কামড়
কামড়
"ও বাবা দেখ, একটা পাগলী এসে বসে আছে।"
বাবার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে খোকন আবার চেঁচিয়ে বলল, "ও বাবা, এসো... পাগলী এসেছে..."
অমিত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সত্যি একটি বয়স্ক মহিলা এসে বসেছে তাদের দরজার বাইরে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ধুলোতে ঢাকা। পরনে একটা জরাজীর্ণ শাড়ী। আসলে সেই শাড়ীর কি রঙ তা বলা মুশকিল। কারণ, এত পরিমাণ ধুলো তাতে লেগেছে যে আসল রংটাই ঢাকা পরে গিয়েছে। অমিত বৃদ্ধাটির সামনে এসে চেঁচিয়ে বলল, "কি চাই? এখানে কেন?"
বৃদ্ধাটি ডান হাতটা পেটে আর বাম হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, "খিদে... খিদে পেয়েছে..."
অমিতের মনটা কেঁদে উঠল। খোকনকে বলল, "যা তো খোকন, মা-কে বল কিছু খাবার দেবে... ওঁর খিদে পেয়েছে মনে হয়।"
খোকন বৃদ্ধার দিকে একবার তাকাল। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, "কিন্তু বাবা, ও তো পাগলী। খাবার দিতে গেলে যদি কামড়ে নেয়?"
অমিতের মুখটা বড় শুকনো মনে হচ্ছে। যেন কোনো পুরানো স্মৃতি তার মনের প্রেক্ষাপটে এসে ভিড় করেছে। ভুলে থাকা একটুকরো অতীত এসে দাঁড়িয়েছে তার দুয়ারে। সে খোকনকে বোঝাল, "না বাবা, ওঁরা কামড়াবে কেন? ওঁরাও তো আমাদের মত মানুষ..."
খোকন কিছু একটা ভেবে বলল, "কিন্তু বাবা, মা যে বলে ঠাম্মি পাগলী হয়ে গিয়েছিল, আর কামড়াতে আসত খুব। তাই তোমরা তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছ!! তাহলে এই ঠাম্মিও তো পাগলী বাবা। ঠাম্মি কামড়ালে, ইনিও কামড়াবে।"
অমিতের মাথায় যেন কেউ একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল। খোকনের এই বাস্তব জিজ্ঞাসায় তার সমস্ত সত্তা তাকে মূল অপরাধীর আসনে বসিয়ে দিল। সে যেটা করেছিল। আদৌও কি সেটা কেবল ভুল ছিল? না ছিল না, ছিল অপরাধ। কারণ, উনি মা ছিলেন। হাজার যন্ত্রণা সহ্য করে অমিতকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। ছোটবেলায় মায়ের যে দুধ পান করে বেঁচেছিল অমিত, সেই স্তনেই কামড় বসাতেও ছাড়েনি। কিন্তু বড় হতেই মায়ের কামড়ের ভয়ে মা-কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল সে। কিন্তু কোথায় দিয়েছিল? পাগলা গারদে!!
খোকন আবার বলল, "ও বাবা, তাড়িয়ে দাও না। আমি ভয় পাচ্ছি। আমার ভয় লাগে।"
অমিত গর্জে উঠল, "যাও তোমাকে যা বললাম সেটা কর। মা-কে বল খাবার দেবে।"
খোকন চোখ মুছতে-মুছতে ভিতরে গিয়ে মা-কে ডেকে আনল। প্রিয়া বাইরে এসে অমিতের কাণ্ড দেখে অবাক। একি? অমিত ওই পাগলীর পায়ের কাছে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে, "আমাকে ক্ষমা করে দাও মা... আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করেছি। অপরাধ করেছি..."
প্রিয়া অমিতের এই অবস্থা দেখে বুঝল হয়ত আবার সেই পাগলী শাশুড়িটা ফিরে এসেছে। উফ, এ জ্বালা আর সয় না। সে বৃদ্ধাটির সামনে এসে দেখল; না, ইনি তো ওর শাশুড়ি নয়। আবার একবার ভালো করে দেখল, না কিছুতেই এটা ওর শাশুড়ি নয়। অমিতকে পিঠে হাত দিয়ে তুলে প্রিয়া বলল, "উফ, সহ্য হয়না আর। এইভাবে মাথা নিচু করে যে কাঁদা হচ্ছে। ঘাড়ে যদি কামড়ে নেয় পাগলিটা! কি করবে?"
অমিতের মাথাটা আগুন হয়ে গেল। আগ্নেয়গিরির লাভার মত তার চোখ থেকে জ্বলন্ত অতীতের পোষা রাগ, বেদনা ঠিকরে বেরোতে লাগল। সে প্রিয়াকে এক ঠেলায় খানিক দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, "তোমার এই কামড়ের ভয়ে আমি আমার মা-কে একদিন রাস্তায় ছেড়ে এসেছিলাম। জানি না কত বড় কু-সন্তান হলে এটা করতে পারে!!"
প্রিয়াও ছাড়ল না। সেও চিৎকার করে বলল, "তোমার বাবা মরে যাওয়ার পর তোমার মায়ের মাথাটা একেবারে বিগড়ে গিয়েছিল। আর পাগলীরা কামড় দেয় আমি জানি।"
অমিত প্রিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্ত স্বরে বলল, "বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় খোকন তোমার স্তনে কামড় দেয়নি? দিয়েছে তো! তাকে রাস্তায় ছেড়ে এসেছ তুমি?"
প্রিয়া শান্ত স্বরে বলল, "ও আমার সন্তান অমিত!!"
অমিত চোখের জল মুছে বলল, "আর সেও আমার মা ছিল প্রিয়া, মা..."
বৃদ্ধাটি তখনও সেখানেই বসে। সে কামড়াতে আসেনি কাউকে। কারণ, মায়েরা কখনো কামড়াতে জানে না।