গিনিপিগ
গিনিপিগ
এত গাঢ় অন্ধকার আগে কখনো দেখনি .পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি আর ভাবছি জীবন শেষে গন্তব্যে পৌঁছবো তো ?চোখের দু কোল দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে আর সব কিছু যেন ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে . যাদের চিনতাম তারা অনেক দিন ছেড়ে গেছেন. যাদের চিনিনা বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম তাদের সঙ্গেও অনেক পথ হেঁটেছি কিন্তু এই পরীক্ষা টা কিছু অন্য ,এই রাস্তায় কেউ সঙ্গ দেওয়ার নেই ,শুধু একলা একরাশি আলোর জন্যে কত দিন ধরে যে হাটছি জানিনা . মাঝে মধ্যে পিপাসা পায়,গলা চিৎকার করে : কেউ আছেন? যদি থাকেন আমার সঙ্গে পা মেলাবেন ,কে জানে সূর্যোদয় টা একসঙ্গে উপভোগ করতে পারি . কিন্তু কোনো মানুষের সাড়াশব্দ পাই না ,শুধু ঝিঝির ডাক কানে আসে আর একটা ভ্যাপসা গন্ধ . বুক পকেটে একটা ছেড়া ডায়েরি আছে বটে কিন্তু কলম এর কালী অনেক দিন শেষ হয়ে গেছে, মাঝে বয়স টা হয়েছে টের পাচ্ছি ,ঠিক মতন দৌড়োতে পারছি না . মন টাও বলে যাচ্ছে এই অন্ধকার আর থাকবে না ,থাকতে পারে না .এই সুপ্ত মানবহীন শহর সূর্যরাশী তে স্নান করবেই .আলোর ঠিকানা ঠিক পাওয়া যাবেই ..
সকালে ঘুম ভাঙলে অনুমান করতে পারি যে কোন এক অজানা পথে হয়তো বেরিয়ে পড়তে হবে ,মাঝরাতের স্বপ্ন বলে কথা . দেখলাম সেন্টার টেবিল এ টিপটে চা আর আমার প্রিয় সিঙাড়া রাখা আছে সঙ্গে আজকের খবরের কাগজ .কিছু টা হিসেব নিকেশ করে বুঝতে পারলাম তিন মাস কেটে গেছে .আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখে অবাক হলাম ,দাড়ি বেড়ে গেছে ,চুল এলো মেলো ,ঠিক নিজেকে চিনতে পারলাম না .ভাবলাম চান টা করে এলে মন্দ হয় না তার পর না হয় চায়ে চুমুক দেওয়া যাবে .চান শেষে যখন খবরের কাগজ নিয়ে বসলাম ঘড়িতে বাজে সকাল ১১.৩০ .চার নম্বর পেজের একটা কলাম এ আমার ছবি ছাপা আর লেখা আমি নিরুদ্দেশ .শত চেষ্টা সত্ত্বেও ১১ এ ২ করতে পারলাম না . স্মৃতি তে জোর দিয়ে মনে করতে চাইলাম আজ থেকে তিন মাস আগে আমি তো ডাক্তার রায় এর চেম্বার এ গেছিলাম আর উনি বলেছিলেন আর্লি signs অফ alzhimers . সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে .ওনার চেম্বার থেকে তো আমার ঘরে ফেরার কথা . আর যে গল্প টা আমি স্টোরি কম্পেটিশন এ দিয়েছিলাম সেটার ও কি হলো ?.নিজের ল্যাপটপ টা খুললাম. পাসওয়ার্ড টা যেন কি ছিল ? আমার নাম ই হবে .ডায়েরি র ছেড়া পাতায় নাম টা পেয়ে এই যাত্রায় রক্ষা হলো . দেখি আমার লেখা বই তে ছাপা হয়েছে ,আমার গান রেকর্ডিং হয়েছে কিন্তু তাহলে আমার মনে নেই কেন? কিন্তু সব কিছু তিন মাস আগে হয়ে গাছে .তাহলে কি এই তিন মাসে আমি কিছুই করিনি? অফিস যায়নি ,গল্প লিখিনি ,গান গাইনি তাহলে করেছি টা কি ? নাম কি জানিনা ,কাজ কি জানিনা ,কোথায় থাকি জানিনা এতো বেশ মুস্কিলে পড়া গেলো . আমার সঙ্গে কেউ নেই কেন ? মনে করার চেষ্টা করতে বাবা -মার মুখটা মনে পড়লো . মাথায় ব্যাথা অনুভব করছি তাই এক কাপ চা নিজেই বানিয়ে আবার ল্যাপটপ এর সাথে বসে পড়লাম.আমার তো অপেরা হাউস এ ম্যাজিক শো এ যাওয়ার কথা ছিল ,আমি গেছিলাম ও .হটাৎ ম্যাজিসিয়ান আমাকে এক টা বাক্সে ঢুকিয়ে দরজা টা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তার পর আর কিছু মনে নেই .রাস্তায় বেরোতে পাড়ার মোড়ে আমাকে দেখে এক ভদ্রলোক আমাকে একটা মিষ্টি নাম এ ডাকলেন . যাক নাম টা উদ্ধার করতে পেরেছি.সবজি বাজারের কাছ দিয়ে যেতেই এক সবজিওয়ালা এক থলি সবজি দিয়ে বললে ঘরে নিয়ে যান বাবু ,আপনি তো আসেন ই না .মুদি দোকানদার ফর্দ ছাড়াই আমাকে সব জিনিস গুছিয়ে দেয় কিন্তু আমার কাছে কিছু চায় না .আমাকে অবাক করে এত লোক আমাকে চেনে কি করে ? লেখার জন্যে ,গানের জন্যে,কাজের জন্যে না কি অন্য কিছু . আমার মাথা টা ঝিম-ঝিম করলে আমি রাস্তায় পড়ে যাই ,রাস্তার লোকেরা পরম যতনে আমাকে ঘরে নিয়ে আসে .আমার মনে হলো সবাই সব কিছু জানে কিন্তু আমি কিছুই জানি না .হটাৎ কেউ চিৎকার করে আমায় বলে এই ঘুম থেকে বেরিয়ে আসুন নাতো বড় দেরি হয়ে যাবে . তখন দেখি আমি আলোর সমুদ্রে ভাসছি ,ম্যাজিক শেষে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ,আমার গিনিপিগ হওয়ার দিন শেষ আর কিছু মনে থাকুক বা না থাকুক আজকের দিন টা ভোলার নয় !
