একটি গাছ একটি প্রান
একটি গাছ একটি প্রান
"কাল কেউ বিশেষ কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বেড়োবেন না।পরিত্যক্ত বাড়ির থেকে সবাই সাবধান,আপনাদের জন্য স্কুল বাড়িতে থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছে।নিজ নিজ এলাকার পার্টি অফিসে যোগাযোগ করে চলে যান সবাই।আমাদের স্বেচ্ছাসেবক সংস্হার পক্ষ থেকে খাবার,পানীয়,ওষুধের ব্যবস্হায় সদা তৎপর থাকবো। কাল ফণীর দাপট ধেয়ে আসছে।অযথা কেউ আতঙ্কিত হবেন না।সবার সুস্হতা কামনা করি "......
একটি ছোট বাচ্চা মাঝে মাঝেই শুনছে টহলদারী গাড়ি থেকে ভেসে আসা এই সব উক্তি।দুদিন ওদের স্কুলও ছুটি দিয়েছে।ওর পাপারও নাকি অফিস ছুটি।ব্যাপারটা ও জানে একটা ঝড় আসছে।সেটার জন্য এতো ভয় কেন সেটা ও বুঝতে পারছে না।সেদিনও তো স্কুল থেকে আসতে গিয়ে দাদুর সাথে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলো,তারপর একপশলা বৃষ্টি নেমে ঝড় থেমে গেলো।সেদিন তো কেউ ভয় পায়নি!আজ এতো ভয় কিসের সবার? ছোট ছেলেটার ছোট্ট মাথায় কিছুতেই তা ঢুকছে না।মনে একরাশ প্রশ্ন রেখে সে দৌড়ে গেলো তার দাদুভাইয়ের ঘরে,গিয়ে পাশে বসে নজর গেলো টিভির দিকে.....
টিভিতে পুরীর উত্তাল সমুদ্র,ঝড়ের দাপটের ভিডিও ক্লিপ দেখানো শুরু হয়ে গেছে।এর আগের দিনই দেখেছে সবাই পুরী থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।সব গাছপালা ভেঙে পরার মত দশা।ঘণ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে।কাঁচের জানলাগুলো প্রচন্ড শব্দে ভেঙে পড়ছে।বাড়ির টিনের চালগুলো খোলার মত উড়ে চলে যাচ্ছে।ছোট ছেলেটা এসব দেখে ভীত হচ্ছে আর নিজেদের ঘরের জানলাগুলো দেখছে।ও মাঝে মাঝে মালতী পিপির(বাড়ির কাজের মেয়ে) বাড়ি যায়, সেটাও তো এরকম টিনের চাল।কি হবে যদি উড়ে যায় ওদের?এসব ভেবে দাদুভাইয়ের কোলের ওপর বসে ভয়ে চোখটা বন্ধ করে বুকে মুখটা গুঁজে প্রশ্ন করলো......
"দাদুভাই,ঝড় কি করে হয়?সবাই এতো ভয় পাচ্ছে কেন?কি হবে ফণী এলে"?
নাতির প্রশ্ন শুনে একটা বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন "প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে দাদুভাই,অনেক মানুষের ক্ষতি হবে,জীবনহানি ঘটবে।খুব ভয়ের,দুঃখজনক পরিস্হিতির মোকাবিলা করতে হবে আমাদের সবাইকে।তোমার ছোট মাথায় এত ঢুকবে না সোনা"।
"বলো না দাদুভাই ঝড় কেন হয়"?
নাছোড়বান্দা নাতির প্রশ্নের জবাব দিতে দাদুভাই বলতে লাগলেন একটা গল্প।সহজভাবে যাতে ও ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
"তবে শোন দাদুভাই একটা গল্প বলি,এটা শুনলে বুঝতে পারবে ঝড় কেন হয়"?
এক রাজ্য ছিলো।রাজ্যের চারিদিক ছিল ফুলে ফলে ভরা গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ।সেইখানে ছিলেন এক বনদেবী।গাছেদের 'মা' ছিলেন তিনি।সেই রাজ্যের সবাই খুব সুখেতে বাস করতো।গরীব মানুষ থেকে পশু-পাখী কারোর খাবারের অভাব হতো না। এই বিশাল বনের মধ্যে সকলের আহারের ব্যবস্হা হয়ে যেত।প্রচুর গাছ-গাছালি থেকে কবিরাজ মানে সে যুগের ডাক্তাররা ওষুধ তৈরী করে মানুষের প্রান বাঁচাতেন।মানে এই অরন্যটাই ছিলো মানুষদের বাঁচার একমাত্র পথ।সবার সুখে একদিন ভাঁটা দিতে বণিক সম্প্রদায়ের কিছু লোক সেই বনটার দিকে নজর দিলো।দামী দামী শাল-সেগুন-চন্দনের বড় বড় গাছ গুলো কেটে
বিক্রি করলে প্রচুর টাকার মালিক হবেন এই ভেবে তাঁরা প্রতিদিন একটা করে গাছ কাটতে শুরু করলেন।কথাটা বনদেবীর কানে যখন পৌঁছালো তাঁর অনেকগুলো সন্তানকে কেটে নিয়েছে তারা।ওদের বিক্রি করে তারা অনেক টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন।বনদেবী কুঠার হাতে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার করে বললেন "তোমরা কেন আমার সন্তানদের কাটছো?তোমরা জানো এদের জন্য কত মানুষ বেঁচে আছেন?এই প্রকৃতির কোলে বাতাস বইছে,মাটি তার আর্দ্রতা ধরে রেখেছে।এদের ধ্বংস করা মানে তোমরা সমগ্র প্রানীকুল ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে এগোবে।প্রকৃতি অশান্ত হবে,দূষিত হবে বায়ু,অক্সিজেন কমে যাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রকোপে"।
কে কার কথা শোনে।বণিক শ্রেনী নিজেদের এক কান দিয়ে কথা গুলো ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠতে বনদেবী রেগে গিয়ে তাদের শাপ দিলেন "যেভাবে তোমরা আমার সন্তানদের কাটছো,ধ্বংস করছো প্রকৃতিতে উঠবে ঝড়।এক একটা গাছ কাটা মানে এক একটা প্রানীর মৃত্যু হবে।মিলিয়ে নিও"।এরপর বছরের পর বছর কেটে গিয়ে মানুষ শিক্ষা-সভ্যতার চরমে পৌঁছে গিয়ে নিজেদের আরো ধনী বানাতে শিল্পায়ন,নগর উন্নয়নের মতো কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। লোভের বশবর্তী হয়ে বণিক শ্রেনীরা একদিন সব গাছ কাটতে কাটতে মাটি আলগা করে দিয়ে ভুমিক্ষয় ঘটালো।তারফলে সৃষ্টি হলো ভূমিকম্পের।কলকারখানার ধোঁয়া,জলদূষণ সব মিলিয়ে ঘটতে থাকে বায়ুদূষণ।বাড়তে থাকলো তাপ।নদী-নালার জল সব দ্রুত বাষ্প হয়ে জমাট বাঁধতে শুরু হলো।নদী-নালাও শুকিয়ে যেতে শুরু করলো দ্রুত ।তারফলেই হতে শুরু করলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।জন্ম নিলো বড় বড় ক্ষতিকর ঘূর্ণিঝড়,আয়লা-ফণীর মতো।আয়লাতে প্রচুর প্রানহানী ঘটেছিলো জানো দাদুভাই!আবার এখন আসছে ফণী।আমরা সবাই গাছ কাটি,তবে লাগানোর জন্য কেউ তৎপর হই না"।
গল্প শেষে ছোট ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছেন সব গল্পটা শুনে সে হাঁ হয়ে গেছে।হয়তো অনেক ভারী ভারী শব্দ এই বয়সে ওর মাথায় ঢুকছে না দেখে নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন "তুমি শুধু এটুকু জেনে রাখো,একটি গাছ মানে একটি প্রান বেঁচে থাকা"।
ছেলেটি খুব ব্যস্ত হয়ে দাদুর কোল থেকে নেমে চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষন পর বাড়িতে বৌমার চিৎকারের আওয়াজ পেয়ে বাগানে গিয়ে দেখছেন শিশুটা পাঁচটা মিষ্টির ভাঁড়ে ওর নিজের সহ মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমার নাম লিখে মাটি দিয়ে ছোট ছোট গাছের চারা বাগান থেকে তুলে লাগাচ্ছে ওর মালতী পিপির সাহায্যে।মায়ের বকা শুনেও লাগানো থামাচ্ছে না।ইশারা করে বৌমাকে নাতিকে বকতে মানা করে তিনিও হাত লাগিয়ে সব গাছ সমেত ভাঁড় কটাকে নিয়ে নাতির কথামত নাম দেখে সবার ঘরের জানলায় রেখে দিয়ে এলেন।পরদিন সকালে উঠে বাচ্চা ছেলেটি দেখছে কোন ঝড় হয়নি।সব ঠিক আছে।আনন্দে গোটা বাড়ি নাচতে নাচতে বলে বেড়াতে লাগলো "একটি গাছ মানে একটি প্রান"।।
সমাপ্ত:-
******