এভাবেই গল্প হোক
এভাবেই গল্প হোক
এই আবহাওয়াটা একদম ভালো লাগে না। সারাদিন ধরে মেঘলা আকাশ, গুরু গুরু মেঘের গর্জন আর ঝিরঝির বৃষ্টি! রাস্তাঘাটের অবস্থাও কাদা জমে তথৈবচ। প্যান্ট গুটিয়ে জল, কাদার মধ্যে দিয়ে কিৎকিৎ খেলতে খেলতে বাড়ি ফিরতে হবে এখন। ভালো লাগে নাকি! তেলেভাজার দোকানটাও খোলে নি। একটু ঝাল তেলেভাজা খেতে খেতে বাড়ি ফেরা যেত না হয়। যাই হোক, রওনা দিলাম বাড়ি ফিরবার উদ্দেশ্যে। কলেজের সামনেটায় বেশি কাদা জমে, বাপ রে বাপ! পা পিছলে না পড়ে যাই আবার! আমি এখন কম্পিউটার সাইন্সে পি.এইচ.ডি করছি। স্যারের সাথে একটা জিনিস নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসতে হয়েছিল। বৃষ্টির দিন, ভাবছিলাম কাটিয়ে দেব। কিন্তু না, জরুরি দরকার ছিল, অগত্যা আসতেই হল।
একটা সরাসরি বাস আছে বটে, কিন্তু সে বাস এই আবহাওয়ায় কখন পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। তার থেকে বরং একটা বাসে রবীন্দ্র-পার্ক অবধি যাই, ওখান থেকে বেশ কয়েকটা বাস পাওয়া যায়। সেই ভালো বরং। দেখতে দেখতে চলেও এলাম রবীন্দ্র-পার্ক। উল্টোদিকে চায়ের দোকানটা খোলা আছে। বৃষ্টিটাও একটু থেমেছে। একটু চা বিস্কুট খেয়ে বরং পরের বাসটায় উঠব। আজ বর্ষা-বাদলের দিনে এমনিতেই খুব বেশি ভিড় হবে বলে মনে হয় না। পাশে একটা স্ন্যাক্সের দোকানও খোলা রয়েছে। নাহ! বাড়ি ফিরে তো মুড়ি চানাচুর খাবই। এখন শুধু চা-বিস্কুটটাই খাই বরং।
- দাদা, একটা চা দিন তো?
- বড়, মিডিয়াম নাকি ছোট? লিকার, দুধ নাকি লেবু?
- একটা বড় দুধ।
- বসুন। দিচ্ছি।
কাঁচের বয়াম থেকে দুটো বিস্কুট বার করে সামনের বেঞ্চিটায় বসলাম। রোজ এই সময়টা পশ্চিম আকাশটাকে লালচে রঙে রাঙিয়ে সূর্যটা অস্ত যায়। আজ আর সেসবের বালাই নেই। একটা কালো আকাশ। না আছে মেঘ, না আছে সূর্য। আকাশের বুকের ক্যানভাসটায় যে আঁকিয়ে ছবি আঁকেন সে আজ ছুটি নিয়েছে বোধহয়।
- দাদা, চা-টা নিয়ে যান।
- ও হ্যাঁ।
বেশ ভাবসাগরে ডুব দিচ্ছিলাম। দোকানের ছেলেটার কর্কশ গলার শব্দ আমায় সোজা ভাবসাগর থেকে চুলের মুঠি ধরে বাস্তবে নিয়ে এল।
নাহ, চা-টা খুব ভালো বানিয়েছে, বেশ জমিয়ে আদা ফাদা দিয়ে জম্পেশ একটা চা। একটা সিগারেট ধরালে মন্দ হয় না। গরম চায়ের সাথে ভালোই জমবে এই মুহূর্তে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করলাম। লাইটারটা ওই দিকে ঝুলছে দোকানটাতে। বেঞ্চ থেকে উঠতেই হবে। চায়ের প্রথম চুমুক নিয়ে তারপর সিগারেটে মারলাম প্রথম টান। চায়ের ধোঁয়া আর সিগারেটের ধোঁয়া মিলমিশ খেয়ে একটা দারুণ মায়াবী ব্যাপার তৈরি করেছে কিন্তু। রাস্তা দিয়ে হু হু করে বাস গাড়ি সব চলেছে। একটু পরেই রাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্প, বাস, গাড়ির হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠবে। ভেজা রাস্তায় সেই আলোর বিচ্ছুরণ হবে। ভেজা শহরটাকে দারুণ লাগে কিন্তু সন্ধ্যেবেলায়।
একটা দামি ঝাঁ চকচকে গাড়ি এসে থামল পাশে। ও বাবা! এই দামী গাড়ি করে এই রাস্তার দোকানে চা খেতে এসেছে নাকি! বেঁচে থাকতে কত কিছুই না দেখতে হবে! ও, না! পাশের স্ন্যাক্সের দোকানটা থেকে কিছু কিনবে। সাদা ধবধবে শার্ট আর গাঢ় নীল রঙের ট্রাউজার পরিহিত একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে স্মার্টলি স্ন্যাক্সের দোকানটায় গেল। দোকানের চার্টটা একঝলক দেখে অর্ডার দিল “থ্রি চিকেন ম্যাগি উইথ এক্সট্রা চিস। প্যাক করবেন। নিয়ে যাব”।
জুঁই না? হ্যাঁ জুঁই-ই তো। ও আমাকে খেয়াল করেনি? না মনে হয়। আমি গিয়ে কথা বলব? না, না উচিত হবে না। কি ভাববে! থাক বরং। এতদিন পর জুঁইকে দেখে প্রথমে গিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করলেও মন সায় দিল না। এরম প্যান্ট গুটিয়ে রয়েছি, দুমড়ানো একটা টি-শার্ট পরে আছি। এইভাবে যাবো না ওর সামনে। ও অফিস থেকে ফিরছে মনে হয়। এই সময় এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে গেলে অপ্রস্তুতেও পড়ে যেতে পারে। কি দরকার! থাক বরং। কিন্তু ও যদি আমায় দেখে ফেলে! ভাববে আমি দেখেও কথা বলিনি। সেটাও তো খারাপ হবে। এক কাজ করি বরং! চা দোকানের ভেতরের বেঞ্চিটায় গিয়ে বসি। ওখানে বসলে খেয়াল করবে না আমায়, আর খেয়াল করলেও অজুহাত দেওয়া যাবে “আমি দেখতে পাইনি” বলে। সিগারেটটা কি করা যায়?এখনো অর্ধেকের বেশি পড়ে আছে। পাঁচ ছয় বছর আগে হলে জুঁই নিজে এসেই আমার হাত থেকে সিগারেটটা টেনে নিয়ে ফেলে দিত। কি জানি, কি মনে হল, ফেলেই দিলাম সিগারেটটা। পাশের মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক অবাক হয়ে দেখলেন আমি সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিলাম। আমার মুখে অদ্ভুত একটা হাসি লেগে আছে। বড্ড অদ্ভুত! পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের হাসি, ভারাক্রান্ত হৃদয়ের হাসি আর মধ্যবয়স্ক যে ভদ্রলোক দেখলেন আমি অর্ধেকটা সিগারেট ফেলে দিলাম তাকে ম্যানেজ দেবার হাসি – এই তিন হাসি একসাথে মিশে অদ্ভুত অন্যরকম একটা হাসি তৈরি করেছে আমার মুখে।
আরো স্মার্ট হয়ে গেছে জুঁই, তাছাড়া সাদা আর গাঢ় নীল শার্ট প্যান্টে বেশ ভালো মানিয়েছেও। এখন আমার সাথে জুঁইয়ের টুকটাক যোগাযোগ আছে বলতে ওই হোয়্যাৎস্যাপে মাঝেমধ্যে বার্থডে উইশ কিংবা বছরে এক দু বার “কেমন আছিস?” তাও তার উত্তর তখন না দিয়ে দিন এক-দুই পরই দেওয়া হয়। অথচ বেশ কিছু বছর আগে, ওর ম্যাসেজ না এলে মনের ভেতরটা কেমন করত! বন্ধু বান্ধবরা বলত আমরা দুজন নাকি একে অপরের প্রেমে পড়েছি। অবশ্য সেটা সত্যিই প্রেম ছিল কিনা বুঝতাম না, আজও বুঝিনি। তবে বন্ধুগুলো সবসময় প্রমাণ করার চেষ্টা করত যে আমরা প্রেম করছি নাকি। এই যেমন কোনো শপিং মলে গেলাম সবাই মিলে, তারপর আমাদের দুজনকে দোকা রেখে সবাই চলে যেত। বাইরে থেকে রাগ দেখালেও দুজনই ব্যাপারটায় ভেতরে ভেতরে আনন্দই পেতাম। তারপর আর কি! ও কোন একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরিতে জয়েন করল আর আমি আরো পড়াশুনা করব বলে একাডেমিক লাইনেই থেকে গেলাম। আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমতে লাগল। তাছাড়া, ও বা বাকি বন্ধু বান্ধবরা চাকরি বাকরি করে বেশ ভালো স্যালারি পাচ্ছে, আমি সেখানে ওই কটা টাকা স্টাইপেন্ড পাই। মুখে যতই সবাই বলুক, ওসবে কিছু যায় আসে না, কিন্তু বাস্তবে তো যায় আসে। আমিও সেসব ভেবে ধীরে ধীরে সবার সাথেই প্রায় যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম, জুঁইয়ের সাথেও। মাঝে মাঝে পুরোনো কথা মনে পড়ে। ভাবি নিজে নিজে, আর টুকটাক “হাই, হ্যালো”, এইটুকুই অবশিষ্ট আর কি।
নাঃ! আকাশটা আবার কালো করছে, উঠি এবার। জুঁই কখন ওর চিকেন ম্যাগি উইথ এক্সট্রা চিস নিয়ে চলে গেছে, পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে তা খেয়ালও করিনি। বাস পেয়েও গেলাম তাড়াতাড়ি। এই একটা দোষ এই বাসগুলোর। এখন লোক তুলতে তুলতে আস্তে আস্তে এগোবে। তারপর ডিপোর কাছে পৌঁছে পাই পাই করে ছুটবে। এখন বিরক্ত লাগে, আর তখন ভয় লাগবে। পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। এর মধ্যে আবার কে ফোন করল! স্যার ফোন করেছেন!
- হ্যালো, হ্যাঁ স্যার, বলুন।
- শোন, যে কাজটা আজ কলেজে দেখালি সেটা নিয়ে কথা বললাম। ওটা কাল প্রেসেন্ট করতে হবে। ইউনিভার্সিটির সব কলেজের ফ্যাকাল্টি প্লাস স্টুডেন্ট প্রেসেন্ট থাকবে কিন্তু।
- ও, পিপিটি বানাবো?
- হ্যাঁ, পিপিটি বানিয়ে ভালো করে প্রেসেন্ট করতে হবে। আর শোন, ভালো ড্রেস পরে আসিস। কাল ভালো করে প্রেজেন্টেশনটা দিলে আমরা আরো এগোতে পারি কাজটা নিয়ে ইন ফিউচার।
- ওকে স্যার।
- ওকে। সি ইউ টুমোরো।
ফোনটা রাখার পর বসার সিটও পেয়ে গেলাম। ভাগ্যদেবীও আজ সুপ্রসন্ন বলতে হবে। আজই প্রেজেন্টেশন বানিয়ে রাখতে হবে। কাল সকালে উঠে আবার দাড়ি কাটো রে, ভালো শার্ট প্যান্ট নামাও রে, বুট নামাও রে, কত্ত হ্যাপা মাইরি।
কাল ভালো ড্রেস পরব তো। ফিরবার সময় রবীন্দ্র-পার্কের ওই দোকানটায় চা খাব ক্ষণ। যদি জুঁই আসে আবার! কাল তো ভালো ড্রেস পরে থাকব, নিজে থেকেই কথা বলতে যাব। বাবার থেকে ব্লেজারটাও চেয়ে নেব কাল। একদম শ্যুটেড বুটেড হয়ে জুঁইকে গিয়ে বলব “কিরে কি খবর?” না, না, ওরম ড্রেসে ইংলিশেই বরং বলব “হাই, জুঁই! আফটার আ লং টাইম! হোয়াটস আপ?” হ্যান্ডশেক করব তারপর। আমার হাতে সিগারেটটা রাখব। ও বেশ হাত থেকে নিয়ে ফেলে দেবে আগের মতন। কিছু কথা শুরু হতে না হতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। ওর হাত ধরে ছুট্টে চা দোকানের শেডটার তলায় চলে আসব। দুজনেই একটু একটু ভিজে যাব বেশ। চশমার কাঁচে আর চুলে লেগে থাকা জলবিন্দুর উপর স্ট্রিট ল্যাম্প আর রাস্তার গাড়ি বাসের হেডলাইটের আলো বিচ্ছুরিত হবে। দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকব। মাঝের পাঁচ-ছটা বছর ভ্যানিস হয়ে যাবে মুহূর্তমধ্যে। বৃষ্টি কমলে দুজনে দুটো আইসক্রিম কিনে ফুটপাথ ধরে হাঁটব গল্প করতে করতে। কোনো সময়ের হিসেব থাকবে না, অন্তহীন রাস্তা ধরে হেঁটে চলব দুজন।
বাসটা এমন জোরে ব্রেক চাপল হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে সামনের দিকে পড়লাম। ভাগ্যিস ধরে বসেছিলাম। বেশ সুন্দর ভাবছিলাম, ভাবনাটার একদম বারোটা বাজিয়ে দিল। যাই হোক, এত ভেবে কি আর হবে! আর কয়েকটা স্টপেজ পর নামতেও তো হবে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। শহরটাকে কি সুন্দর লাগছে।
বাসে রেডিও চলছে মৃদু শব্দে। এফ.এম চলছে বোধহয়। তাতে গান বাজছে “এভাবেই গল্প হোক, আমাদের রূপকথায়…”