্ধতির প্রসারে বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন। তবে,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপলব্ধি করেছিলেন যে চিরাচরিত প্রথায় চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং বন্ধু সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের অর্জিত জ্ঞান শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতন-এ কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
শুধু তাই নয় শ্রীনিকেতনে একটি কৃষি বিভাগ খোলা হয়েছিল, যেখানে কৃষকদের উন্নত বীজ, সার ব্যবহার এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি (যেমন ট্রাক্টর) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ক্ষেত্রবিশেষে মাটি পরীক্ষা করার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ নিজে বিভিন্ন কৃষি খামার তৈরি করেছিলেন এবং সেখানে নতুন নতুন ফসল (যেমন আমেরিকান ভুট্টা, মাদ্রাজ থেকে আনা ধান) ফলানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে সমবায়ের মাধ্যমেই দরিদ্র কৃষকরা একত্রিত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারবে।
শ্রীনিকেতনেও বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেমন ধানের গোলা, তাঁতিদের সমবায় ইত্যাদি। এর উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের এবং গ্রামীণ কারিগরদের উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা করা। সমবায় ভাবনার মূলে ছিল ঐক্য ও পারস্পরিক সহায়তার নীতি। তিনি মনে করতেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গ্রামের মানুষ দারিদ্র্য দূর করতে পারবে।
পরবর্তীতে, লিওনার্ড এলমহার্স্ট নামে একজন ব্রিটিশ কৃষি অর্থনীতিবিদ শ্রীনিকেতনের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল, যা শ্রীনিকেতনের কাজকে আরও গতি দিয়েছিল। এলমহার্স্ট শ্রীনিকেতনের ইনস্টিটিউট অফ রুরাল রিকনস্ট্রাকশন (Institute of Rural Reconstruction) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং কিছু আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়।
তবে, রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও সমবায় উদ্যোগ সম্পূর্ণরূপে বিদেশী সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিল না। এটি ছিল তাঁর নিজস্ব চিন্তা ও দর্শনের ফসল, যা তিনি তাঁর জমিদারির অভিজ্ঞতা এবং মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। বিদেশী জ্ঞান ও প্রযুক্তি অবশ্যই তাঁর উদ্যোগকে সমৃদ্ধ করেছিল, কিন্তু এর মূল ভিত্তি ছিল স্থানীয় সম্পদ ও মানুষের অংশগ্রহণ।
সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষকদের আধুনিক চাষ পদ্ধতির জ্ঞান দান এবং সমবায় পদ্ধতির প্রসারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে তিনি বিদেশী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করেছিলেন। তবে, এই উদ্যোগগুলির মূল চালিকাশক্তি ছিল তাঁর নিজস্ব vision এবং গ্রামীণ মানুষের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার।
. । সমাপ্ত
