Sourya Chatterjee

Romance Classics

4.8  

Sourya Chatterjee

Romance Classics

এক চিলতে রোদ্দুর

এক চিলতে রোদ্দুর

5 mins
446


সুস্মিতা যখন ফ্ল্যাটে ঢুকল তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে। ব্লেজারটা নিজের গা থেকে খুলে চেয়ারের উপর রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো একবার। ছ’তলা এই ফ্ল্যাটটায় গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যাবেলাতেও খুব সুন্দর হাওয়া খেলে। চুলটা খুলল সুস্মিতা। বাতাস লেগে সারাদিন ক্লিপের বাঁধনে বন্দী থাকা চুলগুলো এলোপাতাড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণ ভরে প্রশ্বাস নিল সুস্মিতা। এখনো ঘরের আলোগুলো জ্বালায়নি। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছ’তলা ব্যালকনি থেকে রাতের শহরটাকে দেখতে বেশ লাগে। কত লোক বাড়ি ফিরছে। কেউ আবার নাইট শিফটের জন্য কাজে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট বারান্দাতেই কাটায় সুস্মিতা। 

মেঘ ডাকছে মাঝে মধ্যে,মনে হয় বৃষ্টি হবে। আজ হাওয়াটাতেও একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ আছে, বৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। যা গরম পড়েছিল এই কটা দিন, বাপরে বাপ! বৃষ্টি হলে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি ছ’টা রুটি বানিয়ে জানলার ধারে বসে বৃষ্টি দেখার সিদ্ধান্ত নিল সুস্মিতা। সকালে মাসি চিকেন রান্না করে রেখে গেছে। নীল বাড়ি ফিরলে গরম করে নেবে। আচ্ছা! খিচুড়ি বানালে কেমন হয়! এই বৃষ্টির মধ্যে জমে যাবে পুরো। আর তারপর এই রোমান্টিক আবহাওয়ার সাথে বারান্দায় নীলের সাথে বসে একটু হুইস্কি হলে তো আর কথাই নেই। রাখা আছে আড়াইশো মিলিলিটারের মত। উফফ! কখন যে নীল আসবে। ততক্ষণ যেন এই আবহাওয়াটা থাকে! 

কাজ আছে, অথচ বারান্দা ছেড়ে ঘরে যেতেই ইচ্ছে করছে না সুস্মিতার। এই সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে ঘরে যেতে কার মন চায়! কিছু করার নেই। বৃষ্টি দেখতে দেখতে মুরগির মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেতে হলে আপাতত একটু হাত মুখ ধুয়ে আসতে হবে। দরজাটা খোলা রেখেই ঘরে ঢুকল সুস্মিতা। বেশ ফুরফুরে হওয়া ঢুকছে। বারান্দার টবে রাখা গাছের পাতাগুলো হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে। মুচকি হাসল সুস্মিতা। ছোটবেলা যখন এরকম হওয়া দিত বাড়ির দরজা জানালার পর্দাগুলো উড়ত। কি সুন্দর লাগত! 

তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খিচুড়ি রান্নায় চাপিয়ে আবার যখন সুস্মিতা এল তখন ইতিমধ্যেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারটাকে একটু পিছিয়ে নিয়ে বসল ও। এই বৃষ্টির ছাটের অল্প ছিটা এসে গা হাত পায় লাগে, এটা বেশ ভালো লাগে সুস্মিতার। মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে বেশ কদিন ধরে একটু বৃষ্টির প্রার্থনা ছিল। ঈশ্বর শুনলেন তবে। মনে মনে হাসল সুস্মিতা। 

সাধারণত এই সময়টা কোনো বই পড়ে সুস্মিতা। আজ আর এই আবহাওয়ায় বই পড়তে ইচ্ছে হল না। বরং ফোনে নাইনটি’স এর প্রেমের গান শুনতে ইচ্ছে হল। আহা! স্বর্গীয় আরাম যেন। এর মধ্যে সময় বুঝে খিচুড়ি নামিয়ে এসেছে রান্না থেকে। একটু চেখে দেখেও নিয়েছে স্বাদ । এই স্বর্গীয় পরিবেশে জমে যাবে একেবারে। নীল আসার জন্য আরো এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। সেইটুকু সময় এইভাবেই প্রকৃতির প্রেমে নাইনটি’সের গান শুনতে শুনতে হাবুডুবু খাবে বলেই মনস্থির করল সুস্মিতা। 

ইজি চেয়ারটা নিয়ে আরেকটু পিছিয়ে বসল সুস্মিতা। বৃষ্টিটা একটু বেড়েছে। ভালোই ছিটা আসছে এখন। প্যালাজোটা একদম ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির ছিটা লেগে। কান থেকে ইয়ারফোনটা একটু খুলল সুস্মিতা। বাহ! বৃষ্টির শব্দটাও তো দারুণ! ঠিক যেন অজানা কোনো সুরে কেউ জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে। অপূর্ব লাগছে। প্রকৃতির স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ মনে প্রাণে গ্রহণ করছে সুস্মিতা। 

বৃষ্টির তেজ বাড়তে লাগল ক্রমশ। ঘরে এখন বেশ ভালোরকমই ছিটে আসছে। না! আর বাইরে বসে লাভ নেই। ঘরে আসার জন্য ইজি চেয়ার চেয়ার ছেড়ে উঠল সুস্মিতা। ওমা! একি! বারান্দার আলোটা ঝপ করে নিভে গেল কেন! লোডশেডিং হলো নাকি? যা ভেবেছে ঠিক তাই। লোডশেডিং হয়েছে। আহ! আর সময় পেল না লোডশেডিং হবার। বৃষ্টির মধ্যে হল, কখন আবার আলো আসে কে জানে। ভিতরের ঘরটায় ইনভার্টার আছে। ওখানে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে বসল সুস্মিতা। কি জ্বালাতন! এই বৃষ্টির মধ্যে লোডশেডিং! ইনভার্টারের ব্যাটারি আবার কতক্ষণ থাকবে কে জানে। 

নীল অফিস থেকে নিশ্চয় বেরিয়ে ক্যাব পেয়ে গেছে এতক্ষণে। তাও জানার জন্য ফোন করল সুস্মিতা। একি! ফোন সুইচ অফ বলছে তো। একটা দুশ্চিন্তার কালো মেঘ যেন সুস্মিতার মনে আছড়ে পড়ল। কি হল নীলের! ওর ফোন তো এরকম সুইচ অফ থাকে না। আরো দু তিনবার ফোন করবার চেষ্টা করল সুস্মিতা। না! সত্যিই সুইচ অফ! বাইরে করকরাৎ করে বাজ পড়ল। আঁতকে উঠল ও। বৃষ্টির তেজও ক্রমশ বাড়ছে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের কোথাও কোনো আলোর চিহ্নমাত্র নেই। জলতরঙ্গর টুংটাং মন মাতানো সুর কয়েক মুহূর্তে যে এরকম ভয়ঙ্কর রূপ নেবে তা টেরই পায়নি সুস্মিতা।

নীল কি করছে কে জানে! ঘনঘন ঢোক গিলছে সুস্মিতা। ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে। বৃষ্টিটাও কমছে না কিছুতেই। একঘেয়ে দমবন্ধ করা বৃষ্টির শব্দের সাথে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দের যুগলবন্দী ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে সুস্মিতার কানে। নীলের অফিসের কলিগের নাম্বার বার করে ফোন করে জানতে পারল নীল ঠিক সময়ই অফিস থেকে বেরিয়েছে। ফোনে চার্জ কম বা ফোন খারাপ হয়েছে নাকি এই বিষয়ে নীলের কলিগের কোনো ধারণা নেই। বৃষ্টির মধ্যেই বারবার বারান্দায় গিয়ে নিচের বড়রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে আসছে সুস্মিতা। কোনো জনমানব নেই। শুধু দু একটা গাড়ি মাঝে মধ্যে এই দুশ্চিন্তামগ্ন ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।

বড্ড অসহায় লাগছে সুস্মিতার। বারবার নীলকে ফোন করার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে ওর! মাঝে মধ্যেই ডুকরে কেঁদে উঠছে নিজে থেকে। ও কোথায় নীলকে খুঁজতে বেরোবে এই বৃষ্টির মধ্যে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘরের মধ্যে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিজের বেখেয়ালেই বাঁ গাল বেয়ে কখন যে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তা নিজেই বোঝে নি সুস্মিতা। প্রকৃতি কি নিষ্ঠুর! টেবিলের এককোণে খিচুড়িটা পড়ে রয়েছে, তার সাথে পড়ে রয়েছে এই কিছুক্ষণ আগেই তৈরি হওয়া এক গুচ্ছ ইচ্ছে, স্বপ্ন। 

দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বেজে গেল অসহায়তা আর দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করে। সুস্মিতা চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে তাড়াতাড়ি যেন নীল বাড়ি ফেরে আর তার সাথে বৃষ্টিটা বন্ধ হয়। অনেক হয়েছে এই দানবীয় বৃষ্টি! আর দরকার নেই। 

একটু বৃষ্টিটা কমেছে মনে হয়। গাড়িঘোড়ার হর্নের আওয়াজও ক্রমশ বাড়ছে। যদিও সুস্মিতার উদ্বেগ বাড়ছে বই, কমছে না। বারবার ঘড়ি দেখছে। নীল এখনও আসছে না তো। মোবাইলটাও অনবরত সুইচ অফ! বৃষ্টিটা কমার সাথে সাথে নীল বাড়ি ফিরবে এই আশায় মন দুলে উঠলেও দুশ্চিন্তার মেঘেদের পাহাড় আরো যে উঁচু হচ্ছে সুস্মিতার মনে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুলল সুস্মিতা। দরজার ওপারে নীল দাঁড়িয়ে আছে ভেজা জামাকাপড় পরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সুস্মিতা। অজানা বাতাস এসে মনের দুশ্চিন্তার পাহাড়টাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে ততক্ষনে। সুস্মিতা জাপটে জড়িয়ে ধরল নীলকে। নীল অস্ফুট স্বরে বলল বটে “কি বৃষ্টি! তার মধ্যে ফোনটাও চুরি হয়ে গেল”। তবে সে কথা সুস্মিতার কানে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। সে নীলকে জাপটে ধরে নীলের জামাটা আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে আছে তখন। রোমানটিসিজমে হাবুডুবু খেতে খেতে খিচুড়ি, মুরগীর মাংস আর হুইস্কির স্বপ্ন দেড় দু ঘন্টার ব্যবধানে শুধু যে নীলকে একবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেয় পরিবর্তিত হয়ে যাবে সেটা তখন ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি সুস্মিতা। 

কারেন্ট এলো বোধহয়। ঘরের আলো গুলো জ্বালানো ছিল না। শুধু বারান্দার আলোটা জ্বলছিল। হলুদ আলোটা সুস্মিতা আর নীলের গায়ে এসে পড়েছে। ঠিক যেন মনে হচ্ছে এক চিলতে রোদ্দুর ওদেরকে অভিবাদন জানাচ্ছে একটা দুঃসময়ের সমাপ্তির সংবাদ নিয়ে। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে শুধু সেই এক চিলতে রোদ্দুরের মাঝে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance