দাম্পত্যের রোজনামচা
দাম্পত্যের রোজনামচা


সকাল থেকেই মৌ এর মনটা খারাপ। প্রত্যেক বার ভাবছে রনিতকে ফোন করবে। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়ে প্রত্যেক বারই আবার রেখে দিচ্ছে আর ভাবছে প্রত্যেক বারই ঝগড়ার পর ওই কেন সরি বলবে? কখনো কখনো তো রনিতও ওকে সরি বলতে পারে। আসলে প্রত্যেক বার যখনই ঝগড়া হবে, রনিত নিজের ইগোর জন্য কিছুতেই নীচু হবে না মৌ এর কাছে। সরি ও বলবে না। অথচ মৌ বেচারী থাকতেই পারে না রনিতের সঙ্গে কথা না বলে।আর তাই প্রত্যেক বার ও নিজেই সরি বলে। অনেক সময় তো মৌ এটাও জানে যে ,আজকের ঝগড়ায় ওর কোনো দোষ ছিলো না।তাও ওই সরি বলে।
মৌ আর রনিত দু'জনেরই দুজনকে ছাড়া চলবে না এক মুহুর্ত ও। অথচ দাম্পত্যে ঝগড়া হবে, এটাও স্বাভাবিক। যে দাম্পত্যে ঝগড়া হয় না সেটা তো একঘেয়ে। অন্ততঃ মৌ সেরকমই মনে করে। রনিতের অফিসের জামাকাপড় থেকে শুরু করে, কোথায় কি পরে যাবে যাবে, সব মৌ কেই ঠিক করে দিতে হবে।আর যেদিন ঝগড়া হয়, সেদিন রনিত দরকার হলেও নিজের ইগোর জন্য ডাকতে পারবে না। অথচ মৌ কত আশা করে যে রনিত নিজে থেকে ওকে ডেকে বলবে যে,"মৌ আমার ভুল ছিলো, সরি। আমাকে জামাটা বের করে দাও , অফিস যাবো"। কিন্তু মৌ এর সেই আশা কখনো পূরণ হয় না।
বরং উল্টোটাই হয়। মৌ যখন দেখে রাত অবধিও রনিত কিছুই বলে না। তখন ও নিজেই পাশ ফিরে শুয়ে থাকা রনিতকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, তার মান ভাঙ্গাবার চেষ্টা করে। রনিত ও সঙ্গে সঙ্গেই গলে জল। যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল, কখন মৌ ওকে নিজের দিকে ফেরাবে। শুধু একবার মৌ এর সরি বলার অপেক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে যত আদরের ঘটা, যত মান অভিমানের বৃষ্টি শুরু হবে।আরে বাবা এটাই যদি করবার ছিল তো কখনো কখনো নিজেকেও তো ঝুঁকতে হয় নাকি। যেন যত দায়িত্ব মান ভাঙ্গাবার সব মৌ এরই। অবশ্য তার পরের সময়টা মৌ খুব বেশি উপভোগ করে। রনিতের ভালোবাসাটাও তখন দ্বিগুণ হয়ে যায় যে। আর মৌ স্বামীর বুকের উপর শুয়ে সেই মুহুর্ত টাকে উপভোগ করে শুধু। দুজনেই নিস্তব্ধ ভালোবাসায় একে অপরকে বুঝিয়ে দেয় যে, তারা একে অপরের প্রতি কোন ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা আছে।
যাক এসব তো অন্য দিনের কথা। আজকের ঝগড়ায় কিন্তু মৌ এখনো আপস করেনি রনিতের সঙ্গে। প্রত্যেকবার ভাবছে ফোন করবে কিন্তু করেনি। দুপুরে লাঞ্চ এর সময় রোজ খবর নেয় রনিত খেয়েছে কিনা, আজ নেয়নি। আজ মৌ একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে আজ সে কিছুতেই আগে নীচু হবে না। মুড অফ তাই লাঞ্চ ও করলো একদম অল্প। ফোন নিয়ে বসে আছে রনিতের ফোনের অপেক্ষায়। কিন্তু সেটিও নিস্তব্ধ হয়েই আছে। মনে মনে রনিতকে উদ্দেশ্য করে বলছে,"দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝতে পারছো না তো। চলে গেলে বুঝবে তখন। চোখে সর্ষের ফুল দেখতে পাবে।কেউ করবে না আমার মতো।আর হ্যাঁ আর একটা কথা, ভুলেও আমি মরে গেলে দ্বিতীয় বিয়ে করবে না যেন। পেত্নী হয়ে ঘাড় মটকে দেবো তোমার আর ওই শাকচুন্নী দুজনেরই। এই বলে রাখলাম।" কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে মৌ সে তো কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা। এতক্ষণ পর মৌ এর সেটা হুঁশ হলো।
"দূর আর পার যাচ্ছে না জাস্ট। এভাবে আর কতক্ষন। এইবারও না হয় আমিই আগে নীচু হবো, সরি টাও আমিই বলবো" এই বলে রনিতের নাম্বারে কল করলো মৌ। ফোন বিজি বলছে রনিতের। থাক একটু পরেই না হয় ট্রাই করবো। এই ভেবে ফোনটা সবে রেখেছে। ওপাশ থেকে রনিতের ফোন। ফোনটা তুলেই মৌ রনিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সবে বলতে যাবে ওর মনের কথাগুলো। তার আগেই রনিত ওকে বললো, "জানি মৌ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝতে পারা যায় না। আর তুমি না থাকলে আমি সর্ষের ফুল দেখতে পাবো চোখে। আর একটা কি যেন বলো? দ্বিতীয় বিয়ে তাই তো? মৌ ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়, বারবার না।তাই আমার তো এই পেত্নী টাকেই পছন্দ। আর সারাজীবন এই পেত্নী টাকে নিয়েই থাকতে চাই। কোনো শাকচুন্নী র সঙ্গে না।"
এবার মৌ ফোন হাতে নিয়ে হেসে ফেললো। আর মুখে জয়ের হাসি নিয়ে বললো,"তুমি বাড়িতে এসো, তারপর বুঝতে পারবে এই পেত্নিটা কতো বাজে। এখন রাখো, কাজ করো"। ফোনটা রাখবার পরেও ওর মুখে হাসি লেগেই ছিল। আজ ও জিতে গেছে। রনিত আজ ওকে জিতিয়ে দিয়েছে ফোন টা করে।আর মৌ এর কোনো অভিযোগ নেই রনিতের প্রতি। আর ঝগড়া? সে তো হবেই। রোজ রোজ মিষ্টি কথা বললে ডায়াবেটিস হয়ে যাবে তো। তাই দাম্পত্যে অল্প তেতো ও সমান দরকারি। আর শুধু তেতো ই বা কেন। টক,ঝাল, মিষ্টি, তেতো সব দরকারি। তবেই তো দাম্পত্য উপভোগ্য হবে। দুঃখ না থাকলে যেমন সুখকে আমরা বুঝতে পারতাম না। অন্ধকার না থাকলে যেমন আমরা আলোর গুরুত্ব বুঝতে পারতাম না। ঠিক তেমনই ঝগড়া, খুনসুটি,মান-অভিমান এইসব না হলে তো , দাম্পত্যের সেই মধুর ভালোবাসা টাও আমরা উপভোগ করতে পারতাম না। আর তাই দাম্পত্যে আড়ি-ভাব,মান-অভিমান, ঝগড়া-ভালোবাসা এ সবই মাস্ট। অন্ততঃ মৌ তো তাই মনে করে। এটাই তো দাম্পত্যের রোজ নামচা।