Bidyut chakraborty

Classics Inspirational Others

5.0  

Bidyut chakraborty

Classics Inspirational Others

::এক চিলতে রোদ্দুর::

::এক চিলতে রোদ্দুর::

11 mins
779


টুকরো টুকরো কত ছবি

আঁকা হয়ে যায় এ জীবনে

কিছু যায় হারিয়ে, কিছু সব ছাড়িয়ে

বারে বারে ফিরে আসে মনে ॥


মনের ক‍্যানভাসে হাজারো স্মৃতির তুলি আঁচড় কাটে।রাতের আকাশের অসংখ্য তারার মতো এক আকাশ স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে জোনাকির মতো মিটমিট করে জ্বলে আর নিভে।রাতের কালো আকাশের বুকে কিছু তারা যেমন খুব ঝলমল করে ,খুব উজ্বল দেখায় তেমনি কিছু কিছু স্মৃতি খুব বেশি মনের আকাশে শরতের রোদের মতো মনের মেঘের মাঝে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলে। স্কুল জীবনের একটা ঘটনা আজও আমার স্মৃতির সারণী বেয়ে বার বার মনের আকাশে উঁকি দিয়ে যায় ,হাজারো স্মৃতির ভিড়ে।এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়লেও স্কুল জীবনে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ের একটা ঘটনার কথা আজও এতোদিন পরেও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।সেই ঘটনার কথা আজ বলব।


এই গল্পের কেন্দ্র বিন্দুতে আমি নেই, আছে আমার বান্ধবী চাঁপা-- মানে সন্ধ্যামণি রুইদাস। যদিও চাঁপা ডাক নামে চাপা পড়ে যায় সন্ধ‍্যামণি নামটা।সন্ধ‍্যামণি নামটার অস্তিত্ব থাকে শুধু সরকারি কাগজপত্র ও স্কুলের খাতায়। সন্ধ‍্যা নামেও সন্ধ‍্যা, রঙেরও সন্ধ‍্যা। পাতলা ছিপছিপে দেহের গড়ন, বয়সের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। সন্ধ‍্যার আলো অন্ধকার পরিবেশের মতো সুন্দর স্নিগ্ধোজ্জ্বল মায়াবী তার মুখমণ্ডল। আর চোখ দুটো টানাটানা গভীর,মণি দুটো ঘন কালো। নাকটা বাঁশির মতো না হলেও খুব ভোঁতা নয়, আবার টিকালোও বলা যায় না দুইয়ের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত ধরনের গঠন। আর  চুল--- ঘন কৃষ্ণবর্ণ মেঘকে যেন কেউ বেণী বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে----কোমর পেরিয়ে একমাথা ঘন মিশকালো লম্বা চুল। মোটের উপর চাঁপা দেখতে বেশ সুন্দরী। ওর রূপের সঙ্গে গায়ের রঙ যেন মানান সই । পাতলা হলেও শরীরের অঙ্গ গুলো বেশ উন্নত। তাই ওকে দেখে বয়স অনুমান করা যায় না।


চাঁপার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব প্রাইমারি স্কুল থেকে। প্রাইমারি স্কুলের অন্য বন্ধু-বান্ধবীরা সাঁইথিয়ার বিভিন্ন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলেও আমি আর চাঁপা আমাদের গ্রাম কোটাসুরের 'বীণাপাণি উচ্চ বালিকা বিদ‍্যালয়'-এ ভর্তি হয়। ফলে পূর্বের সখ্যতা আরও গভীর হলো। আমরা হয়ে উঠলাম হরিহর আত্মা। এইভাবে দেখতে দেখতে আমরা উভয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম। চাঁপা বরাবরই পড়াশোনায় বেশ ভালো---ও আমাদের ক্লাসে প্রথম হয়। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই ও ক্লাসে প্রথম আর আমি কখনও দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির প্রথম কয়েক মাস ঠিকই চলছিল। হঠাৎ দেখি চাঁপা স্কুল আসা বন্ধ করে দিল। চাঁপা সচরাচর স্কুল না আসা করে না।কেন স্কুলে আসছে না তা জানতে ওর বাবার ফোনে ফোন করলেও ওর বাবা চাঁপা কে ফোন দেয় না। ফোন না দেওয়ার জন‍্য না না অজুহাত দেখায়। এমন কি চাঁপার স্কুল না আসার কারণ জানতে চাইলে কিছু না বলেই ফোন কেটে দেয়। চাঁপার বাবার আচরণ আমাকে খুব অবাক করত আর খুব অদ্ভুত লাগত। চাঁপাদের বাড়ি আমাদের গ্রামের একটা গ্রাম পরে। বাড়ি থেকে আমাকে একা একা চাঁপাদের বাড়ি যেতে দেবে না ওর খবর করতে। আর তাছাড়া আমি ওদের বাড়ি এর আগে কখনও যায়নি। শুধু ওদের গ্রামের নাম জানি। আর জানি ওর বাবার নাম সনাতন রুইদাস ও মা মেনকা রুইদাস। ওরা তিন বোন একভাই।এছাড়া ওদের সঙ্গে থাকে ওর বিধবা পিসি ও পিসির মেয়ে আর ওর ঠাকুরদা ঠাকুমা। ওর বাবা মা দুজনেই ঠিকা শ্রমিকের কাজ করে যেটুকু রোজগার করে তাতেই ওদের সংসার চলে। চাঁপাই ভাই-বোনদের মধ‍্যে বড়ো।


চাঁপার পরের বোনটা আমাদের স্কুলেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ওকেও দেখছি বেশ কিছু দিন ধরে স্কুলে আসছে না। কিন্তু কেন? কোন্ অজ্ঞাত কারণে তারা দুই বোনে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল ---তা ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর এক রবিবার হঠাৎ চাঁপা একটা অন‍্য নম্বর থেকে আমার মায়ের ফোনে ফোন করে জানাল ওর বাবা-মা ওর বিয়ের ঠিক করেছে। ও বিয়ে করতে রাজি না, কিন্তু বাড়ির লোক জোড় করে ওর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।সেজন্য বাড়ির লোক ওকে আর স্কুলে যেতে দেয় না। এমনকি বাড়ি থেকে কোথাও বেরতে দেয় না,বিয়েতে রাজি নয় বলে শারীরিক ও মানসিক অত‍্যাচর করে ওর বাবা-মা---বাড়ির কেউ ওর সাথে কথা বলে না---ভালো করে খেতে দেয় না---সঙ্গে চলে প্রচণ্ড মারধর---আজ সুযোগ পেয়ে পাশের বাড়ির এক দিদির মোবাইল থেকে আমাকে ফোন করছে----যাতে আমি ওকে এই বিপদে কোনো সাহায্য করতে পারি সেই আশায়---কাঁদতে কাঁদতে এক নিঃশ্বাসে ফিসফিস করে খুব নীচু গলায় কথা গুলো বলে যায় চাঁপা। সেই সঙ্গে জানায় জোড় করে ওর বিয়ে দিলে ও আত্মহত্যা করবে। কাঁদতে কাঁদতে বার বার আমাকে বলতে থাকে কিছু করার জন‍্য। কথার মাঝেই হঠাৎ করে 'রাখছি' বলে ফোন কেটে দেয় চাঁপা। বুঝলাম হয়তো ওর বাবা-মা বা বাড়ির কেউ এসেছে তাই ফোন কেটে দিল। চাঁপার কথা গুলো শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। মা আমার চিরকালের বান্ধবী তাই মাকে সব কথা বললাম। মা শুনে বলল--- কী করব বল,ওদের এরকমই হয়। আমি মাকে বলি এটা তো বেআইনি,আমি পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে পড়েছি মেয়েদের বিয়ের বয়স একুশ বছর। তার আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া বেআইনি।


 সব শুনে মা বলল-- সে আমিও জানি । কিন্তু কিছু করার নেই ওদের সমাজে একরম হয়, ছোটো বয়সেই ওদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের কথা শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আর বারবার চাঁপার কান্না ভেজা গলায় বলা কথা গুলো কানে বাজতে লাগল। সেই সঙ্গে ওর আত্মহত্যার কথাটাও। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আমি খেতে পারিনি এমনকি সারারাত আমি ঘুমাতে পরিনি। আমিও সারারাত কেঁদেছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিল ---ওদের সমাজের নিয়ম---ওদের অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথাটা। কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা দেখে মা বলল, বাবাকে দিয়ে চাঁপার বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করবে।সেই মতো আমার বাবা চাঁপার বাবার সঙ্গে কথা বলল। তাকে আইনের কথা বলল। কিন্তু চাঁপার বাবা জানাল তার মতো খেটে খাওয়া মানুষ এ সব শুনে কী করবে?ভালো ছেলে পেয়েছে তাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। দু-একবছর পর তো দিতেই হতো।এখন ভালো ছেলে হাত ছাড়া হয়ে গেলে যদি আর না পায়।তাছাড়া ছেলের বাড়ি নাকি দেনাপাওনা বেশি নিচ্ছে না। ছেলে একটা কারখানায় কাজ করে। এরকম ভালো ছেলে বা পরিবার পরে যদি না পায় তাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বাবা চাঁপার পড়াশোনায় ভালো হওয়া--- বুদ্ধির প্রশংসা করে--- ক্লাসে প্রথম হওয়ার কথা বলে। সে সব শুনে ওর বাবা জানায় --- ও সব দিয়ে কী হবে? চাঁপা তো আর সরকারি চাকরি করবে না। সেই তো রান্না করবে ঘরদোর সামলাবে --- তাই আর পড়াশোনার দরকার নেই। সেভেন পর্যন্ত পড়েছে ,নিজের নাম লিখতে জানে এর বেশি আর দরকার নেই। তাছাড়া তার মতো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের পক্ষে সংসারের খাওয়া-দাওয়া -- ডাক্তার-বদ‍্যি---ওষুধ--- পোশাক-আশাক এর খরচের পর আর পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়। সংসারে এতো গুলো লোক কে দু-বেলা পেট ভরে খেতে দিতে হিমসিম হাচ্ছে --- তার উপর আবার পড়াশোনা! তাছাড়া চাঁপার আরো দুটো বোন আর একটা ভাই আছে। তার ওই স্বল্প রোজগারে আর এতো সম্ভব হচ্ছে না ---এই বলে চাঁপার বাবা বেশ বিরক্তি আর রাগের সঙ্গেই ফোন কেটে দেয়।


চাঁপাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে আমার খাওয়া ঘুম সব চলে গেল। ফলে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে বেশ কিছু দিন পর স্কুলে গেলাম। আমার মুখ চোখের আর শরীরের অবস্থা দেখে আমাদের ক্লাসের বাংলা শিক্ষিকা ত্রিপর্ণা দিদিমণি আমার কী হয়েছে জানতে চান। সেই সঙ্গে আমার প্রাণের বান্ধবী চাঁপা(স্কুলেও সবাই ওর ডাক নামটা জানে) কেন স্কুল আসছে না তাও আমার কাছে জানতে চান। চাঁপার নামটা শুনেই আমি কেঁদে ফেলি। আমাকে কাঁদতে দেখে দিদিমণি আমার কাছে এগিয়ে আসেন এবং আমার পিঠে হাত বুলিয়ে চুপ করতে বলেন। দিদিমণি হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আমার ব‍্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে চোখ মুখ ধুয়ে জল খেয়ে আসতে বলেন। দিদিমণির কথা মতো আমি ক্লাসের বাইরে গিয়ে চোখে জল নিয়ে আসি। তারপর দিদিমণি আমাকে টিফিনে টিচার্স রুমে দেখা করতে বলেন।আমিও সেই মতো টিফিনে টিচার্স রুমে যায়।আমাকে দেখে দিদিমণি চেয়ার থেকে উঠে টিচার্স রুমের বাইরের বারান্দায় থাকা বেঞ্চে আমাকে বসতে বলে আমার ঠিক পাশে বসলেন। তারপর ক্লাসে আমার কান্নার কারণ কী জানতে চাইলেন? আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন আমি যেন কিছু গোপন না করে নির্ভয়ে সমস্ত কথা তাকে জানায়। স্নেহের পরশ পেয়ে আমি আবার আবেগ বিহ্বল হয়ে পরি।কোনো ক্রমে কান্নার বেগ সামলে নিয়ে কান্না ভেজা ধরা গলায় দিদিমণির কাছে চাঁপার বিষয়ে সব কথা জানায়।আর চাঁপার এই ঘটনা থেকে আমি অসুস্থ হয়ে যায় ও স্কুলে আসতে পারিনি সে কথাও জানায়। আমার সব কথা শুনে দিদিমণি আমাকে তার বুকের কাছে টেনে ধরলেন আর কাঁদতে নিষেধ করলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন--- চাঁপার বিয়ে কবে?আমি বিয়ের সঠিক তারিখটা জানতাম না। তাই বলতে পারলাম না। এতোদিনে বিয়ে হয়ে গেছে কিনা সে বিষয়ে কিছু জানি কিনা দিদিমণির সেই প্রশ্নের উত্তরেও আমি কিছু জানিনা বললাম। এ বিষয়ে সঠিক খবর কে দিতে পারবে? ---দিদিমণি একথা বললে আমি চাঁপাদের গ্রামের একটা মেয়ের নাম করলাম যে আমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আমার কথা শুনে দিদিমণি ওই মেয়েটিকে আমাকে টিফিনের শেষে ক্লাস থেকে ডেকে আনতে বললেন। সেই মতো টিফিন শেষে আবার ক্লাস শুরুর ঘন্টা পরলে আমি ওই মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে দিদিমণির কাছে নিয়ে যায়। দিদিমণি তার কাছে চাঁপার বিয়ের বিষয়ে সে কিছু জানে কিনা জানতে চান। মেয়েটি দিদিমণিকে জানাল সেও শুনেছে চাঁপা দিদির বিয়ে কিন্তু কবে তা সেও ঠিক জানেনা। তবে এক দুমাসের মধ‍্যে বিয়ে সেটা গ্রামের সবাই জানে।মেয়েটির কথা থেকে শুনে দিদিমণি বললেন ---তার মানে বিয়ে এখনও হয়নি।আর বিয়ের বিষয়ে গ্রামে সবাই জানে।


মেয়েটিকে ক্লাসে যেতে বলে দিদিমণি থানায় ফোন করে সব জানালেন। আমার কাছ থেকে চাঁপার বাবার নাম ঠিকানা জেনে নিয়ে পুলিশ কে ফোনে সব জানালেন। পুলিশ দিদিমণি ও আমাকে--- 'বিষয়টি দেখছি'-- বলে আশ্বাস দিলেন। সেই সঙ্গে কী হচ্ছে তা পরে দিদিমণি কে ফোন করে জানাবেন বললেন। দিদিমণি আমাকে বললেন থানা থেকে কিছু জানালে তিনি আমাকে ফোনে জানাবেন। তাই দিদিমণি কে মায়ের ফোন নম্বরটা দিয়ে এলাম।


বাড়ি ফিরে মা কে স্কুলের সব কথা বললাম।আর দিদিমণির ফোনের অপেক্ষায় মায়ের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম।স্কুল থেকে ফেরার ঘন্টা খানেকের মধ‍্যেই দিদিমণি ফোন করে জানালেন পুলিশ চাঁপাদের বাড়ি গিয়েছিল। আর ওর বাবা মাকে বুঝিয়ে এসেছে ওরা যেন একুশ বছরের আগে মেয়ের বিয়ের ব‍্যবস্থা না করেন। চাঁপার বাবা-মা পুলিশ কে কথা দিয়েছে তারা মেয়ের অমতে আর বিয়ে দেবে না। আর একুশ বছরের আগে মেয়ের বিয়ের ব‍্যবস্থা করবে না। সেই সঙ্গে তারা এও বলেছে দুই মেয়েকেই আবার স্কুলে পাঠাবে। দিদিমণির মুখ থেকে কথা গুলো শুনতে শুনতে আমার দু-চোখ বেয়ে জল ঝরে পড়তে লাগল। দিদিমণি ফোন রাখার পর মা বাবাকে সব বললাম তারা খুশি হলেন আর সেই সঙ্গে আমাকে এবার ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে--- ঘুমাতে আর পড়াশোনা করতে বললেন। মনটা আজ সত‍্যি অনেক দিন পর আনন্দে ভরে উঠল।মনে মনে ভাবলাম আমার প্রিয় বান্ধবী আবার স্কুলে আসবে। আমরা আবার স্কুলে একসাথে পড়ব-- মজা করব ---এই সব ভেবে আমার মন খুশিতে নেচে উঠল।



পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম চাঁপা বা চাঁপার বোন কেউ স্কুলে আসেনি।

এভাবে একমাস কেটে গেল কিন্তু ওরা স্কুলে এল না। ওরা কেন স্কুলে আসছে না?--- তা জানার জন্য চাঁপাদের গ্রামের সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কিন্তু ওদের ক্লাসের অন‍্য মেয়েরা জানাল ওই মেয়েটি আজ আসেনি। তাই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম। পরদিন স্কুলে ওই মেয়েটি নিজেই টিফিনের সময় আমার সঙ্গে দেখা করে জানাল আজই চাঁপার বাবা-মা ভাই বোন সহ গোটা পরিবার চাঁপার মামার বাড়ি গিয়েছে। আর ওর মা চাঁপার মায়ের কাছ থেকে জেনেছে মামার বাড়ি থেকেই আগামীকাল চাঁপার বিয়ে দেবে ওরা।মেয়েটার মুখ থেকে একথা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণের জন‍্য বসে থেকে গেলাম। তারপর ওই মেয়েটার হাতের ঠেলায় চেতনা ফিরতেই ছুটলাম টিচার্স রুমে ত্রিপর্ণা দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি দিদিমণির শ্বশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাই বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে দিদিমণি বাড়ি চলে গেছেন। এখন আমার কী করা উচিৎ তা ঠিক করতে পারছিলাম না। হাতে সময়ও অল্প। অবশেষে মনস্থির করলাম আমি নিজেই থানা যাব। কিন্তু থানা যাওয়ার রাস্তা জানি না। আমার সাথে থাকা চাঁপাদের গ্রামের ওই মেয়েটিকে আমার সাথে থানা যাওয়ার জন‍্য বললাম কিন্তু ও রাজি হলো না। ওর বাড়ির লোক জানতে পারলে ওকে ভীষণ বকাবকি করবে সেই ভয়ে ও যেতে চাইল না। তবে ও থানা যাওয়ার রাস্তাটা আমাকে বলে দিল। অগত্যা আমি একাই স্কুল থেকে থানা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় বাবার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে সব কথা বলে আমাকে তার গাড়িতে করে থানায় দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতে বললাম। বাবার সেই বন্ধু আমাকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে অফিসারের কাছেও গেল।অফিসার সব শুনে আমাকে আর ওই কাকুকেও ওনাদের সঙ্গে গাড়িতে চাঁপার মামার বাড়ি যেতে বললেন।আমরা রাজি হয়ে গেলাম। বাবার সেই বন্ধু বাবাকে ফোন করে সব কথা জানাল। বাবাও গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে সোজা থানায় চলে এল।পুলিশ অফিসার আমার কাছে চাঁপার মামার বাড়ির ঠিকানা বা মামার নাম ---এ সব জানি কিনা জানতে চাইলেন। কিন্তু আমি জানিনা বলাতে ওনারা সবার প্রথম আমাদের সঙ্গে নিয়ে চাঁপাদের গ্রামে গিয়ে ওর মামার বাড়ির ঠিকানা গ্রামের লোকের কাছ থেকে জেনে নিলেন। তারপর সেই পুলিশ অফিসার চাঁপার মামার বাড়ি যে গ্রামে সেখানকার থানাতে ফোন করে সব জানালেন ও প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। তারপর ওই পুলিশের গাড়িতে আমাদের গ্রামের থানার পুলিশ অফিসার সহ আমি, বাবা, বাবার বন্ধু উপস্থিত হলাম চাঁপার মামার বাড়ি খয়রাশোল গ্রামের থানাতে। সেখান থেকে পুলিশের গাড়িতেই আমরা, খয়রাশোল থানার পুলিশ, বিডিও সাহেব সহ আরো কিছু কর্তা ব‍্যক্তি স্থানীয় লোক গিয়ে হাজির হলাম চাঁপার মামার বাড়িতে। সেখানে পৌঁছে দেখি বিয়ের সানাই বাজছে।এর মধ‍্যে বরযাত্রী সহ বর বিয়ে করতে চলে এসেছে---ছাদনা তলায় বিয়ের জন্য বসে পড়েছে---বাড়ি ভর্তি লোকজন--- হাসি ----আনন্দ। পুলিশ দেখে তো চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় চাঁপার বাবা মা ও বর সহ উপস্থিত সমস্ত লোকজনের। পুলিশ অফিসার ও বিডিও সাহেব মেয়ে ও ছেলে উভয়পক্ষের বাড়ির অভিভাবকদের বকাবকি করেন। সেখানে পৌঁছে জানা যায় শুধু মেয়ের না,বরেরও বিয়ের বয়স হয়নি। এটা শুনে ছেলে ও ছেলের বাবা কেউ তিরস্কার করেন পুলিশ আধিকারিকরা।বিডিও সাহেব চাঁপার বাবা-মাকে কন‍্যাশ্রী,রূপশ্রী প্রকল্পের কথা জানায়।প্রকল্প গুলির সুবিধার কথা বোঝান। চাঁপার বাবা পূর্ব প্রতিশ্রুতি না রাখায় ও জেনে শুনে বেআইনি কাজ করছিল বলে বরের বাবা ও মেয়ের বাবা মাকে গ্রেফতার করেন।অবশেষে সকলের অনুরোধে পাত্র ও পাত্রী পক্ষের কাছ থেকে ছেলে ও মেয়ের আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স না হওয়ার আগে বিয়ে দেবে না--- আর সঠিক বয়সে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে---বর ও তার বাবার কাছে এই মুচলেকা নিয়ে তাদের মুক্তি দেন পুলিশ আধিকারিকরা। বিয়ে বন্ধ হওয়ায় চাঁপা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে--- তুই আমার জীবনে একমুঠো রোদ্দুর---আমার অন্ধকার জীবনে তুই আলো নিয়ে এলি---তোর এই ঋণ আমি কখনও ভুলব না ।ওর কান্না দেখে আমিও নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। আমাদের দুজনের চোখে তখন বাঁধ ভাঙা আনন্দের অশ্রু। উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকরা আমার সাহসের ভূয়সী প্রশংসা ক‍রেন।

একরাশ আনন্দ নিয়ে সেদিন বাবার সাথে বাড়ি ফিরলাম।ঘটনার দু তিন দিন পর চাঁপা স্কুলে এল।আমার সাহসের কথা গোটা স্কুলের মেয়েদের শোনানো হল। সংবাদ পত্রেও এই ঘটনার কথা প্রকাশিত হলো। স্কুল ও বিডিও অফিস থেকে আমাকে আর চাঁপাকে পুরস্কৃত করা হল।

তারপর কত দিন কেটে গেছে। চাঁপা মাধ‍্যমিকে আমাদের স্কুল থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে এখন সাঁইথিয়া হাই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।চাঁপা এখন কন‍্যাশ্রীর টাকা,নিজের স্কলারশিপের টাকা আর পাশাপাশি কিছু টিউশনি পড়িয়ে নিজের আর ভাই বোনদের পড়ার খরচ চালাচ্ছে।মাধ‍্যমিকের পর আমার বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে সিউড়ি চলে এলে মা ও আমি বাবার সাথে সিউড়ি চলে আসি। আমি এখন সিউড়ির 'রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর উচ্চ বালিকা বিদ‍্যালয়'-এ একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। এতোদিন পরেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে। আজও আমরা সেই দিনের কথা ভুলতে পারিনি।

চাঁপার এই ঘটনার পর থেকে আমাদের কোটাসুর গ্রাম সহ আশেপাশের গ্রামেও আর অল্প বয়সে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়না।এখন আইন অনুযায়ী ছেলে মেয়ের বিয়ের বয়স হলে তবেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics