Sourya Chatterjee

Romance Classics Inspirational

4.7  

Sourya Chatterjee

Romance Classics Inspirational

চুপকথাদের গল্প

চুপকথাদের গল্প

6 mins
533


রাত নটা চল্লিশের বাসটাই এখান থেকে শেষ বাস বাড়ি ফেরার। এটা মিস হলে কি যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি দু-তিন দিন। বাপরে বাপ! বড্ড হ্যাপা সেসবে। তাড়াতাড়ি কাজ গুটিয়ে যখন বাসস্ট্যান্ডে দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছালাম, দেখি বাসটা স্টার্ট দিয়েছে সবে, কিন্তু ছাড়েনি তখনও। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

তবে এই শেষ বাসে তেমন ভিড় হয় না। তাছাড়া খুব স্পিডও তোলে ড্রাইভার। অন্যান্য সময় যে রাস্তা দেড় ঘন্টাও লেগে যায় সেই রাস্তাই চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় এখন। জানলার ধারে বসে ব্যাগটা কোলের উপর রেখে বাইরের দিকে তাকালাম। উফফ!! আরেকটা দিন কোনোভাবে শেষ হল। বাদামওয়ালা উঠেছে। একটা কিনি বরং, খেতে খেতে আসা যাবে।

-   ভাই, পাঁচ টাকার একটা বাদাম দিন তো।

-   পাঁচ টাকার তো শেষ হয়ে গেছে। দশ টাকার দেই?

দশ টাকা! না, না, এখন দশ টাকা খরচা করে বেকার লাভ নেই। ও, বাড়ি গিয়ে ভাত তো খাবোই। 

-   না ভাই, থাক! 

-   পাঁচ টাকার ডালমুট আছে। দেই?

-   না ভাই, থাক! 

মাসের শেষের দিকে এসব বাড়তি খরচাপাতি করতে একদম মন সায় দেয় না আর। বাইশ হাজার টাকার মাইনে পাই। সাড়ে সাত তো বাড়ি ভাড়া বাবদ মাসের শুরুতেই বেরিয়ে যায়। তারপর দেশের বাড়িতে টাকা পাঠানো, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, রোজকার বাজারহাট, এসবের শেষে মাস শেষে আর কিছু পড়ে থাকে নাকি! আমার স্ত্রী, মোহর একটা চাকরি করে, মাইনেও ভালোই পায়, কিন্তু ওর থেকে টাকা পয়সা নিই না। প্রেম করে বিয়ে করেছি, বিয়ের আগে বলেছিলাম “তুমি যা রোজগারপাতি করবে সব তোমারই থাকবে। সংসারের খরচা, হাত-খরচা, এসব আমিই সামলে নেব”। এবার, ও কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। ও যা টাকা পয়সা পায়, তা দিয়ে ও কি করে তা জানিও না। কোনদিনও জানতে চাইও নি আসলে, আর ও-ও জানায় নি। জানতে ইচ্ছে করে না যে তা নয়, কিন্তু মনে হয় জানতে চাইলে ও যদি ভাবে আমি সন্দেহ করছি। তাই আর জানা হয়ে ওঠে না কখনো। আর তাছাড়া চলে তো যাচ্ছে, বেশ সুখেই দিন কাটছে। দেখতে দেখতে মাসের শেষ চলে আসবে, আজ তো মাসের পঁচিশ তারিখ হয়েও গেল। স্যালারি ঢুকে গেলেই এসব চিন্তা মাথা থেকে পালিয়ে যাবে।

যখন চাকরিতে ঢুকেছি, প্রায় পাঁচ বছর আগে, প্রথম প্রথম কত স্বপ্ন দেখতাম। একটা ফ্ল্যাট কিনবো, সেটাকে সাজাবো। তারপর একটা গাড়ি কিনব। গাড়ি সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে একটা বাইক! প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু দিন বাইরে ডিনারে যাব গিন্নির সাথে। পূরণ আর হল কই সেসব স্বপ্ন! বছর গেলে স্যালারিও সেই হারে বাড়ে না, ম্যানেজারকে বলে বলেও প্রমোশনটা জোটাতে পারি নি এখনও। কি করে আর পূরণ হবে স্বপ্ন! তবে একটা জিনিসই দিনের শেষে স্বস্তি দেয়। আমরা সুখে আছি। 

মোহর শিক্ষকতা করে একটি স্কুলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের টিফিন বানিয়ে, আমার টিফিন রেডি করে সকাল সাতটায় বেরিয়ে যায়। আমি ঘুম থেকে উঠি সকাল আটটা নাগাদ। বাজার করে এনে, খবরের কাগজ পড়ে, স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে দুপুর এগারোটা নাগাদ বেরোই। মোহর দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু আমার সাথে দেখা হয় না। দুজনের কাছে দুটো চাবি আছে, তা দিয়েই যাতায়াত চলে আর কি! আমার ফিরতে ফিরতে ওদিকে রাত সাড়ে দশটা। হাত মুখ ধুয়ে খাই একসাথে। ও তারপরই শুয়ে পড়ে। আমি একটু টিভি ঠিভি দেখে তারপর যখন শুতে আসি, তখন মোহর অঘোরে ঘুমাচ্ছে। একসাথে এক ছাদের তলায় থাকি, কিন্তু কথা হয় না আমাদের। যখন বিয়ে হয়নি, প্রেম করতাম শুধু তখন কত্ত কথা হত। আর এখন! রাতে খাবার সময় একটু যা “সারাদিন কি করলে?” এই জাতীয় কিছু কথা।

পরে রইল শনি আর রবিবার। শনিবারও মোহরের স্কুল আছে। ওই শনিবার সন্ধ্যে থেকে রোববার রাত পর্যন্ত যা টুকটাক কথা হয়। তাও ঘর পরিষ্কার, পাড়ায় আমার আড্ডা, বউয়ের বাপের বাড়ি ঘুরে আসা মাঝে মধ্যেই, উইক-এন্ডের বিশ্রাম ইত্যাদির ফাঁকে শুধু কথাটুকুই বাকি থেকে যায়। তবুও না আমরা সুখে আছি চুপকথাদের সঙ্গী করে। সারাদিন শেষে বাড়ি ফিরে ওর মুখ দেখলেই কেমন যেন মনটা ভালো হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া আছে, যার মধ্যে দিয়ে নৈঃশব্দ মাখা তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে চলে অনবরত। আমাদের মধ্যে একটা প্রেম আছে, যেটা মনে হয় চিরসবুজ। আমাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস আছে, অটুট বন্ধনে বাঁধা। 

ও বাবা! আমার নামার স্টপেজ এসে গেছে! এসব ভাবতে ভাবতে খেয়ালও করিনি কোথা থেকে সময় পেরিয়ে গেল। বাড়ি ঢুকে হাত পা ধুয়ে এবার রাতে ডিনারের পালা। ভাত, বাঁধাকপি আর টক-ডাল, উফফ, জিভে জল আনা খাবার তো! দারুন! এমনিতে আমার গিন্নি রান্নাটাও দারুন করে। দেখে মনে হচ্ছে এসব তো সাধারণ পদ। কিন্তু খেতে যা হয়েছে না! দুর্দান্ত! 

-   কিগো, কি হল স্কুলে?

-   আজ অন্য একটা কাজ ছিল। স্কুলে যাই নি তাই।

-   ও, কি কাজ?

-   পরে বলব। একটা কথা ছিল।

-   কি গো?

-   কাল ছুটি নিতে পারবে?

-   কেন? 

-   একটা জায়গায় যেতে হবে আসলে, খুব ইম্পরট্যান্ট।

-   না, মানে.. লিভ, উমম.. ওকে।

-   গ্রেট! বিকেল করে বেরোব, স্কুল থেকে ফিরে। ওকে?

-   আচ্ছা।

-   বাঁধাকপিটায় একটু নুন কম হয়েছে। তাই না?

-   কই, না তো।

-   কি জানি, আমার লাগছে একটু।

কিছু বলল না, কি মুশকিল বলুন তো! ডাক্তার ফাকতার দেখানোর কোনো ব্যাপার? কি জানি! পুজো তো এখনও দেড় মাস বাকি। পুজোর শপিং করবে নাকি! এই রে, মাসের তো শেষ! এক টাকাও তো হাতে নেই। কিছু না বলে ঘুমাতে চলে গেল। কোনো মানে হয় নাকি! সুভাষ বলছিল কাল নাকি শাহরুখ খানের কোন একটা মুভি রিলিজ করছে। কাম সারসে, নির্ঘাৎ সেই প্ল্যানই করছে। ও-ও তো বিশাল ফ্যান শাহরুখ খানের। কিন্তু তাতেও তো টাকা পয়সা লাগবে। যাতায়াত, টিফিন নিয়ে কম করে পাঁচশো টাকা তো লাগবেই। না, পাঁচশো জোগাড় করা যাবে, অসুবিধা হবে না। মুখ ফুটে একটা কিছু চেয়েছে এতদিন বাদে, নিয়ে যাব না হয়! কাল সকালে উঠে একটা ছুটি চাইব ক্ষণ ম্যানেজারকে ফোন করে। 

সকালে উঠেই পাঁচশো টাকা এ.টি.এম থেকে তুলে এনেছি আগে। মোহরকে জানতে পর্যন্ত দিই নি, যে আমি বুঝে গেছি সব। আরেকটা সারপ্রাইজ প্ল্যানও করেছি। দুটো মুভি টিকিট অনলাইনে বুকও করে রেখেছি। ও যখন আমায় টিকিট কাটতে বলবে, সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দেব। ও চমকে যাবে, তাই না! ঘড়িতে চারটে বাজতে আমরা রওনা হলাম। 

-   কিছু গেস করতে পারলে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আমি একটু মুচকি হেসে “না” বললাম। 

আমার জামার হাতাটা টেনে আমার দিকে ভুরু কুঁচকিয়ে মোহর বলল

-   রাস্তাঘাটে অন্ধের মত চলো, নাকি?

-   ঠিক কি ব্যাপার বলো তো?

-   এত বড় বড় হোর্ডিং চারিদিকে। খেয়ালই করোনি বল।

-   কি গো?

-   আজ শাহরুখ খানের মুভি রিলিজ করেছে। কোনদিন আমি ফার্স্ট ডে ছাড়া সেকেন্ড ডে তে মুভি দেখেছি শুনি। সত্যিই তো, এখন পুরোনো হয়ে যাচ্ছি তো আস্তে আস্তে। মনে রাখবেই বা কেন! 

-   ও তাই বুঝি?

-   তাছাড়া আবার কি? 

আমি আস্তে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখালাম যে দুটো টিকিট আমি কিনে রেখেছি ইতিমধ্যেই। গদগদ হয়ে মোহর আমার হাতটাকে জড়িয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখল।

সিনেমা দেখে বেরোতে যাব, মোহর বলল 

-   চলো, কালীমন্দির যাব।

-   এখন, সাড়ে ছটা বেজে গেছে। খোলা থাকবে তো?

-   চলই না।

কি যে প্ল্যান করছে মোহর, তা শুধু ও-ই জানে। কালীমন্দির আমি যতদূর জানি সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। এতদিন পর একসাথে বেরিয়েছি, ওর পাশে একটা ছোট্ট লেকের মতো আছে সাজানো গোছানো। নির্ঘাৎ ওখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাবে।

কালীমন্দির পৌঁছে লেকের দিকে না গিয়ে অন্য পাশের রাস্তাটা ধরল মোহর। এই রাস্তায় কি আছে কে জানে! জীবনে তো আসিও নি এই দিকটায় তেমন। কিছুদূর গিয়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়ালো হঠাৎ মোহর। গাছপালা আর বাড়ি ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। স্ট্রিট ল্যাম্প গুলো জ্বলছে। চারিদিকে শুনশান, শুধু বাড়িঘরের ভেতর থেকে লোকজনের টুকটাক যা কথার শব্দ ভেসে আসছে।

-   এখানে কেন এসেছি আমরা?

-   বুঝজি না তো।

মোহর ব্যাগ থেকে একটা চাবি বের করে আমার হাতে ধরিয়ে বলল 

-   ওই যে হলুদ একতলা বাড়িটা দেখছ, ওটা আমাদের। 

-   মানে?

-   আমি যা স্যালারি পেতাম, তা দিয়ে গত বছর কিনেছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে নিজের মত করে, নিজেদের মত করে রং করেছি, সাজিয়েছি।

-   আমি কিছু জানি না তো।

-   জানলে কি আর এই অবাক হয়ে যাওয়া মুখটা দেখার সুযোগ মিলত? এবার মুখটা বন্ধ কর। মাছি ঢুকে যাবে যে। 

আমি সত্যিই নির্বাক। কি বলছে মোহর? 

-   আরে, চলো ঘরে।

আমার হাত ধরে একপ্রকার টানতে টানতেই মোহর আমায় নতুন বাড়িতে নিয়ে এল। দু কামরার পরিপূর্ণ একটা বাড়ি। ইলেক্ট্রিসিটি, জল – এসবের ব্যবস্থাও রয়েছে। কি করে পারল মোহর! এসব সত্যি তো?

-   চলো ছাদে যাই। 

গতকালই পূর্ণিমা ছিল। চাঁদটা আজকেও জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে। মোহর আমার জামার কলার ধরে আমায় কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরল। পূর্ণিমার চাঁদের আলো মায়াবী একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। মোহরের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। সেই শব্দে কত স্বপ্ন, ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশের কলতান ভাসছে। আরো জোরে মোহর আমায় জড়িয়ে ধরল। পূর্ণিমার চাঁদ যেন আমাদের ভিতরকার চুপকথাদের সাথে একসাথে হাসছে আর অনুধাবন করছে আমার আর মোহরের সম্পর্কটাকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance