Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

এখানে পিঞ্জর

এখানে পিঞ্জর

9 mins
553


Everything is fair in love and war... ভালোবাসায় সব কিছু চলে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই অতিব্যবহৃত আপ্তবাক্য সর্বদাই হয়তো প্রমাণিত সত্য। তবুও এও সত্যি এবং বার বার প্রমাণিত যে ভালোবাসায় আর যাই চলুক, সম্মানের বা বিশ্বাসের অভাব কিছুতেই চলতে পারে না। হয়তো পরিস্থিতির চাপে কখনো, আবার কখনো স্বভাবদোষে বিশ্বাসের অভাব ঘটেই যায়, অথবা ঘটে সম্মানহানি। তবুও জীবন এমন কিছু খেলা খেলায়, যেখানে সম্মান ও বিশ্বাস ধরে রাখাটাই সেখানে বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ।


আর সত্যি বলতে কী সেই পরীক্ষায় কেউ কেউ হয়তো টেনেটুনে পাশ করে যায়, আবার কেউ কেউ একেবারে ডাহা ফেল। একদল আবার পরিস্থিতিকে এড়িয়ে গিয়ে, শুধু স্মৃতি নিয়ে ব‌াঁচতে চায়, সুখী হতে চায় জীবনে। আর তারাই বোধহয় প্রবল মানসিক টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ে সারাজীবন জ্বলতেই থাকে। হারানো যাকিছু তার অপেক্ষা করে, যদি কখনো হারিয়ে যাওয়া সুখ ফিরে আসে আবার!


সেই রকমই এক মানুষ নবনীতা। বরাবরের শান্তশিষ্ট মেয়েটা খালি খুঁজে চলেছে ওর হারানো প্রেম, একদা সম্মান ও বিশ্বাসে টইটম্বুর সেই প্রেমের অন্তহীন অপেক্ষায় রয়েছে যেন নবনীতা। একদিনের নয়, দিনের পর দিন নিজের চোখে দেখা ঘটনাপ্রবাহকে নবনীতা ভুল, কাল্পনিক ভাবতে চেয়েছে। নিজেকে নিজের মনে স্বান্তনা দিয়েছে। আর বোঝাতে চেষ্টা করেছে নিজেকে, "সবসময় কি নিজের চোখে দেখা সব ঘটনা সত্যি হয়? দৃশ্যমান যাকিছু তার সবই কি আর সরলরেখা মেনে চলে? নাকি সামান্য এক জড়বস্তু কি কখনো একটা গোটা জীবনের চালচিত্র হয়ে উঠতে পারে?" আবার নিজের মনেই নিজেই বিড়বিড় করে নবনীতা, "কক্ষণো নয়!" নবনীতার মনে হয় ও একটা খাঁচার ভেতরে আটকা পড়ে গেছে। দাঁড়ে বসা ময়নার মতো পায়ে শিকলি আর ডানা দু'টো মোচড়ানো। ওড়ার জোর নেই। আছে শুধু প্রবল ভয়। তাই নবনীতা খাঁচাটাকেই আপন করে নিয়েছে। দাম্পত্য কলহ ও সাংসারিক সমস্যায় সমস্যায় জেরবার নবনীতা। আজকাল কেউ যেন ঠিক আর নবনীতার কথা শোনে না। নাকি শুনেও না শোনার ভান করে, কে জানে? কী স্বামী, কী ছেলেমেয়েরা কেউ যেন আর ঠিক নবনীতার বশে নেই। নবনীতা অভিজ্ঞতায় দেখেছে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই একেবারে অশান্তির একশেষ। তাই নবনীতাও চুপচাপই থাকে। বোবার শত্রু নেই কথাটা যে বড্ডো সত্যি, তা আজকাল নবনীতার থেকে বেশী ভালো করে কেউ অনুভব করতে পারবে না।


মুখ বুজে থেকে ভালো থাকার অভিনয়ে যেকোনো ডাকসাইটে অভিনেত্রীকেও হার মানিয়ে দেবে নবনীতা। এইতো, যেমন সেই দিনের কথা... নবনীতা স্বামী দেবেশের কাছে মাত্র শ'দুয়েক টাকা চেয়েছিলো। নবনীতার মায়ের চশমার ডাঁটিটা ভেঙে দু'টুকরো হয়ে গেছে। দেবেশ টাকাটা তো দিলোই না, উল্টে দশ-বিশটা ছোটবড়ো কথা শুনিয়ে দিলো। তার মধ্যে চরম কথা, "জামাইয়ের টাকায় বাবুয়ানি করতে তোমার বাপ-মায়ের একটুও আঁতে ঠেকবে না? নাকি ওসব লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে বসে আছে?" নবনীতার মুখে এসে গিয়েছিল প্রায়, "বিয়ের পণে পাওয়া স্কুটারে চেপে অফিসে যেতে তোমার আঁতে ঠেকে না? নাকি লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে বসে আছো?" কিন্তু মনে মনেই বললো নবনীতা। মুখে আর উচ্চারণ করতে পারলো না কথাগুলো। স্রেফ অশান্তির ভয়ে।  হ্যাঁ, প্রতিদিন এরকমই ঘটে, মানে ঘটে চলেছে। হয়তো কেউ কেউ মুখে বলে বা শেয়ার করে, কিন্তু নবনীতা লজ্জায় কখনো বলে না এসব কথা কারোর কাছে। সে যেই হোক। নিজের অশান্তির মধ্যে নিজেই নাগপাশের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দুনিয়ার সব মেয়েই চায় স্বামীর কাছ থেকে সম্মান, সহমর্মিতা আর ভালোবাসা। যদি তা না পায় তাহলে সংসারটা করারই আর কোনো মানে থাকে না। নবনীতা মরিয়া হয় মাঝেসাঝে। চিড় খাওয়া সংসারটায় সিমেন্ট বালির মতো পুলটিস দিয়ে ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করার।


তবে পারে না। বাবা-মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। অভিনয় ক্ষমতা এইখানে এসে সপাটে ধাক্কা খায়। তবুও নবনীতা প্রাণপণ চেষ্টায় ভালো থাকার অভিনয়টা চালিয়েই যায়। নবনীতার বাবা-মাও কিছু বলতে পারে না। জামাইয়ের যাতে কোনো বিষয়ে কোনো রাগ বা ক্ষোভ না হয় তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় জড়সড় হয়ে থাকে। আর নবনীতা? বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নবনীতা কিন্তু স্বামীর মধ্যেই বিশ্বাস, ভরসা, সম্মান, প্রেম, সুখ, শান্তি সবই খুঁজে নিয়েছিলো। এক অলিখিত বোঝাপড়া নিয়েই নবনীতা নিজের একশোভাগ দিয়েই দেবেশের সংসারকে সাজিয়ে গুছিয়ে আপনার করে তুলেছে। হোক গতানুগতিক, তবুও ছন্দহীন ছন্দেই কেটে গেছে একটা দুটো করে পাক্কা বারোটা বসন্ত। নবনীতা আর দেবেশের ছেলে এখন দশ, মেয়ে ছয়। ইংলিশ মিডিয়াম দুজনেরই। সংসার খরচ লাফিয়ে বেড়েছে। দুজনের স্কুলের মাইনে, টিউশন পড়ার খরচ, বইখাতা-টিফিন, যাতায়াত... আরো হাজার একটা খরচে দেবেশের কাঁধে অবশ্যই বাড়তি কিছু চাপ। যদিও নবনীতা নিজেই ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দেখিয়ে দেবার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলো। দেবেশ এবং দেবেশের বাবা-মা ভরসা করতে পারেনি। যতই হোক নবনীতা বাংলা মিডিয়ামের হাত ধরে মফস্বলী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাশ মাত্র।


ওটা এখন স্রেফ একটুকরো কাগজ। মুদির হিসেব, সংসার খরচ আর বড়জোর ছেলেমেয়ে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন বইয়ের মলাটে গোটা গোটা অক্ষরে নাম লিখে দেওয়া ছাড়া আর কোনো হোমে যজ্ঞে লাগে না। এই বারো বছরে নবনীতাও কেমন যেন হাত পাতার অভ্যেস করে ফেলেছে। অবশ্য নেহাত দরকারে পড়লে তবেই নবনীতা দেবেশের কাছে হাত পাতে। ওর দরকারগুলোও যৎসামান্যই। তবে মায়ের চশমা ভাঙাটা সারানোর টাকাটা চাওয়ার পরের ঘটনাটা থেকে নবনীতার মনটা যেন তেতো বিষ হয়ে আছে। অথচ এই কিছুদিন আগেই দেবেশ নিজের বাবা-মায়ের ঘরে আলাদা একটা বাড়তি ওয়াল মাউন্টেড টিভি বসিয়ে দিলো, বাহান্ন ইঞ্চির। মা বাবা দুজনেই আলাদা আলাদা চ্যানেল দেখে, তাই এই ব্যবস্থা। নবনীতা এসব ব্যাপারে কখনো কিছু প্রতিবাদ করে না। কেনই বা করবে? বাবা-মায়ের জন্য ছেলে খরচ করছে, এতে তো নবনীতার তো বলার কিছু থাকতে পারে না। বিয়ের পরে দেবেশের অনেক পদোন্নতি হয়েছে। মাইনেও বেড়েছে কয়েকগুণ। সুতরাং এই সব খরচ করতেই পারে অনায়াসে। শুধু নবনীতার সামান্য কোনো প্রয়োজনে সামান্য টাকাও দিতে হলে আজকাল দেবেশ চূড়ান্ত অসহিষ্ণু হয়ে নবনীতাকে ওর, আর ওর বাবা-মায়ের অকর্মণ্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নবনীতা তাতেও মুখ বুজেই থাকে।


এবারের এই শ'দুয়েক টাকার খোঁটাটা তাই বড়ো তীব্র হয়ে নবনীতার বুকে বেজেছিলো। যাক গে, কিছু একটা রাস্তা ভেবেচিন্তে বার করতে হবে। বিয়েতে নবনীতার বাবার দেওয়া গয়নাগুলোও দেবেশের মায়ের সাথে জয়েন্ট লকারে রাখা হয়েছে। নবনীতার মেয়ের বিয়ের সময় লাগবে গয়নাগুলো, তাই। তখনো নবনীতা কোনো প্রতিবাদ করেনি। উল্টে ভেবেছে, নিজের মেয়ের জন্যই তো রাখা থাকছে। কিন্তু এখন বুঝছে খুব ভুল ভেবেছে। গয়নাগুলো নিজের কাছে থাকলে, তার থেকে একটা কিছু বিক্রি করেও সামান্য কিছু টাকা বাবা-মায়ের হাতে দিতে পারতো। বাবারই তো দেওয়া গয়নাগুলো। আসলে গত কয়েক বছরে মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় বাবা সর্বস্বান্ত। তাও কখনো মেয়ে হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালনই করতে পারেনি নবনীতা। নিজের রোজগার নেই। সবটাতেই দেবেশের ওপরে নির্ভর করতে হয়। দেবেশ প্রথমবারের চিকিৎসার সময় হাজার তিনেক টাকা নবনীতার হাতে দিয়েছিলো অবশ্য। কিন্তু দেবেশের বাবা-মা পরে শুনিয়েছে নানা ভাবে যে ক্যান্সার সারে না। এসব রোগের পেছনে খরচা করে সর্বস্বান্ত হবার কোনো মানেই হয় না। তখনো নবনীতার একবার মনে হয়েছিলো দেবেশকে বলে, "রোগটা আমার মায়ের না হয়ে তোমার মায়ের হলেও কী এই একই কথা হতো?" কিন্তু নাহ্, নবনীতা শেষপর্যন্ত আর বলতে পারেনি কোনো কথা। মুখ বুজে চুপচাপ সব হজম করেছে শুধু। মা এখন মোটামুটি সুস্থ, তবে বাবার দোকানটা বিক্রি হয়ে গেছে মায়ের চিকিৎসা করাতে। তাই টানাটানি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তাও বাবা-মা কখনোই নবনীতার কাছে মুখ ফুটে কিছু চায় না। নীচের তলায় দু'ঘর ভাড়াটে ছিলোই, ওপরতলায়ও একটা ঘর রান্নার জায়গা সমেত ভাড়া বসাতে হয়েছে।


এবারটায় নবনীতা মা'কে দেখতে ওবাড়ীতে গিয়েই দেখেছে, মায়ের চশমার ডাঁটিটা ভেঙে গেছে। বাবা একটা মোটা সুতো কয়েকভাঁজ করে কায়দা করে বেঁধে দিয়েছে, মায়ের কান মাথা পেঁচিয়ে নিয়ে। দৃশ্যটা দেখে নবনীতার বুকের ভেতরটা মুচড়ে গলা ব্যথা করে উঠলো। তবে বাবা-মায়ের সামনে নবনীতা দু'ঠোঁট ফাঁক করেনি ভুলক্রমেও। শ্বশুরবাড়ী বা নিজের বাড়ী, যাই হোক না কেন, সেখানে ফেরার পথে নবনীতা চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। গোটাটা রাস্তাই শাড়ির আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে এসেছে। ফেরার পথে এক চশমার দোকানে খোঁজ নিয়েছে। নতুন ফ্রেমের দাম শ'পাঁচেক কমপক্ষে। সঙ্গে পাওয়ারটাও চেক করিয়ে নেবে। নয়তো আবার ক'দিন পরেই আবার চশমার কাঁচ পাল্টাতে হবে। সে আবার এক ফালতু ঝামেলা, আবার একটা খরচের ধাক্কা। কোথায় পাবে নবনীতা টাকা? নিজের তো কানাকড়িরও সংস্থান নেই। মনে মনে হিসেব কষতে কষতে বাড়ীতে ফিরেছে। মায়ের চশমাটা নতুন করাতে সব মিলিয়ে হাজার খানেক খরচ। অতটা টাকা নেই নবনীতার কাছে। ছেলেমেয়েকে টিউশন ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে রোজ হেঁটেই ফেরে নবনীতা, আবার যখন আনতে যায় তখনো হাঁটে।


অটোভাড়ার পয়সাটা বেঁচে যায়। ছেলেমেয়েকে নিয়ে তো হাঁটা সম্ভব নয়, কিন্তু নিজের একা একা যাতায়াতের পথটুকু হেঁটে নবনীতা ঐ পয়সাটুকু বাঁচায়, সবাইয়ের চোখ এড়িয়ে। এছাড়া উপায়ইবা কী? তাও হাঁটতে গিয়ে বাড়তি কিছুটা সময় লেগে যায়। তারজন্যেও এন্তার মুখঝামটা খায় শাশুড়ির কাছে। নবনীতা গায়ে মাখে না মোটেই এসব কথা, বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে, এইটুকু সহ্য করে নবনীতা। এইভাবেই নবনীতা আটশো টাকা জমিয়েছে, বাকী দুশো টাকাটার জন্য নবনীতা দেবেশের কাছে চাইতে গিয়েই বিপত্তিটা। খুব কষ্ট হয়েছে নবনীতার, তবে বিন্দুমাত্র মেজাজ হারায়নি। কারণ যে করেই হোক নবনীতাকে টাকাটা জোগাড় করতেই হবে। ও যে দামটাম আগে যাচাই না করেই কথা দিয়ে ফেলেছে নিজের থেকেই বাবা-মাকে। বাবা-মায়ের জন্য যে এটুকু কথা নবনীতাকে ভাবতেই হবে। বাবা-মাকে এইই সামান্য জিনিস দেওয়ার কথা ও কিছুতেই নিজের থেকে ফেরাতে পারবে না। তাহলে তো আগাগোড়া সবকিছুই বলতে হবে দেবেশ ও তার পরিবারের লোকজন সম্পর্কে। তার থেকে থাক, নবনীতা আরেকবার চেষ্টা করবে। কী আর হবে? বড়জোর নাহয় আবার একবার দেবেশের কাছে ও নিজে অপমানিতই হবে। সেদিন রাতে শুতে এসে নবনীতা দেখলো দেবেশ তখনো বসে বসে সিগারেটে টান দিচ্ছে। আজকাল ওদের ছেলে দাদুর কাছে, আর মেয়ে ঠাকুমার কাছে শোয়। এতে করে দেবেশের মোটামুটি সপ্তাহের সব দিনগুলোতেই মিলিত হবার প্রবল ইচ্ছে চাগিয়ে ওঠে। খেয়াল করে দেখলো নবনীতা সেদিন শুক্রবার। পরদিন ছুটি নয়।


তবুও ঐ সেই কারণেই দেবেশ তখনো জেগে। বিয়ের আগেই বিবাহিতা বান্ধবীদের কাছ থেকে নবনীতা শুনেছিলো, যে পুরুষমানুষ নাকি বিছানায় ঐ বিশেষ সময়ে বিরাট দিলদরিয়া হয়ে যায়। কাজেই যাকিছু দাবীদাওয়া আদায়ের বিশেষ সময় নাকি ওটাই। অবিশ্যি নবনীতা আজ অবধি, দুই সন্তানের জননী হয়েও কিছুই দাবী আদায় করতে পারেনি দেবেশের কাছ থেকে। ঐ বিশেষ মুহুর্তেও দেবেশ দরাজ হয় না। যাইহোক আলো নিভিয়ে নবনীতা শুয়ে পড়তেই, খুব টুকিটাকি সাংসারিক মামুলি দু-চারকথার পরই দেবেশ নাক কুঁচকে বললো, "কী যে করো সারাদিন ধরে? এত্তো দুর্গন্ধ চুলে! একটু তো অন্তত সাজে পোশাকে টিপটপ থাকতে পারো!" নবনীতা আর কোনো কথা পাড়তেই পারলো না। শরীরের উত্তাপ নবনীতার শীতল শরীরে নিঙড়ে ঢেলে দিয়ে দেবেশ দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আর কী আশ্চর্য! দেবেশের নাকডাকার আওয়াজ শুনতে শুনতে নবনীতাও একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। প


রেরদিন অফিস থেকে ফিরেই দেবেশ নিজের মায়ের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। নবনীতা তখন বাড়ীতে ছিলো না। ছেলেমেয়েকে টিউশন ক্লাস থেকে আনতে গিয়েছিলো। দেবেশ ঠিক কী বলবে নিজের মা'কে তা বুঝতে না পেরে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকে গেলো। ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো দেবেশ মন ডুবিয়ে। নবনীতা চা নিয়ে ঢুকে কখন সামনে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি। মৃদুস্বরে নবনীতা ডাকলো, "চা'টা নাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে"। ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে দেবেশের চোয়াল ঝুলে পড়েছে প্রায়। এ কে? নবনীতাকে দেখে তো চেনাই যাচ্ছে না! একলাফে ছত্রিশের নবনীতা পঁচিশের তরুণী? নবনীতার ঈষৎ ডিম্বাকৃতি ছাঁদের ফর্সা মুখ ঘিরে পিক্সি কাট ফুরফুরে চুল। দেবেশের দু'চোখে মুগ্ধতা, আর মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেলো, "ওয়াও!" নবনীতার খুব বিশেষ ভাবান্তর নেই তাতে। নিজের কাজে ফিরে গেলো। আর পরদিন রবিবার। সুতরাং রাতের বিছানায় দেবেশ নবনীতাকে নিয়ে ফিরে গেলো বারো বছর আগেকার মধুর দিনগুলোতে, তখনো ছেলেমেয়ে হয়নি। কী আদুরে সোহাগী ছিলো সেসব দিনরাত! আজ যেন সেই পুরনোকেই নতুন করে ফিরে পেয়েছে দেবেশ। দেবেশের আদরের ঢেউয়ে ভেসে যেতে যেতে বলে নবনীতা, "চুলের যত্ন হচ্ছিলো না, ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। ভিজে চুলে দুর্গন্ধ হচ্ছিলো, তুমিও বিরক্ত হচ্ছিলে, তাই কেটেই ফেললাম চুলটা।" দেবেশ নবনীতার সদ্য কাটা, শ্যাম্পু আর কণ্ডিশনিং করা চুলে মুখ ডুবিয়ে কী বললো অস্ফুটে। দেবেশের চওড়া পিঠে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে নবনীতা মনে মনে বললো, "এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যাণ্ড ওয়ার... খুব সত্যি কথা।"


দেবেশের ভালোবাসার উত্তাপে অবগাহন করতে করতেই নবনীতা ভেবে চলে, "এটুকু মিথ্যায় ক্ষতি কি? দেবেশ আর বাবা-মা তিনজনই তো আমার ভালোবাসার মানুষ। যে চুলটার বিরক্তিকর উপস্থিতি দেবেশকে উত্যক্ত করে, সেই চুলটুকু কেটে পরচুলা তৈরীর পার্লারে বিক্রি করে যেকটা টাকাই পেলাম তাতে মায়ের চোখের ডাক্তার দেখানো আর নতুন চশমাটা করানোর খরচা আরামসে উঠে আসবে।" কী অনায়াসে টাকার জোগাড় হয়ে গেলো! নবনীতার চুলটার জন্য দেবেশের বিরক্তিও নেই, মায়ের চশমার টাকার জন্য চিন্তাও নেই। আবার হোক না কেন টাকার বিনিময়ে বিক্রি, তবুও তো কোনো চুলহীন রুগ্ন বিগতরূপ মানুষ নবনীতার চুল দিয়ে তৈরী পরচুলা পরে স্বস্তি পাবে সমাজের পাঁচ জনের সামনে। নবনীতার মতো বিয়ে আর সংসারের খাঁচায় বন্দী মেয়ের সামনে এমন বুদ্ধি খাটিয়ে একঢিলে তিনপাখি মারা ছাড়া আর কিইবা রাস্তা খোলা ছিলো? নবনীতাকে গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে দেবেশ। নবনীতার চোখে ঘুম নেই। তবে এখন এই পিঞ্জরেই যেন ওর মনে কেমন ধীর স্থির সুগভীর প্রশান্তি... Everything is fair in love and war


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance