::দুই সংসার::
::দুই সংসার::
কড়াইয়ের গায়ে খুন্তিটা আজ একটু বেশি জোরেই নড়ছে। ছাদে কাক বসতে পারছে না। যদিও এটা প্রতিদিনেরই ঘটনা। একদিকে স্কুলের ইউনিট টেস্টের খাতা দেখা। তার পাশাপাশি মাধ্যমিকের খাতা দেখা সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গার্ড এর ডিউটি পাশাপাশি তারও খাতা দেখার ব্যস্ততা। স্কুলের কাজের সঙ্গে সংসারের কাজ-কর্মের চাপ। সব মিলিয়ে ব্যস্ততার চূড়ান্ত অবস্থা নীলার। এর মাঝে পোয়াতি মেয়ের মতো বাঙাল স্বামীর খাবারের আবদার এক একদিন এক একরকম। আমার মা এটা ভালো রাঁধতো আমার মা ওটা ভালো রাঁধতো। মায়ের হাতের অমুক তরকারিটা আজও আমার মুখে লেগে আছে। মা চলে যাওয়ার পর থেকে অমুক জিনিসটা আর খাওয়ায় হয় না--এ সব প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয় স্বামী স্বরূপের থেকে নীলা কে। মায়ের হাতের লাউ চিংড়ির কথা মনে পড়ায় আজ বাজার থেকে পাঁচশো কুচো চিংড়ি আর একটা তিলে লাউ কিনে এনেছে স্বরূপ-- লাউ চিংড়ি খাবে বলে।আর তাতেই নীলার মেজাজ উঠেছে পঞ্চমে। রান্না ঘর থেকে রাগে গজগজ করে বলে চলেছে--আমার দিকে কারো নজর নেই। স্কুলের কাজ সামলাব না সংসার। একা হাতেই আমাকে সব করতে হয়। কেউ তো সাহায্য করার নেই। কী কুক্ষণে যে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম কে জানে। রূপের মোহে গলে গিয়ে প্রেমে পড়ে আজ আমার এই দুর্গতি। বিয়ে আবার মানুষে করে-- গজ গজ করতে করতে বেশ চিৎকার করে এক নাগাড়ে রান্না ঘর থেকে কথা গুলো বলে চলে নীলা ।
নীলা আর স্বরূপ স্কুলে পড়ার সময় প্রেমে পড়ে। তারপর স্বরূপের চাকরি হতেই দু-বাড়ির সম্মতিতে বিয়ে। বিয়ের পরের বছরই স্কুল সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষিকার চাকরি পায় নীলা। তার দেড় বছর পর তাদের মেয়ে হয়--টিনা। স্বরূপ আর নীলা সমবয়সী হওয়ায় ওদের খুনসুটিটা একটু বেশি।নীলাকে রাগাতে স্বরূপের বেশ ভালোয় লাগে।বিয়ের এতো বছর পরেও ওদের প্রেমে মরচে ধরেনি। দুজনের বয়স হলেও ছেলে মানুষিটা দুজনের মধ্যে এখনও বিদ্যমান। তবে স্বরূপের মধ্যে সেটা একটু বেশিই। তাই ইচ্ছা করেই ও এমন কাজ করে যাতে নীলা রেগে যায়। তবে নীলা রেগে গেলে স্বরূপ কিছু বলে না শুধু হাসে আর মজা দেখে। আর স্বরূপের দোসর হয় মেয়ে টিনা। দুজনে মাঝে মাঝে দু-একটা ফোড়ন কেটে নীলাকে আরও রাগিয়ে দেয়।দুজনেই চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হলেও তারা পুণরায় চাকরিতে বহাল হয়েছে সরকারের নতুন নিয়ম অনুযায়ী।
মাছ এনে কী একটা বলতে গিয়ে একবার মুখ ঝামটা খেয়েছে তাই ভয়ে আর কিছু বলতে যায় না স্বরূপ।মেয়ে টিনাও বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একবার বকুনি খেয়েছে তাই সে ও চুপ। কিন্তু বাপ-মেয়ে সকলে নীলার এই রাগ মিশ্রিত ভালোবাসাটা বেশ উপভোগ করছিল।
সোহাগ করে স্বরূপ বলল- আমি বেছে দেবো চিংড়িটা? শুনেই আরও তেলে বেগুনে জ্বলে গেল নীলা। চিৎকার করে বলে উঠল--থাক অনেক করেছ আর আমার প্রতি মায়া দেখাতে হবে না। যেমন বাপ তেমন মেয়ে। এতো বড়ো মেয়ে যদি মাকে হাতে হাতে একটু সাহায্য করে। এই বয়সে আমি মায়ের সাথে সাথে কতো কাজ করতাম।আর উনি বাবার সোহাগি হয়ে বসে আছেন। মেয়েকে বকছে দেখে স্বরূপ বলে উঠল--আহা, ওকে বকছো কেন?ও আবার কী করল? স্বরূপের কথা শুনে নীলা বলল , না না ওকে বকব কেন? সোহাগ দিয়ে আগলে রাখো । কলেজে পড়ছে এখনও বাড়ির একটা কাজ করতে জানে না।পরের বাড়িতে যখন যাবে তখন দেখবে মজা। একটু চুপ করেই আবার শুরু করল নীলা-- সব বুঝি বুঝলে সব বুঝি--পেয়ে গেছ তো আমাকে তাই করিয়ে নিচ্ছো । পড়তে অন্য মেয়ের পাল্লায় তাহলে বুঝতে কত ধানে কত চাল। আমার প্রতি যদি তোমার মায়া থাকতো থাকলে তুমি চিংড়ি মাছটা আজ আনতে না। জানোতো আমার পরিস্থিতি আমার ব্যস্ততা তাও যখন তোমার নজরে পড়ে না তখন দরকার নেই--নিজের কাজ করো গা যাও--অফিসের জন্য তৈরি হও--খাও দাও অফিস যাও। আমার কী হচ্ছে-- কী করে হচ্ছে-- সে সব তোমার জানার দরকার নেই।
নীলার মেজাজটা একটু ঠান্ডা হয়েছে মনে হল স্বরূপের ।তাই বলে উঠল কী করব বলো দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না যে।স্বরূপের কথা বিকৃত করে নীলা বলল,-- হ্যাঁ এতো কষ্ট করে তো রাঁধবো তারপর শুনতে হবে মায়ের মতো হয় নি।এই কথার পর সকলেই হা হা করে হেসে উঠল। সকালের মেজাজের মেঘটা যেন একটু লঘু হয়েছে।
সবই আমার কপাল বুঝলে। যেমন তোমরা তেমনি আমার কাজের মেয়ে।সে যে একটু বাড়তি কাজ করবে তা তিনি করবেন না।অন্য বাড়ির কাজের মেয়েরা একটু আধটু মাছ-টাছ ধুয়ে বেছে দেয় কিন্তু আমাদের মহারাণীর ওসবের বালাই নেয়। উনি মহারাণী ওই ঘরের কাজটুকু ছাড়া কুটোটি কেটে উপকার করবে না।
সকাল থেকে চলা এই আবেগ ও প্রেম মিশ্রিত ঝগড়া একটু থামে নীলার রান্না ঘরের জানলার সোজাসুজি মালতি বৌদির কথায়। মালতি বৌদি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জানতে চায়--কী হয়েছে নীলা,ঠাকুরপো আজ আবার কী করল? মালতি বৌদির কথা শুনে নীলা বলে উঠল--আর বলোনা দিদি,তোমার ঠাকুরপোর কবে আক্কেল হবে কে জানে? জানোতো আমার স্কুলের কাজের কেমন চাপ ।একদিকে খাতা দেখা গার্ড দেওয়া আমি হিমশিম হাচ্ছি।কোনো রকমে একটা ডাল - ভাত - একটা তরকারি করে খায়য়ে দায়য়ে স্কুলে যাব সে ব্যবস্থা করছি।আর উনি মায়ের হাতের লাউ চিংড়ির কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে কুচো চিংড়ি আর লাউ এনে হাজির করেছেন।এখন মাছ বাছব না লাউ কাটব না রান্না করব কখন কী করব কিছু বুঝতে উঠতে পারছি না।কী করে সব সামলে যে টাইমে স্কুলে যাব ভেবে পাচ্ছি না। মাছটা ফিজেও রাখতে পারব না কারণ আমি ফিজ আমিষ করিনি।আবার সন্ধ্যায় এসে বাছব তাও হবে না নষ্ট হয়ে যাবে।সোনুর মাকে বললাম একটু বেছে দাও মাসি,তো উনি মহারানী বললেন উনি ওসব পারবেন না আরও দুটো বাড়িতে কাজ করে মিটিংএ যাবেন উনি। কাউকে কিছু বলার নেই বুঝলে দিদি । কী করব বুঝতে পারছি না।নীলার কথা গুলো শুনে মালতি বৌদি বলল--আমাকে দাও।আমি লাউ কেটে দিচ্ছি ও তাড়াতাড়ি করে চিংড়ি গুলো বেছে দিচ্ছি। মালতি বৌদির কথা শুনে যেন ধড়ে প্রাণ প্রায় নীলা বলে, তুমি বেছে দেবে দিদি, তাহলে তো খুব সুবিধা হয়।
কথা মতো মালতি বৌদি লাউ কেটে ও চিংড়ি মাছ গুলো বেছে পাঠিয়ে দেয় নীলাকে। নীলাও হাসি মুখে লাউ চিংড়ি রান্না করে স্বরূপের উদ্দেশ্যে বলে খেয়ে দেখো মায়ের মতো হয়েছে কিনা? আমার মা সোহাগি।
আজ অনেক দিন পর মালতি বৌদির বাড়িতেও মাছ হলো।কারখানায় স্বামীর কাজ চলে যাবার পর থেকে ভাত জোটানোয় দায় হয়ে গেছে--সেখানে আবার মাছ! মাঝে মাঝেই নীলার সবজি কেটে দেওয়ার অছিলায় সবজির ফেলে দেওয়া অংশে বা মাছ বেছে দেওয়ার অছিলায় মাছের কানকো পাখনা দিয়ে কোনো রকমে সাধ মেটাতে হয়। আজ ও চিংড়ি মাছের খোলা,দাঁড়া দিয়ে মাছ খাওয়ার সাধ মিটালো মালতি বৌদি। কারণ তার স্বামীও যে লাউ চিংড়ি খেতে ভালোবাসে ।