চক্ষুদান
চক্ষুদান


"হাসিনা মা আলোটা একটু তুলে ধরতো " "বাপজান আমি কল থেকে চট করে জলটা তুলে নিয়ে আসছি।ততক্ষণ রোশমি ধরক।" "এখনো তো মা ভোর হতে বাকি একটু পরেই যাসনা।" "না গো বাপ বেলা বাড়লে ভীড় জমে যাবে। তখন তোমায় জোগাড় দিতে দেরি হয়ে যাবে।" হাসিনা বেরিয়ে যায় দুটো বালতি নিয়ে।বৃদ্ধ আপন মনে বকবকায়-"তোর মা থাকলে কি আর তোদের এই দুর্দশা হত মা।এই কি তোদের কাজ করবার বয়স?সবি কপাল।আল্লা আমাকেও অক্ষম করে রেখেছে।চিরকালের তরে উঠে দাঁরাবার ক্ষেমতা কেড়ে নিল।"
ছোট্ট রোশমি আলো ধরেই ঢুলতে থাকে ঘুমের ঘোরে। বৃদ্ধের ডাকে চমক ভাঙে। "ভালো করে ধর মা" রোশমি একটু এগিয়ে গিয়ে বসে।ছোট্ট ছোট্ট অবাক চোখে দেখে কি ভাবে একটু একটু করে বাপজানের হাতের জাদুতে মা দূর্গা জীবন্ত হয়ে উঠছে....কি অপূর্ব!কি
করে যে পারে বাপজান। "বাপজান সবাই বলে জান? তোমার হাতে জাদু আছে।" "চাচা হাতটা ছাড়ান দাও দেরি হচ্ছে।বাড়ি গিয়ে বাপজান কে জোগাড় দিতে হবে।" "মূর্তি করে কপয়সা পয়সা পাবি?তোকে এমন কাজ দেব রাজরাণি হয়ে যাবি।শুধু আমার কথা মত কাজ করবি.,হেহে হেহেহে"-কথাগুলো শেষ করে একটা কুটিল হাসিতে ভরিয়ে তোলে পানের ছোপধরা দাঁত বার করে লোকটা ""নাঃ!!!ছাড় বলছি হাতটা"-গর্জে ওঠে হাসিনা। দপ করে জ্বলে ওঠে লোকটার মুখটা।কুটিল মুখটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।-তবে রে শালী আমার সাথে চোপা!আজ তোর কোন বাপজান বাঁচাতে আসে দেখবো।" মুখটা চেপে ধরে হেঁচড়ে পাশের ঝোপেড় ধারে টেনে নিয়ে চলে।বলিষ্ট পুরুষের হাতে হাসিনা ছোট্ট পাখির মত ডানা ঝাপটায় নিস্ফল প্রচেষ্টায়। "এখনো তো এল না হাসিনা?" "এসে পড়বে বাপজান ।বোধায় রাণি দিদি দের বাড়ি রেডিওতে কি হয় ভোরবেলা ওটা শুনতে গেছে।কাল রাণি দিদি যেতে বলছিল" "তাই হবে বোধায়।আজ তো মহালয়া।একটু পরেই রেডিওতে শুরু হবে।তুই এক কাজ করতো মা রঙ আর তুলিটা নিয়ে আয়।" ছোট্ট রোশমি উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে।-"চক্ষুদান করবে বাবা?" বৃদ্ধ হেসে বলেন-"হুম মা।" রোশমি ছুট্টে গিয়ে রঙ আর তুলিটা নিয়ে আসে।বৃদ্ধ হাতে তুলে নেয় তুলি।চোখ বন্ধ করে থাকেন কয়েক মিনিট।বাবার হাতে ধরে এই চক্ষুদান শেখা।বাবা বলতেন-"খোকা মন থেকে আগে মা দুগ্গার রুপখানা কল্পনা করবি।" "বাপ ওতো হিন্দু দের দেবতা?" "না বাপ ও সক্কলকার মা আমাদের ঘরের মা।মা ঘখন ঘর ছেড়ে চলে ঘায় ঘরটা খাঁ খাঁ করে পরের বছরের প্রতিক্ষায় থাকে মনটা।ও তো আমার মেয়ে ও তো আমার মা রে বাপ" অবাক ভাবে তখন তাকিয়ে থাকতো বৃদ্ধ, বাপকে ঠিক যেন এক সাধু সন্ত মনে হত।আসলে বাপ ছিল শিল্পী।শিল্পীর কি জাত হয়।সেও তো এক শিল্পী তার ও কোন জাত নেই।শুধুই শিল্পী সে।চক্ষুদানের সময় বাপের কথা বড় মনে পড়ে বৃদ্ধের।বাপ বলতো-"মন থেকে আগে মা দুগ্গার চোখ খানি অনুভব করবি দেখবি আপনি তোর হাতে জীবন্ত হয়ে উঠবে মায়ের চোখ।এতো হাতের কাজ নয় বাবা মনের কাজ।যতক্ষণ না মন থেকে সাড়া পাবি চক্ষুদান করতে পারবি না বাপ।" চোখ খোলেন বৃদ্ধ হাতে তুলে নেন তুলি খানা.... হাতের নাগালের মধ্যেই চলে এসেছে থান ইঁট টা।হাসিনা দুহাতে তুলে নেয় ইঁট টা।জানোয়ারটা তখন যৌন সুখে মাতাল। আঃ!একটা আর্তনাদ। আরো বার কয়েক ঘা পড়ে মাথায়।রক্ত মেখে উঠে দাঁড়ায় বিবস্ত্র হাসিনা।অসুর বধ করে তখনো দেবীর চোখে আগুন জ্বলছে।শরৎ এর মহালয়ার ভোরে দুহাতে অজ্ঞলি ঢেলে দেয় ভোরের বাতাস বুনোফুল দিয়ে অসুর দলনী দেবীর পায়ে। তুলির শেষ টান পরে চক্ষুদানে।অবাক চোখে রোশমি দেখে মায়ের মুখটা জীবন্ত হয়ে ওঠে তুলির আঁচড়। "ঠিক যেন দিদির মত মুখ না বাপজান?" দুজনের অবাক দৃষ্টি আটকে যায় মায়ের মুখে।বৃদ্ধের চোখে অঝোড় ধারায় জল।মহালয়ার ভোরের শরৎ আকাশ মুখরিত তখন- "যাঃ দেবী সর্বভুতেষু...."