একটি মেঘলা দিন
একটি মেঘলা দিন
আজ জুন মাসের প্রথম শুক্রবার। দুই পক্ষকাল দাপুটে ব্যাটিংয়ের পর কলকাতা আজ ছুটি দিয়েছে সুয্যিদেবতাকে। মরসুমের প্রথম ধারাপাতে সম্পূর্ণ ভাবে সিক্ত কল্লোলিনী তিলোত্তমা। মধ্যরাতের ক্ষনিকের অতিথি রূপে নয়, বরং বজ্র-বিদ্যুৎ ও ঝোড়ো হাওয়া সহযোগে বর্ষা বেশ সগৌরবে জানান দিয়েছে তার দীর্ঘকালীন উপস্থিতি। এমনধারা দস্যিপনায় একদিনেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে শহরজুড়ে। একাকার হয়ে যাচ্ছে পথ -ঘাট,খানা-খন্দ ,এপাড়া-বেপাড়া ,গলি-রাজপথ। আকাশের অবিরাম ক্যাকাফোনি স্তব্ধ করে রেখেছে রোজকার যাবতীয় নাগরিক ব্যস্ততাকে।কলকাতা বলা যেতে পারে আজ এক নদীর নাম। বেলা গড়ালেও অবাধ্য ঘড়ির কাঁটা ছাড়া সেটি আর মালুম হচ্ছে না কিছুতেই। নাছোড় বৃষ্টিকে কাঠগড়ায় তুলে অফিসে অফিসে গড়হাজিরার পারদ আজ উর্ধমুখী। বাজার করার ঝক্কি বা অফিসের ব্যস্ততাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো এমন হঠাৎ সপ্তাহান্তের ছুটিতে জমিয়ে চলছে কলকাতার বাবুবিলাস। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে খিচুড়ির আয়োজন।
কিন্নরীর পৈতৃক বাড়িটা কুমোরটুলির পুরোনো পাড়ায়, গঙ্গার পাড় ঘেঁষে , বড় গলির একেবারে শেষ মাথায়। সূর্য্যের আলো বছরভর কার্পণ্য করলেও বৃষ্টি কিন্তু আজ রেয়াত করেনি তাদের এই গলিপথটিকেও। সাতটা বেজেছে অনেকক্ষন হলো। কিন্তু আকাশের মুখ দেখে বোঝার জো নেই কিচ্ছুটি। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে দেখে জানলাটা খুলে দিল কিন্নরী। একমুঠো জোলো দমকা হাওয়া ছাড়া পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘরের মধ্যে। কিন্নরী চটপট দাদার স্টাডি টেবিলটা সরিয়ে দিলো জানলার ধার থেকে। তারপর চিবুক রেখে দাঁড়ালো জানলার ধারে রোজকার মতো।
মিনিট দশেক পর থেকে আবার বাড়তে থাকলো বৃষ্টির দাপট। বৃষ্টির ছাঁটে আসতে আসতে ভিজে যেতে লাগলো কিন্নরীর কপাল,হাতের আঙ্গুল, চোখের কোল। ভারী হয়ে আসতে লাগলো চোখের পাতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ সিক্ত হয়ে উঠলো সে। কপালে লেপ্টে আছে বৃষ্টিধোঁয়া চুল,খোলা পিঠে জমে উঠেছে মুক্তোর মতো জলের আলপনা। যেনো বহুদিন পরে এমনভাবে আদর করছে কেউ তাকে,ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর মন-হোক না সে খেয়ালিবৃষ্টি, হোক না ভেজা হাওয়া। তার উষর শরীরে বহুদিন পর এমন করে প্রাণ সঞ্চার হলো I বৃষ্টির তোড়ে ধীরে ধীরে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে জমে থাকা সমস্ত তাপ , পালকের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে মন। মনে-প্রাণে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে খানিক বাদে আস্তে আস্তে চোখ খুললো কিন্নরী।
দূর থেকে দেখতে পেলো ট্রাম লাইন পেরিয়ে গলির দিকে ছুঁটে আসছে ছেলেটা, প্রতিদিনের মতোই। রোজই ছেলেটাকে দেখবে বলে এই সময় কিন্নরী সব কাজ ফেলে দাঁড়ায় জানলার ধারে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কিন্নরী জানতো ঠিক আসবে সে, হোক না আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি,তাতে কি। মায়ের মন জানে ছোটোরা বৃষ্টি কতটা ভালোবাসে , রুপুও তো ভালোবাসতো খুব। প্যাস্টেল ঘষে ঘষে বর্ষার ছবি আঁকতো, জমা জলে কাগজের পাতা ছিঁড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজের নৌকো ভাসাতো , বৃষ্টি বেশি হলে স্কুলে যেতে বেশি মজা পেতো , পাতা ভরিয়ে লিখতো প্রিয় ঋতু বর্ষা নিয়ে রচনা। এমন আরো কত কি মিষ্টি স্মৃতি। অবাধ্য বর্ষা আর দামাল শৈশব -এই দুয়ে যে আড়ি হতেই পারে না কখনো।
align-justify">জানলা দিয়ে আরেকটু ঝুঁকে দেখতে লাগলো কিন্নরী।সরু গলি ধরে জল ভেঙে ছুঁটতে ছুঁটতে আসছে ছেলেটা। কতই বা বয়স হবে ? খুব বেশি হলে এই আট কি নয়! বছর দুই আগে ঠিক এই বয়সেই তো রুপু চলে গিয়েছিলো কোল খালি করে। এমন করেই তো রুপু প্রতিদিন স্কুলের শেষে ছুঁটে ছুঁটে আসতো তার কোলে, জড়িয়ে ধরতো তাকে, তারপরেই জুড়তো নিত্যনতুন আগডুম-বাগডুম বায়না। কিন্নরী সেদিনও তো ঠিক এই ভাবেই তার গোয়াবাগানের বাড়ির বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল রুপুর অপেক্ষায় আর মোড়ের মাথায় স্কুল বাস থেকে নেমে রুপু বাড়ি আসছিলো, এই ছেলেটার মতোই, ঠিক এই ভাবে, এক ছুটে রাস্তা পেরিয়ে, শম্ভুর চায়ের দোকান পেরিয়ে , ব্যানার্জিদের রোয়াক পেরিয়ে, গলি পে..রি..য়ে ...না... পার হতে পারলো কই। মুহূর্তের অসতর্কতা আর গলির শেষ মাথায় একটা খোলা ম্যানহোল চিরতরে গিলে নিলো রুপুকে রূপকথার দৈত্যের মতো।
তারপর এই ক' বছরে বদলে গেছে সবকিছু। আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি কিন্নরী। প্রণব জানে আর কখনো মা হওয়া হবে না কিন্নরীর। বাকি জীবনটা কিন্নরীকে সুস্থ রাখার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মতো গোয়াবাগানের বাস তুলে কিন্নরীকে নিয়ে এসেছে কুমোরটুলিতে, তার বাপের বাড়িতে। সেও প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলো। কিন্নরীর সাদা-কালো প্রতিদিনের জীবনে এই সকালটুকুই রঙিনশুধু।
দুর্যোগ মাথায় করে আজও সাইকেলটা মেন রোডে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে কাগজের গোছা বগলে চেপে ছুঁটে আসছে সেই ছেলেটা। দূর থেকে দেখতে দেখতে মনে ভ্রম হয় যেন কোন মানুষ নয়, বরং কোনো শিল্পীর নিখুঁত হাতে গড়া কষ্টিপাথরের মূর্তি।
ছেলেটা দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা বাড়ি, মাথায় ধরা ছেঁড়া প্লাস্টিক, হাতে কাগজের গোছা থেকে জল বাঁচিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে একটা একটা কাগজ কোনো বাড়ির বারান্দায়, কোনো বাড়ির জানলায়, কোনটা আবার গুঁজে দিচ্ছে কোনো বাড়ির রেলিঙে বা দরজার ফাঁকে । গলির শেষ মাথায় কিন্নরীর বাপের বাড়ির সামনে পৌঁছতে এখনো অনেকটা পথ বাকি। অঝোর ধারায় ঝাপসা চশমার কাঁচে কখনো হারিয়ে যাচ্ছে অক্লান্ত ছোট্ট শরীরটা, মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির সাথে ,আবার কখনো মাটি ফুঁড়ে ছুঁটে আসছে , পরের মহূর্তেই যেন আবার মিশে যাচ্ছে জলের সাথে, ঠিক যেমন করে প্রতি বর্ষায় ধুঁয়ে-মুছে যায় সামনে বটতলায় রাখা মাটির দেব-দেবীর মূর্তি। বর্ষা গেলে সেই পুরোনো মাটির তালে লাগে নতুন শিল্পের ছোঁয়া,পাল্টে যায় ছাঁচ, ছেনি-বাঁটালির আঘাতে আর বছরের মা শীতলা হয়ে ওঠেন এবছরের মা লক্ষ্মীর অপরূপ মূর্তি। এও যেন ঠিক তেমন। ছুটতে ছুটতে ছেলেটি যত এগিয়ে আসছে তত যেন ধুঁয়ে মুছে নতুন করে ধরা দিচ্ছে নিজেকে, এ ছেলেতো তাঁর চেনা, সেই এক মুখ, সেই এক হাসি ,এ যে তার নাড়ি -ছেঁড়া প্রাণের ধন-রুপু। দিগ্বিদিগশূন্য হয়ে পাগলের মতো ছুঁটে আসছে- গলি পেরিয়ে , লক্ষ-যোজন পথ পেরিয়ে ,মহাকাল পেরিয়ে, জগৎ-সংসার পেরিয়ে । পায়ের নিচ থেকে সরে সরে যাচ্ছে পথ-ঘাট, ঘটমান-বর্তমান , মুছে যাচ্ছে সময়ের বেড়াজাল। আসতে আসতে শেষ হয়ে আসছে গলিটা।সামনে দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে বহুকালের তৃষিত মাতৃ-হৃদয়। আর কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা-তারপর.......কিন্নরীকে চমকে দিয়ে রোজকার মতো জানলার ফাঁক গলে অব্যর্থ টিপে ঘরের মেঝেতে এসে পড়লো রোল করে গোটানো জিনিসখানা আর নিচ থেকে ডেকে উঠলো ছেলেটা- ' কাকিমা.... আজকের কাগজ '।