Ananya Podder

Drama Classics Inspirational

3  

Ananya Podder

Drama Classics Inspirational

দুঃখীর সুখ

দুঃখীর সুখ

4 mins
502


মোহন ঢাকী দালানে হেলান দিয়ে বসে আছে | পুজো শুরু হতে আর মাত্র দুদিন বাকি | আর তো তবে ডাক এলো না এবার | শূন্য উঠোনের ছাতিম গাছটার দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে | পাশে কখন ললিতা এসে দাঁড়িয়েছে, সে খেয়ালও নেই তার|


"কী গো, এখানে বসি বসি কী ভাবতেস?? "


"আর কী ভাবতাসি | আর মাইত্তর দুইডা দিন বাকি আসে, অথচো এহনো কোনো বাইনাই তো পাইলাম না রে | আমাগো চইলবো কী কইডা?? "


"তুমি অইত্ত ভাইব্ব না গো | কিসু তো একটা হইবোই | "


"কী আর হইবো | মা দুগ্গা মুখ তুইলা চাইলোই না | একটা বাইনাও পাইলাম না পূজায় | পুরা পূজা ঘরে বইসা কাটাইলাম | এহন জগদ্ধাত্রী পূজায়ও যদি কোনো ডাক না পাই তো সংসারের বাড়তি খরচা টুকু চালাইমু কী কইডা?? এহন কার দিনে দেব দেবীরাই বোধহয় দুঃখীর কথা ভাইবতে বসে না | আমাগো কাছে প্রণাম ছাড়া তো কিসুই নাই তেনার জন্য | "


"অইত্ত ভাইব্ব না গো , অইত্ত ভাইব্ব না | যা কপালে লিখন আসে, তাই হইবো | যাও, বেলা বইয়া যায়, তেল দিয়া পুকুরে ডুব দিয়া আসো| "


"হ, যাই | "


মোহন স্নানের জন্য পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলে ললিতা গলায় কাপড় জড়িয়ে বলে, " মা গো, রাইগ কইরো না যেনো | অভাবের ঘর, তায় উপর পুরা বছর সে রৈকম কোনো কাজ নাই | পূজার সময় আশা কইরা বইস্যা থাহে, যাতে দুইডা বাড়তি কাম আহে | তাও আহে নাই বইলা মানুষ টার মনে কইত্তো বেদনা | সে তো আর জানেনা, যে, এমন হওনে আমি কইত্তো খুশি হইসি | প্রতি বছর স্বামী, পোলা কাউরেই কাছে পাইনা পূজাতে | দুইডা পয়সার জন্য আমার সব টুকু জীবন, আমার সব টুকু সুখ আমার কাছে থাইকতে পারে না অই কয়ডা দিন | এই দুঃখ টা যে এক মাইত্র তুমিই জানো, মা | না আইলো দুইডা বেশি পয়সা, তাতে কী | সোয়ামি, পোলা নিয়া এই যে পূজার দিনগুলি কাটাইলাম, এইডাই বা কম কিসের কও ??... এই কথাডা কেমনে বুঝাইমু তারে ?? পূজার সময় সবায় যহন ঘরে ফিরে, আমার ঢাকী বর তহন ঘর ছাইড়া চইলা যায়, সাথে লইয়া যায় পোলাটারেও | পুরা পূজা আমি চোখের জলে ভাসি | এইবার পয়সা কম আইলেও আমি তো কাছে পাইসি আমার সোয়ামি আর পোলারে | এই সুখের আস টুহু যে পেট ভইরা ভাত খাওনের চাইতে কিসু কম না, এ কথা খান কেউ কী বোঝে !! ঢাকীর বউয়ের দুঃখ খান কেউ বোঝে নাই মা | তুমি বুজঝ আমার দুঃখ খান | এ বছর খান না হয় দুই খান শাড়ি ছেড়াই পরুম, নুন ভাত টুকুও যদি না জোটে, দু খান বাতাসা আর এক গেলাস জল খাইয়া কাটাইয়া দিমু | তবুও তো আমার সোয়ামি আমার কাছে ছিল তোমার পূজার দিনে | একটা বছরের কষ্ট দিয়া কতো বছরের আনন্দরে যে কিনলাম মা, তা আর কী কমু তোমারে !!! লোকের ক্ষেতে কাজ কইরা যা পায় সোয়ামি, তাতেই চালাইয়া নিমু আমি | তুমি আমার সোয়ামির কথায় রাইগ কইরো না যেনো | "


নিজের মনে মা দূর্গার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করতে থাকে ললিতা | গরম ভাতের হাঁড়িটা থেকে তখনও আলু আর বেগুন সেদ্ধ গুলি উঁকি মেরে চলেছে দরিদ্র ঢাকীর হাঁড়ির ওরাই একমাত্র রোজকার বন্ধু |


এমন সময় মোহন ঢাকী ঘরে ফেরে | ভিজে গামছার মধ্যে গোটা কয়েক আমুদি মাছ নিয়ে | আনন্দে ললিতাকে ডাকতে থাকে, " ও বউ, কোথায় তুই?? এ দিহে আয় দেহি | "


" কী হইসে গো?? অমন কইরা চেচাইতেসো ক্যান?? "


" এই দেখ , কয় খান আমুদি লইয়া আইসি | গরম গরম ঝোল রাধঁ দেহি | আজ তিন জনে মিলা এক সাইথে খামু | কাল থিকা কয়ডা দিন থাকুম না তো ঘরে | "


" কই যাইবা গো ?? "


"শহরে যামু | ও পাড়ার নীতিন খুড়ো, একখান ডাইক পাইসে চন্দননগর থেইক্কা , খুড়ো আর তার ব্যাটার যাওনের কথা ছিল | ব্যাটাটার কাল থিকা খুব জ্বর আইসে, যাইতে পারবো না | তাই পুকুর ঘাটে আমারে শুধাইল খুড়ো, আমি যামু কী না| আমি তো হ্যাঁ কইয়া আসলাম | "


" আর পোলাখান, তারেও লইয়া যাইবা বুঝি | "


" না, এবার আমি একা যামু | পোলা তোর সাইথেই থাইকব | "


ললিতা মাছ কয়টা টেনে নিয়ে পরম যত্নে কাটতে বসে | আজ না হয় সেদ্ধ টুকু তোলাই থাক| তার পরিবর্তে আমুদির ঝোলেই আমোদ করুক ওরা | জীবন যখন যেটুকু দেবে, সেটুকুই ভালোবেসে নেবে ললিতা | শত অভাবে, হাজার দুর্দিনেও মা তার সহায় থেকেছেন | ভাগের সেদ্ধ টুকুর পরেও যখন আমুদির ঝোল খাওয়ার সুযোগ টুকু করে দিয়েছেন, তখন আর বোধহয় মরণ নাই এই দুর্দিনেও | বাকি, জীবন যখন যেরকম , তখন সেরকম ভাবেই চলবে | ললিতা মাছের হাতেই মায়ের পায়ে প্রণাম ঠুকল মনে মনে



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama