ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব —2
ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব —2
দোলা ভট্টাচার্য্য
শেষ মুহূর্তে বন্ধু বান্ধব, সহকর্মীদের অনেকেই দেখতে এসেছিলেন। জ্ঞানদারঞ্জনের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, আঁখিকে কে দেখবে। কার হাতে দেবেন ওনার আদরের নয়নমণির ভার!
জ্ঞানদারঞ্জন মারা যাবার দুদিন আগে ওনাকে দেখতে এলেন প্রভাস বাবু ও মীনা দেবী, মীরার আপন দিদি ও জামাইবাবু। প্রভাস বাবুর দুটি হাত ধরে অনুরোধ করলেন জ্ঞানদারঞ্জন, "আমার আঁখিকে একটু আশ্রয় দেবেন দাদা?"
চুপ করে রইলেন প্রভাস। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন মীনা। তার আগেই জ্ঞানদারঞ্জন বলে উঠলেন, "না না, তোমাদের কোনও চিন্তা নেই। ওর জন্যে তোমাদের একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না। আমি যা রেখে যাচ্ছি, তা ওর পক্ষে যথেষ্ট। তোমরা শুধু ওর অভিভাবক হয়ে থাকবে। বলো দিদি, নেবে আমার মেয়েটাকে? তোমার ছেলেমেয়েদের সাথে ওকে একটু স্নেহ ভাগ করে দিও। দেখবে, ও আর কিছু চাইবে না।"একটু হেসে মীনা বললেন," বেশ, ও আমাদের কাছেই থাকবে। তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না "।" তাহলে কটা কথা ভালো করে শুনে রাখো দিদি", বলে একটু চুপ করে রইলেন জ্ঞানদারঞ্জন। অনেকগুলো কথা এক সঙ্গে বলার ফলে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন," আঁখির জন্মের পরেই আমি ওর নামে একটা পলিসি করিয়েছিলাম। সেটা রিসেন্টলি ম্যাচিওর করেছে। ওই টাকা আঁখি মায়ের নামেই ব্যাঙ্কে ফিক্সড করা আছে। ওই টাকায় ওর পড়াশোনার খরচ চলবে। আর আমার নামে যেখানে যা আছে, এমনকি আমার বাড়িটাও ওর নামে লিখে দিয়েছি আমি । তবে ওর ছবি আঁকা, গান শেখা এগুলো বন্ধ করে দিও না, প্লীজ।
ওগুলোর মধ্যেই ও ডুবে থাকে। আমার মেয়েটা আরো বড় হলে, একটা যোগ্য পাত্র দেখে ওর বিয়ে দিও। দেখো, জামাই যেন আমার দুঃখী মেয়েটাকে কষ্ট না দেয়। একটা পয়সাও ওর জন্যে তোমাদের খরচ করতে হবে না"। কথাগুলো বলে যেন একটু স্বস্তি বোধ করলেন জ্ঞানদারঞ্জন। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে ওরা সবাই চলে গেল। আর জ্ঞানদারঞ্জন, হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলেন।
দুদিন পর ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন জ্ঞানদারঞ্জন। আঁখির মাথার ওপর থেকে ছাদটাই সরে গেল এবার । ডানা ভাঙা পাখির মতো ঘাড় গুঁজে পড়েছিল আঁখি। সদ্য পিতৃহারা মেয়েটাকে সস্নেহে কাছে টেনে নিলেন মীনা।
দেখতে দেখতে তেরোটা দিন কেটে গেল। জ্ঞানদারঞ্জনের পারলৌকিক কাজ মিটে যাবার পর অসুস্থ, প্রায় অচৈতন্য আঁখিকে নিজেদের আশ্রয়ে এনে তুললেন প্রভাস ও মীনা। মাসিমনির যত্নে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল আঁখি।
একটা প্রাইভেট ফার্মে খুব সামান্য মাইনের একটা চাকরি করেন প্রভাস। স্ত্রী ও চারটি সন্তান নিয়ে নরেন্দ্রপুরের দিকে একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। অভাবের সংসার। ছোট ছোট দুটি মাত্র ঘরে গাদাগাদি করে কোনোক্রমে দিন কাটান ওঁরা। এখানে এসে অবধি মন টিকছিল না আঁখির। তাই সেদিন যখন খেতে বসে মাসিমণি যখন বললেন, "আর তোকে কষ্ট করে এখানে থাকতে হবে না। খুব শিগগিরই আমরা এই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে তোদের বাড়িতে গিয়ে উঠব"। কথাটা শুনে একটু স্বস্তি বোধ করল আঁখি।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রভাস ও মীনা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে জ্ঞানদারঞ্জনের বাড়িতে এসে উঠলেন। এ বাড়িটা ও নরেন্দ্রপুরেই। রিক্সা দুটো বাড়ির সামনে এসে থামল।
রিক্সা থেকে নেমেই একছুটে সদর পেরিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল আঁখি। ইস্! বাগানটার কি হতশ্রী অবস্থা! চারদিক আগাছায় ভরে গেছে। দালান ছাড়িয়ে পায়ে পায়ে ড্রয়িংরুমটায় এসে দাঁড়াল আঁখি। মালপত্র নিয়ে আগেই চলে এসেছিলেন প্রভাস। আঁখিকে দেখে বললেন, "এসো মা। আজ থেকে আমরা কজন তোমার এই বাড়ির অতিথি হলাম।" কথা গুলো শুনে হঠাৎ কেমন কান্না পেয়ে গেল ওর। কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল! মা তো কোন ছোটবেলায় চলে গেছে। এখন বাবাও চলে গেল ।আমি একা হয়ে গেলাম। কত সুন্দর সাজানো গোছানো এই বাড়ি, এখন ধুলোয় মলিন হয়ে রয়েছে। বসার ঘরের মাঝখানে রয়েছে ওর সেই পিয়ানো টা ।খুব প্রিয় জিনিস ওর। সেটার গায়েও পুরু ধুলোর সর জমেছে। কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারে এই যন্ত্রটা ভীষণ বেমানান। তবুও মেয়ের বিষাদমগ্নতা কাটানোর জন্যে জ্ঞানদারঞ্জন এটা কিনে দিয়েছিলেন মেয়েকে।
নিজেকে একটু সামলে নিতে ছাদে উঠে এল আঁখি। এখানেও বিষণ্ণতার ছাপ। ফুল গাছগুলো সবই প্রায় মরে গেছে। আকাশের দিকে তাকাল আঁখি। ভরা সন্ধ্যার আকাশে তখন একটা দুটো করে বেশ অনেকগুলো তারা ফুটে উঠেছে ।
সেদিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল ও। ঘন্টা খানেক বাদে নিচে নামল আঁখি। বাড়িটা এর মধ্যেই বেশ ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠেছে। মাসিমণি রান্নাঘরে ব্যস্ত। মেসোমশাইও কোথায় যেন বেরিয়েছে।
ক্রমশ :—
