রা জ কু মা র

Drama Classics Inspirational

4.5  

রা জ কু মা র

Drama Classics Inspirational

চোখ

চোখ

7 mins
605


(১)


" ওমা, ঠাকুর খানা কত বড় গো?"

উমা প্রশ্নটা করল নমিতা'কে।

নমিতা উমার মাথায় হাত দিয়ে বলল " অনেক বড় রে মা, এ বছর দশটা গাঁয়ের মধ্যে সবথেকে বড় দূগগা হবে মুখুজ্যে বাড়িতে।"

উমা মুখটা শুকনো করে বলল " আর যত বড়ই হোক আমি কি আর দেখতি পাব? মা আমার চোখ দুখানা দিল কিন্তু কেন যে তাতে দৃষ্টি দিলনা বুঝিনা। শুধুই লোক দেখানো চোখ নিয়ে কি লাভ বল'মা ?"

উমার কথায় নমিতার চোখে জল এল। চোখ মুছে বলল " অত ভাবিসনি মা, আমি তো আছি তোর চোখ হয়ে সারাজীবন থেকে যাব। আর ছোটকত্তা বলেছে তোকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন।"


নমিতা মুখার্জি দের বাড়ি কাজ করে আজ প্রায় সাত বছর। ওই যে বছর মাঠে কেউটের ছোবলে উমার বাপটা চলে গেল। তা না হলে ভালোই জায়গা জমি ছিল। স্বামী চলে যাওয়ার পর দেওররা যুক্তি করে মা আর অন্ধ মেয়েকে ঘরছাড়া করল। একা মেয়েমানুষ আর কি করবে এই মুখার্জি দের বাড়ি কাজ করে আর তাদের বাগানের একটা কুঁড়েতে দুই মা মেয়ে থাকে। মুখার্জি কর্তা এমনি ভালো তবে বাড়ির বড় গিন্নি একেবারে এসব ছোটলোকেদের সহ্য করতে পারেনা। আর ছোটকর্তা একেবারে মাটির মানুষ। শহরে থাকে, ডাক্তারি করে। ছোট গিন্নিও খুব ভালো মানুষ। ওনার এত বাদবিচার নেই। আর তাদের মেয়ে "সাথী" সে তো উমা ছাড়া প্রায় চলেই না। বড় গিন্নির থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বাগানের ঘরে গিয়ে উমার সাথে খেলে আসে। ছোটগিন্নির এতে কোন সমস্যা না থাকলেও বড় গিন্নি একেবারে পছন্দ করেনা তার নাতনি ওই ঝি এর মেয়েটার সাথে খেলবে। এই নিয়ে বাড়িতে প্রায় অনেক সময় একটা তুলকালাম বাঁধে।

ছোট গিন্নি চুপ করে থাকে, নমিতাও মাথা নিচু করে সব শোনে। বাচ্চাদের রোখার ইচ্ছে বা ক্ষমতা এই দুই মায়ের কারোরই নেই। 


 

(২)     


   প্রতিবছর দুর্গা পুজো হয় ধুমধাম করে মুখার্জি বাড়িতে। পুরো গ্রামে এই একটা পুজো। সেই দিন সবার জন্য এ বাড়ির দরজা খোলা। তবে যদিও ভাগ থাকে ব্রাহ্মণদের বসার জায়গা আলাদা, পরিবারের সদস্যদের বসার জায়গা আলাদা আর গ্রামের নিচু জাতের মানুষদের দাঁড়ানোর জায়গা আলাদা।

নমিতারা যদিও নিচু জাতের নয়, তবুও পেট চালানোর জন্য লোকের বাড়ি বাসন মাজা তাকে ওই জাতে ঠেলে দিয়েছে। 


       ভারত সব ভুললেও এই বর্নবৈষম্য ভুলতে পারেনি এখনও। কারন যেদিন এ দেশ থেকে জাত পাতের ভেদাভেদ উঠে যাবে সেদিন থেকে নেতাদের রমরমা বন্ধ হবে। যদিও সে অন্য কথা, এই গল্পে এ কথার জায়গা নেই। তবে মনে এল তাই কলমে উঠে এল আর কি।


       মুখার্জি বাড়ির মা প্রতিবছর এ বাড়িতেই তৈরি হয়। নিতাই পোটো বাড়িতে এসে মাকে রুপ দেয়। সব রকম নিয়ম মেনেই মা এখানে তৈরি হয় আর মাকে বিসর্জন করে সেই কাঠামোতে আবার পরের বছর নতুন মা রুপ পায়।


     বাড়ি এসে উমা বলল " ও মা কতদিন পরে মায়ের চোখ আঁকা হবেগো? দেখতে না পেলেও আমি বুঝতি পারি মা'য়ের চোখ আমার দিকে তাক্কে থাকে।"

নমিতা হেসে বলল " হ্যাঁ তা তো থাকেই, সে তো পৃথিবীর মা সবার দিকে তার নজর।"

"জানো মা, আমার চোখটা ঠিক হয়ে গেলি সাথীর সাথে আরও খেলব। ওর মত দৌড়োব আম পাড়ব।এখন শুধু ওই আম পেড়ে খাওয়ায় আমায়। উফফ কি সুন্দর করে মাখে লংকা গুড়ো দে। "

নমিতা উমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে " সাথী তোকে খুব ভালোবাসে মা, তোর চোখটা ঠিক হয়ে গেলে সবথেকে বেশি ওই খুশি হবে, দেখিস"।

উমা ভ্রু'টা কুঁচকে বলল "কিন্তু কাল থেকে ও আসছে না কেন বলতো, আজ ও বাড়িতে গিয়েও ওকে দেখতে পেলুম না। বড়গিন্নি ছিল বলে ওর সাথে একবার দেখাও হলনা। কি হয়েছে মা ওর?"

নমিতা বলল " ওর যে খুব জ্বর রে মা কাল থেকে। মেয়েটা একদিনে কেমন শুকিয়ে গেছে। তাই বাইরে রেরোনো বন্ধ এখন ওর।"

"একবার দেখতে যাব মা? চুপিচুপি গিয়ে একটু ছুঁয়ে চলে আসব। নিয়ে যাবে মা?"

" না মা, বড়গিন্নি দেখলে খুব রাগ করবে। এখন যাসনে মা। ও ভালো হলেই দৌড়ে তোর কাছে আসবেক্ষন দেখবি।"

উমা উপায় না পেয়ে চুপ করে গেল।


   এদিকে সাথীর জ্বরের সাথে বমিও চালু হল। বেগতিক দেখে পরের দিনই ছোটকর্তা তাকে শহরের বড় নার্সিংহোম এ ভর্তি করল। খবরটা পাওয়া মাত্র উমা কান্না জুড়ে দিয়েছে। তাকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। সে যে কোন ভাবে একবার সাথীকে দেখতে চায়, একবার তাকে ছুঁতে চায়। কিন্তু নমিতার কাছে কোন উপায় নেই। বড্ড অসহায় লাগছে আজ নমিতার। ছোটগিন্নিও নেই যে তাকে গিয়ে সব বলে একবার শহরে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসবে। মানুষের সব থেকে বড় শত্রু মনে হয় অসহায়তা। কিছুই কর‍তে দেয়না। এক সপ্তাহ বাদে মহালয়া। মায়ের এদিকে চোখ আঁকা হবে সেদিন। সেদিন মায়ের চক্ষুদান।নিজের ঘরে বসে হাত দুটোকে জড়ো করে উপরে তুলে নমিতা জোড়েই বলল " মা'গো দয়া করো। প্রতিবছর মেয়েটা সেই শুরু থেকে শেষ অবধি তোমার চোখ আঁকা দেখে আর উমাকে বলে, এই ভ্র আঁকলো এবার পুঁতি, কি টানাটানা হয়েছে রে উমা চোখদুটো। এবারও যেন মেয়েটার চোখদুটো দেখতে পারে তোমার চোখ আঁকা। দয়া করো মা, দয়া করো।" 


(৩)


       রাতের অন্ধকারে হঠাৎ নমিতার দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। ভয়ে সিঁটকে উঠল সে। এর রাতে কে? একা মেয়েকে নিয়ে সে এই কুঁড়েতে। ভেবেই ভয়ে একেবারে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল তার। আবার ঠকঠক আওয়াজ পেয়ে আরও একবার কেঁপে উঠল নমিতা। উমাও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। 

"নমিতা খোল দরজাটা, আমি শিবু"... শিবুদার আওয়াজে এবার একটু বুকে বল পেল সে। শিবু মুখার্জি বাড়ির ঠাকুর, রান্নার কাজ করে। নমিতা আর উমাকে খুব ভালোবাসে। নমিতা দরজাটা খুলল। " এত রাতে শিবুদা, কি ব্যাপার?" নমিতা অবাক হয়েই বলল। 

"তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি বেরোতে হবে তোদের। ছোটবাবু ফোন করেছিল। উমাকে নিয়ে কলকাতা যেতে হবে সকালের মধ্যে। চুপিচুপি করতে হবে যেন বড়গিন্নি টের না পায়।" 

নমিতা যেন আকাশ থেকে পড়ল " কিন্তু শিবুদা এই মেয়েকে নিয়ে এত রাতে কলকেতে যাব কি করে?"

শিবু এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল " আয় তো তাড়াতাড়ি, খোকন গাড়ি নিয়ে রেডি আছে। তোদের কলকেতে পৌঁছে দিয়ে ভোরের আগে ওকে ফিরতে হবে। তাড়াতাড়ি নে।"

নমিতা আর কিছু না বলে ঘরে দরজা দিয়ে উমাকে বলল " মা রেডি হ, ডাক এসেছে"।


    ভোর তিনটে নাগাদ একটা নার্সিং হোমের সামনে এসে গাড়ি থামল। নমিতা ভয়ে ভয়ে উমাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দেখল সামনে ছোটকর্তা দাঁড়িয়ে। বুকে একটু বল এল আর মনে অনেক প্রশ্ন। ছোটকর্তাকে একটা প্রনাম করে নমিতা বলল " কেমন আছে বাবু সাথী। উমার সাথে একবার দেখা করিয়ে দেন, মেয়েটা সাথী সাথী করে পাগল হয়ে গেল। আর আমিও মেয়েটাকে দেখিনি।" 

ছোটকর্তা বলল "ভালো আছে সাথী। ভেতরে এস। আয় উমা আয়।"

নমিতা আর উমাকে ভিতরে নিয়ে গেল ছোটকর্তা। নমিতা দেখল ছোটগিন্নি একটা চেয়ারে অবসন্ন হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু নেই তার জীবনে। চোখ দুটো থেকে অনবরত জল পড়েই যাচ্ছে। নমিতার বুকটা কেঁপে উঠল। ছোটকর্তা নমিতাকে বলল "উমাকে কিছুদিনের জন্য এখানে থাকতে হবে, সাথে তোমাকেও।"

কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না নমিতা। ছোটগিন্নির পাশে বসে বলল " ও গিন্নিমা কি হয়েছে গো, আমার সাথী কোথায়? একবার মেয়েটাকে দেখতি দাও না।"

ছোটগিন্নি নমিতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। একটা নার্স এসে উমাকে নিয়ে গেল আর নমিতা তখনও কিছু বুঝতে পারল না। শুধু ছোটকর্তার উপর বিশবাস রেখে মেয়েকে তার হাতে ছেড়ে দিল।


(৪)


সবাই গভীর আগ্রহে উমা আর ছোটকর্তার দিকে তাকিয়ে। নমিতা মনে মনে বলছে " মা চোখ দুটো যেন বেঁচে থাকে মা, দয়া করো মা"। 

উমার চোখদুটোর পট্টি যখন খোলা হল। একবার দুবার চোখ দুটো পিটপিট করে চেঁচিয়ে উঠলো উমা " আমি দেখতি পাচ্চি, ওগো আমি দেখতি পাচ্চি। "

আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে উঠলো ছোটকর্তা। ছোটগিন্নিও এসে জড়িয়ে ধরল উমাকে। হাউহাউ করে কেঁদে বলতে লাগল " সাথী বেঁচে গেল, আমার সাথী তুই আমার সাথী "।

নমিতা হাত জোড় করে মাথায় তুলে বলল " আমার মেয়েটা এবার মায়ের চোখ আঁকা দেখতে পারবে। "

এসবের মাঝে উমা এদিক ওদিক দেখে বলল " ওমা, সাথী কই গা? ও আসেনি? এত দিনে একবার দেখতেও এলোনা আমায়।" 

কেউ কিছু বলতে পারল না৷ নমিতা উমার দিকে তাকিয়ে বলল " আমার সাথী যে তোর মধ্যেই আছে রে মা।" কিছু বুঝতে পারল না উমা। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল " মায়ের চোখ আঁকা হয়ে গেছে মা? আমার মায়ের চোখ আঁকা দেখতি খুব ভাল লাগে। আমি আর সাথী দুজনে একসাথি মায়ের চোখ আঁকা দেখব। কবে মা মহালয়া?"

ছোটগিন্নি উমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল " হ্যাঁ মা তুই আর সাথী প্রতিবারের মত এবারেও একসাথে মায়ের চোখ আঁকা দেখবি। চল মা, কাল ভোরে যে মহালয়া। তোদের জন্য ও বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।"


একেবারে ভোরে যখন গাড়িটা এসে থামল মুখার্জি বাড়ির গেটের সামনে। নমিতা আর উমা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল বড়গিন্নি বরনডালা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। নমিতা বুঝলেও উমা বুঝল না। এ সম্মান কেন কার? তবুও কিছু না বলে সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বড়গিন্নি বরন করে তার ডান গালে একটা চুমু খেয়ে বলল " আমার একমাত্র নাতনি।কই দেখি চোখদুটো দেখি। ও মাগো আমার সাথীর চোখ এ যে, মা দুগগা এই চোখদুটোকে বাঁচিয়ে রেখো মা। বাঁচিয়ে রেখো।"


সেই রাতে ছোটকর্তা যখন বুঝল তার সাথী আর বাঁচবে না। তিনি বুকে পাথর রেখে ছোটগিন্নির সাথে পরামর্শ করেছিল নিজের মেয়েকে চিরতরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তার চোখ দুটো উমার মধ্যে দিয়ে নতুন শরীর দিয়েছিল আর উমাকে পৃথিবী দেখার ক্ষমতা। 


উমা সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। সোজা চোখটা গিয়ে পড়ল মায়ের মুখের দিকে। শাঁখ ঘন্টা বেজে উঠল মুখার্জি বাড়িতে। এই তো মায়ের ভ্র টানা হল, এবার মায়ের পুতি আঁকছেন পোটো কাকা। উফফ কি টানাটানা মায়ের চোখদুটো। প্রতিবারের মত এবারেও সাথীর চোখ দিয়েই মায়ের চোখ আঁকা দেখল উমা। সাথী উমা দুজনে আজ মিলে মিশে একাকার, একজনের শরীর আর একজনের চোখ। 


মা আজ তার চোখ পেল আর উমাও।


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama