একটা বই, হৃদয়ের খুব কাছের
একটা বই, হৃদয়ের খুব কাছের


তখন তাতাই ক্লাস এইটে পড়ে। বাবার আচমকা ট্রান্সফার হয়ে গেল মালদা জেলায়। মায়ের সঙ্গে তাতাইরা রয়ে গেল বাড়িতেই। বাবা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন যার ফলে ছুটিছাটা পেতেন খুবই কম। বাড়ি আসতে পেতেন একমাস, দেড় মাস ছাড়া ছাড়া। এসময়টা তাতাইয়ের কাছে খুব কঠিন ছিল। বাবাকে কোনোদিনও সেভাবে কাছে না পেলেও তবুও তো দিনের শেষে মানুষটাকে দেখতে পেত, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেল। তার ওপর বাবা নিজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও সায়েন্স গ্রূপটা তাতাইকে নিজেই পড়াতেন, তাতাই অন্য কারুর কাছে সায়েন্স, ম্যাথ এসব বুঝতও না ভালো করে। কিন্তু বাবার ট্রান্সফারের পর টিউশন নিতেই হল। প্রথম প্রথম তো স্যারেদের পড়ানো যেন মাথার ওপর দিয়ে যেত। খাতায় স্যার কোনো অংক বোঝাতে শুরু করলে তাতাইয়ের চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসতো, মনে হত অজস্র কালো কালো বিন্দু যেন ঘুরপাক খাচ্ছে খাতার মধ্যে। ফলস্বরূপ পরীক্ষার খাতাতেও নম্বর বাড়ন্ত। যা কোনোদিনও ঘটেনি তাই ঘটল, অংক খাতা, ফিজিক্যাল সায়েন্স খাতা, বায়োলজি খাতা… সবেতেই লাল দাগ ভর্তি। সবেতেই সই লাগবে অভিভাবকের। সই করতে গিয়ে মায়ের হাতটাও বোধহয় কেঁপে উঠেছিল। ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না কি করা উচিৎ এই পরিস্থিতিতে!! অনেক বুঝিয়েছেন তাতাইকে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, মেয়েটা দিনের পর দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। তিনি রাতের অন্ধকারে চোখের জল ফেলেন রোজ। একদিকে এভাবে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে এসে পড়া আর অন্যদিকে মেয়েটার এই অবস্থা, সব মিলিয়ে দিশেহারা তিনি।
তাতাই নিজে অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে সামলানোর কিন্তু তাও বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করত সবসময়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল কি সেই সময় তাতাই যখনই কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ত, সেখানে হয়তো আদপে কোনোভাবেই বাবার কোনো ভূমিকা থাকা সম্ভব না, তবু মনে হত বাবা থাকলে বোধহয় এমনটা হত না। কখনও কেউ যদি ওকে বকে দিত কোনো কারণে, তাতাই ভাবত বাবা থাকলে ওরা বোধহয় এমনটা করতে পারত না। সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত জটিল সময় তাতাইয়ের জীবনে। মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিল দিন দিন।
এরকমই এক পরিস্থিতিতে হঠাৎ দাদু তাতাইকে ওর জন্মদিনে উপহার দিলেন একটা বই, শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "আদর্শ হিন্দু হোটেল"। তাতাই এমনিতে থ্রিলার বা ডিটেকটিভ গল্প ছাড়া খুব একটা অন্য বই পড়ত না। দাদুও সেটা জানতেন বলে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে ওর প্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ কোনো বইই উপহার দিতেন। এ বছর বোধহয় প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল। তাতাই যে একটু অবাক হয়নি তা নয়। তবুও এমন খ্যাতনামা সাহিত্যিকের লেখা বলেই হয়তো বইটা পেয়েই পড়তে শুরু করে দিয়েছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরেই তাতাইয়ের মনে হয়েছিল যেন এক অন্য দিগন্ত খুলে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে, ও যেন নিজেই পৌঁছে গেছে রানাঘাটের সেই হোটেলে, হাজারি ঠাকুরের পাশে বসে দেখছে তাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। মাত্র দু'দিন লেগেছিল বইটা শেষ করতে। বইটা শেষ হওয়ার এক অদ্ভুত ভালো লাগাতে ভরে উঠেছিল মনটা। আশ্চর্য হয়েছিল হাজারি ঠাকুরকে দেখে, একটা নিতান্ত সহজ সরল গ্রাম্য মানুষ কিভাবে হাজার বাধা বিপত্তি, অপমান, লাঞ্ছনা, ব্যর্থতা সব পেরিয়ে সৎ পথে নিজের জীবন অতিবাহিত করছে এবং সাফল্য পাচ্ছে। শুধু তাই নয় মানুষটা সৎ ছিল বলে কত মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাচ্ছে জীবনে। আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারি ঠাকুর সেদিন তাতাইয়ের মনে এক অন্যরকম আদর্শকে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। তাতাই উপলব্ধি করেছিল---- হাজারি ঠাকুর এতো কিছু সয়েও যদি সাফল্য পেতে পারেন তাহলে আমি ভয় পাচ্ছি কিসের? আমি ভেঙে পড়ছি কেন?
সত্যি বলতে এর পরেই নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত পেয়েছিল আত্মবিশ্বাস তাতাই। যার জেরে এগিয়ে যেতে পেরেছিল পরবর্তী দিনগুলোয়। এখনও যদি কখনও কোনো কারণে মন খারাপ থাকে বা কোনো কারণে আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করে ও, তখন আবার বইটা খুলে পড়তে থাকে।
"আদর্শ হিন্দু হোটেল" তাতাইয়ের কাছে তাই শুধু একটা বই না, ওর জীবনের দিশাও বটে।