Sangita Duary

Romance Tragedy Classics

4  

Sangita Duary

Romance Tragedy Classics

ছাদবাগানের ফল

ছাদবাগানের ফল

11 mins
398



সিঙ্গেল খাটের উপর গ্যালাক্সি হ্যান্ডসেটটা বাজছে অনেকক্ষণ।

গতকাল সরস্বতী পূজো গেছে, আজ খাওয়ানোর দিন। এমন কিছু না, সরকারী প্রাথমিক স্কুলে সরস্বতী পুজোর খাওয়া বলতে ওই খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, মিষ্টি।

শিক্ষকদের হাজির থাকতে হয়, যদিও ওই দিন ছেলেমেয়েরা পরিবেশনের দায়িত্বটা প্রায় যেচেই নেয়, তবু তত্ত্বাবধান তো করতে হয়!

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকতে চুকতে বেলা তিনটে বাজলো। ভৌমিকবাবুদের জোরাজুরিতে খেতে বসেছিল রণজয়, তবে ঠিক যেন আস্বাদন করতে পারেনি।

একে অবেলা, তায় ঐরকম খোঁয়ারে খাওয়া দাওয়া! বাপরে! রণজয় পালিয়ে বেঁচেছে।


বাথরুম থেকেই স্যামসাং এর রিংটোন শুনতে পাচ্ছিলো, তাই বলে কি গোড়ালি সাবানে ঘষেই চলে আসা যায়?

মুখের ফেসওয়াস ভালো করে ধুয়ে তোয়ালেতে মুছে ঘরে পা দিতে না দিতেই কলটা কেটে গেল।

অচেনা নম্বর। রণজয় ফোনটা রেখে দিল। অচেনা নম্বরের সঙ্গে অহেতুক বাক্যালাপ করার রুচি রণজয় মল্লিকের নেই।

ঘরে পরার গেঞ্জি আর পাজামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রণজয়। শীতের শেষ কিন্তু আর্দ্রতা বেজায় বেহাল। হাত, পা, কনুই, মুখ, ঠোঁটে ঘষে ঘষে মশ্চারাইজার লাগিয়ে চিরুনি তোলে। মাথার সামনেটা বেশ ফাঁকা হয়ে আসছে। দেওয়াল আলমারির একেবারে ওপরে রাখা আছে মিন্ট অফ ফাইভের একশো এম এলের বোতলটা।

'সরকারি চাকরি' তকমাটাই সব খুঁত ঢেকে দিলেও বয়স ধরে রাখতে চুলের ভূমিকা তো আর অস্বীকার করা যায় না!

নিজেকে পরিপাটি করে নিয়ে রণজয় ছাদের দরজা খোলে।

গেল সপ্তাহে বজবজ থেকে বেশ কয়েকটা ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চারা এনেছে।

মাটির ওই ষোলো ইঞ্চি টবগুলোর জন্য কুমোরের সাথে কড়া দরদাম করা থাকে।

বেশ কয়েকদিন হলো রোদের সেই তেজটা নেই।

সার তৈরি করা যাচ্ছে না।

পৌরসভার ভিস্তিওয়ালাকে ডেকে মাটি আনিয়েছিলো। সেও ব্যাটা ঝোপ বুঝে কাদা মাটি গছিয়ে দিয়ে কড়কড়ে দুশো টাকা ঝেঁপে দিলো। এই বালিমাটিতে কি আর গাছ বাঁচে?

এগুলোকেও আবার নতুন করে বানাতে হবে। হাড়গুড়ো,খোল, গোবর ইত্যাদি সঠিক অনুপাতে ভালোকরে মিশিয়ে ঝুরো মাটি বানাতে হবে।

কাল ছুটি আছে। কালই কাজ মিটিয়ে ফেলতে হবে। কাজ ফেলে রাখা রণজয়ের ধাতে নেই।

প্রথম বিকেলে ঝাঁঝরি দিয়ে নিজের গাছগুলো ভালো করে ভিজিয়ে দেয় রণজয়। ছাদের এককোণে মায়ের লাগলো কয়েকটা পুজোর ফুলের গাছ। ওগুলোর পরিচর্যা মা'ই করে।

তাছাড়া রণজয়ের বয়েই গেছে নিজের দামী গাছের সাথে ওই জবার ছাড়ার যত্ন নিতে!

ছাদের গ্রিলের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রণজয় নীচে আসে। এবার মগজ একটু চা চাইছে।

পাতা ভিজিয়ে মায়ের ঘরের দিকে একবার উঁকি দেয়। যা ভেবেছে তাই! দুজনেই সিরিয়ালে গেঁথে আছে!

মগজের তান্ডব রাগটা নতুন করে চিড়বিড়িয়ে উঠলো আবার।

পৃথিবীর আর সবার প্রতি সবসময় মনোযোগী কেবল নিজের ছেলের প্রতি ছাড়া।

অসহ্য!

চা ছেঁকে নিয়ে পায়ে পায়ে মায়ের ঘরে ঢোকে রণজয়।

নিজেকে খানিক প্রস্তুত করে বলে ফেললো,"তোমরা তবে ওদের বাড়ি কবে যাচ্ছো?"

মনে হলো যেন উর্দু কিছু বলে ফেললো রণজয়। বাবা সিরিয়াল থেকে মুখ তুলে তেমনই অভিব্যক্তি নিয়ে তাকালো যেন!

ধুত্তোর!

প্লাস্টিক চেয়ারটা দখল করে কাগজটা টেনে নিলো।

নিজের কাজটা এবার নিজেকেই সামলাতে হবে।

অভ্যেসমত কাগজ টেনে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতা খুলতেই মা'র গজগজ, "রুবির ছেলেও চাকরি পাওয়ার দশ বছর পর, সেই একচল্লিশে বিয়ে করলো।

লোকে কী বলবে? চাকরি পেতে না পেতেই...!"

রণজয় বলতেই যাচ্ছিলো, "আমি তবু চাকরির একবছর পর বিয়ে করেছি। বাবা তো একমাসের মধ্যেই...!"

থাক। কথায় কথা বাড়ে।

আসল ঘটনা তো অন্য জায়গায়।

বিয়ে করলে সংসারে আরও একজনের খোরাক বাড়বে কিনা! ভাড়ারে কম পড়বে কিনা!

ধন্যি মা! দুজনেরই ভালোমতোই পেনশন তবুও যেন নেই-ছেই দশা!

ফোনটা আবার বেজে উঠলো। রণজয় এবার ধরলো।

- সরি। আসলে তখন ভুল করে আপনার নম্বরটা ডায়াল হয়ে গিয়েছিল।

- কে?

- শিলা। মনে পড়ছে না? গত রবিবার আমাদের বাড়ি এলেন...

রণজয়ের মস্তিষ্কের পঞ্চম প্রকোষ্ঠ খুলে গেল।

- হ্যাঁ হ্যাঁ বলো... বলুন।

- কী করছেন?

চায়ের কাপ নিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে রণজয়।

****************


চুলে আর একবার চিরুনি বুলিয়ে জামায় ভালো করে লোম্যানি স্প্রে করলো রণজয়।

এই প্রথম কারোর সাথে ডেটিংয়ে যাচ্ছে। নার্ভাসনেস তো আছেই।

স্কুল কলেজে ভালোলাগা যে আসেনি তা নয়। এসেছে। তবে সেই আসা'টাকে রণজয় কখনও সেভাবে আমল দেয়নি।

সবসময় মনে হতো, যদি চলে যায়, তাহলে সে নিজেই তো সেকেন্ড হ্যান্ড হয়ে যাবে।

তাই তার ঈপ্সিত ফার্স্ট হ্যান্ড নারী সে খুঁজলেও পাবে না।

অন্যের ব্যবহার করা এবং অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া দুটোকেই রণজয় ঠিক মেনে নিতে পারেনা কখনোই।

মনে পড়ে, তখন স্কুল। ওই নাইন কিংবা টেন হবে।

সেঁজুতি প্রায়ই বাড়িতে আসতো।

নিজের টিফিন অফার করতো।

রণজয় তো তখন ক্যাবলাকান্ত গ্রূপের ব্র্যান্ড আম্বাসাডার। বুঝতোই না।

একদিন রণজয়ের ছাদবাগান থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিজের খোঁপায় লাগিয়ে বলেছিল, "আমায় কেমন লাগছে রে দেখতে?"

রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে রণজয় তেড়ে গিয়েছিল,"তোর সাহস কি করে হলো আমার গাছে হাত দেবার?"

কাঁদতে কাঁদতে সেঁজুতি বেরিয়ে গিয়েছিল।

আর কোনোদিন রণজয়ের সাথে কথা বলেনি।

এইচ এসের পর পুনে চলে যায় সেঁজুতি। যাওয়ার আগে দেখা করে বলেছিল, "কুকুরের মুখে জানিস তো, ঘি ভাত রোচে না!"

রণজয় তখনও বোঝেনি। পরে একদিন অরুণাভ বলেছিল ব্যাপারটা।

নিজের মনে মুচকি হাসে রণজয়। সেদিন সেঁজুতিকে 'হ্যাঁ' বললে আজও কি সেঁজুতি তার পাশে থাকতো?

ঘোড়ার ডিম।

তিনি তো এখন শুনি মুম্বইয়ের নামী মডেল। রণজয় কিছুতেই নিজের গার্লফ্রেন্ডকে মডেলিং আলাউ করতো না!

তারপর...

কলেজে একজনকে রণজয়ের ভালো লেগেছিলো।

অভিশ্রুতি।

আহা যেমন নাম তেমন ব্যক্তিত্ব। মারকাটারী সুন্দরী নয় তবু একটা ব্যাপার ছিল। শালা প্রফেসররাও লুলু করতো!

না, রণজয় কোনোদিন প্রপোজ করেনি। ভয়ে, যদি বন্ধুত্বটাও শেষ হয়ে যায়!

পরে অবশ্য জানতে পারে ওর অন্য বয়ফ্রেন্ড ছিল।


শিলার একটা মেসেজ এলো ফোনে... ফরটি ফাইভ মিনিটস টু রিচ।

এইবার বেরিয়ে পড়তেই হয়।



পালক পালক ভ্রু, কোঁকড়া চুল, ফর্সা গাল, ফোলা ঠোঁট। সেদিন ওবাড়িতে কি শিলাকে ঠিক এমনটাই দেখেছিল রণজয়? নাহ! এই মেয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড হতেই পারে না!

না, আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ে দেখার প্রশ্ন নেই। সেদিন স্টাফরুমে অচিন্ত দাও বলছিলেন,"পাত্রী দেখা আর মেয়েদের শাড়ি বাছা দুটোই সমান। পছন্দ এক জায়গায় থেমে থাকে না ভায়া!"

শিলার হাতের উপর মৃদু চাপ দিয়ে রণজয় বলে, "ভালোবাসাটা কখনো পুরোনো হবে না তো?"

******************


কোনো একটা পাহাড়ের চূড়ায় ট্রেকিং করছে রণজয়।

আহা! কী সুন্দর প্রকৃতি!

প্রকৃতি হঠাৎ নিজেকে বরফে ঢেকে ফেললো। রণজয় বরফে গড়াগড়ি খাচ্ছে, ছুঁড়ছে!

আবার সেই বরফ হঠাৎ গলে যেন সমুদ্রে মিশে গেল। পরন্ত বিকেলে সি বিচে বসে রয়েছে রণজয়। কিংবা উদোম ঢেউয়ের সাথে ঝাঁপাই ঝাং!


ঘুমটা ভেঙে গেল।

আহা এবারের গরমের আর পুজোর ছুটিতে এরকম বেড়িয়ে পড়লে মন্দ হয়না!

না থাক। একা ঘুরে কি মজা আছে? বিয়েটা হোক, দুজন মিলে পৃথিবী চষবে।


********************************


স্ট্রবেরী গাছটায় পোকা লেগেছে। বেশ কয়েকদিন সেভাবে যত্ন নেওয়া হয়নি ছাদ বাগানের।

শিলার সাথে বিয়েটা ফাইনাল হয়ে গেছে। বাড়িতে রঙ করানো শুরু হয়েছে। তারপর নানান কাজ, বাড়বেও এরপর।

গাছগুলোই না শেষমেষ মরে যায়!

তবু ভালো বেশ অনেকদিন হনুমানের উৎপাত নেই।

ব্যাটাগুলো যখন আসে সদলবলে আসে। ফল তো দূর, গাছের একটা কচি পাতাও আস্ত রাখে না।

তখন ওই লাঠি উঁচিয়ে রেখে একটা একটা করে টব বারান্দায় তুলে রাখতে হয়। কষ্ট নেই?

আছে তো। হাঁফ ধরে যায় খুব।


মায়ের ড্রয়ার থেকে পেটিকোট কাটার বড় কাঁচি টা নিয়ে আসে রণজয়। কচি ডাল ট্রিম করে দেয়।

নেশার মধ্যে এই একটাই তো জিনিস তার; বাগান করা।

এই বাগান করা নিয়েই না কত অশান্তি!

বাবা মা দুজনেই চাকুরিজীবি।

ছোটবেলাটা তাই বরাবর নিঃসঙ্গতাতেই কেটেছে রণজয়ের। সর্বক্ষণের কাজের পিসি প্রতিমা, ও'ই তো দেখাশোনা করে এসেছে। সন্ধ্যে গড়ালে বাবা মা ফেরে। তখন রণজয়কে গুড বয়টি হয়ে বই সামনে রেখে বসে থাকতে হতো।

কারণ, তখন নাকি ওরা টায়ার্ড। তাই রণজয়ের সব আব্দার তখন অমার্জিত।

সারাদিন বই আর টিভি দেখতে কার ভালো লাগে?

খুব রাগ হতো। মনে হতো বলে দিক,"এতই যখন ব্যস্ততা আমায় জন্ম দিয়েছিলে কেন? নিজেরা মজা লুটলে আর ভোগান্তি আমায় দিলে?"

ঠিক করে নিয়েছিল রণজয়, সব শোধ তুলবে। আজ যেমন কেউ তাকে পাত্তা দেয়না, সেও একদিন সব্বাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলবে। কাউকে পরোয়া করবে না।


তারপর, এক ছুটিতে বাবার বন্ধু বীরেন কাকুর বাড়িতে গিয়ে রণজয় ছাদবাগান দেখে। সেই থেকে নেশাটা পেয়ে বসে তাকে।

বই পত্র শিকেয় ওঠে, 'ঐরকম' ছাদবাগান বানাতে হবেই।

নাইনের ফার্স্ট টার্মিনাল খুব খারাপ হলো।

একদিন বাড়ি ফিরে দেখে মা সব গাছ কাউকে দিয়ে দিয়েছে।

বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল সেদিন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, নিজে রোজগার করে ছাদবাগান বানাবে।

পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস ছিল রণজয়। 

মা চেয়েছিলো, ছেলে যেন এস এস সি তে বসে।

কিন্তু প্রাইমারীটা ক্র্যাক করতে আর ওদিকে গেল না রণজয়।

একদিকে ভালোই হয়েছে। এখন চাকরির যা হাল!

প্রাইমারিটা না করলে বিএড ছাড়া সে এখন ঘাস চিবোতো।


ট্রিম করতে করতে রিংটোন বাজলো। দৌড়ে গেল রণজয়, শিলা কল করেছে। রণজয় ঘড়ি দেখে। ভুলেই গিয়েছিল, শিলা এইসময়েই ফোন করে।

থাক, আজ আর ট্রিম করে কাজ নেই। আজ নাহয় শিলাই সঙ্গ দিক তাকে।


************************

কলেজ স্ট্রিট থেকে কার্ডের শ্যাম্পেল পছন্দ করছে রণজয়।

ফোনে মা,"রিসেপশনের জন্য তাহলে একটা রয়্যাল ব্লু'ই থাক?"

মগজে বিরক্তি বিপ করে ওঠে। প্রিয়গোপালের রয়্যাল ব্লু ঠিক না ভুল সেটা রণজয় জানবে কিকরে?

মা আবার বলে, "ভিডিও কলে আয়, দেখ, তোর তো আবার অনেকরকমের ট্যাবু রয়েছে!"

রণজয় বিরক্তি চেপে বলে, "যা ঠিক মনে হয় নিয়ে নাও।"

ফোনটা ছাড়ার আগে মা শুনিয়ে দেয়, "দেখো পরে আবার না...!!"

বিরক্তিকর!

ফোনটা আবার বাজছে।উফ!

শিলার বাবা।

- হ্যাঁ বলুন।

- হ্যাঁ কাল ফাঁকা আছি। আমি কিন্তু নিজে পছন্দ করে নেব ডিজাইনগুলো। আচ্ছা কালই তাহলে চলুন।

কথা সেরে ফোন কেটে দেয় রণজয়। আসবাবপত্রের ডিজাইন সে নিজে পছন্দ করে নেবে, এমনটাই কথা হলো শিলার বাবার সাথে।

অন্য কারোর পছন্দের ওপর ভরসা বরাবরই কম রণজয়ের। তারওপর বিয়ের ফার্নিচার, সে তো আর বারবার হয় না!

***********************

মান্যভর থেকে অফ হোয়াইট সরওয়ানীটা ট্রায়াল দিয়ে নিয়েছে রণজয়। দারুণ মানিয়েছে। বেশ একটা কেউকেটা মনে হচ্ছে যেন। আরে এমনটাই তো চেয়েছিল সবসময়। ভিড়ের মাঝে জ্বলজ্বল করবে সে।

ফুটপাতের দোকান থেকে বাহারি চাবির রিং নিলো অনেকগুলো। খাটের বক্সের চারটে, আলমারির একটা, ডেসিং টেবিলের একটা।

পরশু ফার্নিচার এসে পড়বে। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে সব।

**************************


সকাল থেকে শোরগোল।

রণজয়ের হট্টগোল একদম ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে কিছু বলাও যাবে না, নিজের বিয়ে বলে কথা!

মাসিরা, মাসতুতো মামাতো বৌদিরা সবাই লেগপুলিং শুরু করে দিয়েছে। অন্য সময় হলে রণজয় ঠিক উত্তর দিয়ে দিতো।

পেট খিদেয় চনচন করছে।

কিচ্ছু কি খেতে নেই?

সক্কাল সকাল ওই অখাদ্য দই চিঁড়ে একটা খাবার হলো?

বাইরে ক্যাটারার লুচি দিচ্ছে।

উঠতে যেতেই রিংটোন।

শিলা।

বিরক্তিকর! এইসময় ওর আবার কী দরকার?

নাহ! এখন কল ধরে লাভ নেই। তার চেয়ে খেয়ে আসা ভালো।

পেটে খিদে থাকলে ব্যক্তিত্ব ফোটে না।


********************

রিসেপশনের শেষে খেতে বসেছে বাড়ির সবাই।

মাটনের মেটের টুকরোটা শিলার পাতে। ওটিই আবার রণজয়ের বড্ড প্রিয়।

ঝপাং করে বউয়ের পাত থেকে তুলে নিলো রণজয়।



স্ত্রী আচার শেষ করে আপাতত ফুলশয্যা।

রাত অনেক হয়েছে। বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ হতে পারে। ওদিকে পাশে জলজ্যান্ত একটা বউ।

হঠাৎ বাইরে বৃষ্টি। এইরে, টবের মাটিতে যে জল জমে যাবে!

পড়িমরি করে দৌড়োয় রণজয়।

একটা একটা টব তোলে।

কাকভেজা হয়ে যখন ফেরে শিলা তখনও বিছানায় স্থানুবত। আশ্চর্য্য! বর এত খাটছে অথচ একবারও ইচ্ছে হলো না গিয়ে একটু সাহায্য করি?


চেঞ্জ করার পর শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে উঠলো। না, আজ আর জাগা ঠিক হবে না।

শিলাকে 'শুয়ে পড়ো' বলে পাশ ফিরলো রণজয়।

**********************************



ঘুম ভেঙেই বউয়ের মুখটা দেখা এখন আর পাঁচটা অভ্যেসের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু আজ পাশের শয্যা হাতড়ে কাউকে না পেয়ে খানিক অবাক লাগলো।

কদিন ধরেই শিলা বেড়াতে যাওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল। কিন্তু এমন সাধের গাছপালা ফেলে কি যাওয়া যায়?

মায়ের ওপর ভরসা করা যাবে না।

জল দেবে না, হনুমান ঠেঙাবে না!



নিচে লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ির রেলিং দিয়ে উঁকি দিয়ে রণজয় দেখলো অনুপ কাকু এসেছেন সস্ত্রীক। এই একটা লোককে অসহ্য লাগে বরাবর। নিজের কাজটি বুঝে দিব্যি পিঠটান দিতে পারেন।

আরে শিলা ওখানে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

রণজয় দৌড়ে যায়, ''তুমি এখানে? চলো দরকার আছে"!

কাকিমা চোখ টিপে পিঠ চাপড়ে দেন, "বাব্বা! বউকে এতো চোখে হারাস রণ? যা যা নিয়ে যা!"

ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করতেই শিলার শাসন, "কী গো তুমি? অতিথি এসেছেন আর তুমি..."

- কী আমি? আমি চাইনা আমার বউ এবাড়িতে অতিথি সৎকারে ব্যস্ত থাকুক। 

- ও কী কথা? বাড়ির বউ...

- না আমার বউ। আমার ওপর ভরসা করে এসেছ, তাই আমি বাদে অন্য কাউকে তোমার সেবা করার দরকার নেই।

ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলা শিলা, "আর যদি সেই সেবায় অন্য কেউ ভাগ বসায়?"

রণজয়ের চোখে হিংস্র কৌতূহল,"মানে? কার কথা বলছো?"

শিলার দুই গালে রক্তিম আভা।

তার মানে শিলা...!!

সবে তো তিনমাস বিয়ে হয়েছে। এরমধ্যেই?

তারমানে এতদিন তার প্রতি শিলার যা কনসার্ন ছিল সব এবার কমতে থাকবে? ভালোবাসার ভাগ হতে থাকবে? বাচ্চাটা রণজয়েরই তো?

বিয়ের পর শিলা বলেছিল, ওর একটা প্রেম ছিল কলেজে পড়াকালীন। 

কিন্তু তখন আর হাত কামড়ানো ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই!

রণজয়ের এতদিনের দেমাক মেয়েটা কেমন গুঁড়িয়ে দিলো!

আচ্ছা, অ্যাবোর্ট করিয়ে নিলে হয় না?

শিলা যদি রাজি না হয়?


*****************************


খাওয়ার পর বাথরুম ঘুরে এসে শোওয়াটা শিলার একটা অভ্যেস। রণজয় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গাছগুলো নজরদারি করছিল। হঠাৎ শিলার আর্তনাদ। দৌড়ে যায় রণজয়। শিলা চিত হয়ে পড়ে রয়েছে, দুই পায়ের মাঝখান থেকে রক্তের একটা সরু স্রোত।

রণজয়ের মেরুদন্ড দিয়েও একটা স্রোত বয়ে গেল; নিশ্চিন্তের।


আজকাল শিলা বড্ড খিটখিটে হয়ে থাকে। ঠিকমত কথা বলে না, একবারের বেশি দুবার সাড়া দেয়না।

অবশ্য তাতো রণজয়ের কাঁচকলা।

তার ভারী দায় পড়েছে বউয়ের আঁচলের নীচে ঘুরঘুর করতে! তাও আবার যে বউ কিনা সেকেন্ড হ্যান্ড! ওতো তাড়াহুড়ো না করলেই হতো। খুঁজলে বাঘের দুধ পাওয়া যায় আর একটা ফ্রেশ মেয়ে পাওয়া যেত না?

আলবাত যেত।

তাছাড়া বউকে বেশি প্যাম্পার করা সিরিয়ালে মানায়, টি আর পি বাড়ায়।

কিন্তু বাস্তবে ওসব করেছ কি পুরুষত্ব হারালে।

পুরুষমানুসের একটা ওজন থাকবে না?

মেয়েদের চোখের জল মানেই তো ন্যাকামো। ও ঠিক শুকিয়ে যাবে নিজে থেকেই।

শিলার সাথে ইচ্ছে করে দূরত্ব রেখেছে রণজয়।

নিজের বাগান, টিভি, ঘুম এসব নিয়েই বেশ আছে সে।

মাস গেলে একটা হাত খরচা, খাওয়া পরা ছাড়া একটা জীবন বাঁচাতে আর কী লাগে মেয়েদের? হুহ!

ট্রেতে চাপিয়ে দুই গ্লাস হরলিক্স নিয়ে এসেছে শিলা।

আগে রণজয় এসব খেত না। এখন খায়। শিলা খায় শরীরের দুর্বলতা ঘোচানোর জন্য, আর রণজয় খায় স্ত্রীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়াটা ঘোচানোর জন্য(হয়তো বা)!


************************

ছাদবাগানের আপেল কুল গাছটায় প্রচুর মুকুল এসেছে। এক একটা ডালে আনুমানিক একশো হবে!

তাছাড়াও পেয়ারা গাছে বেশ কয়েকটা পেয়ারা ডাঁসা হয়েছে, সবেদা ফলেছে!

ছাদে ঘেরা জালটা ছিঁড়ে গেছে।

এইভাবে জাল দিলে কি আর হনুমান আঁটক হয়?

না, বাবার সাথে কথা বলে লোহার খাঁচা বানিয়ে ফেলতে হবে। দেওয়াল তুলে দিলে ঠিকঠাক আলো আসবে না।


রাতে খেতে বসেই কথাটা পাড়লো।

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বোধিসত্ত্ব তাকালেন, বললেন,"দেওয়াল তুলে জাল টাঙাতে চাও, করো। আমার অবর্তমানে তোমারই তো সব দায়িত্ব।"

- দায়িত্ব মানে? খরচ খরচা কি আমারই?

আরতি রে রে করে ওঠেন,"কোন মুখে তুই বলিস রণ? সংসারটা তো আমাদের পেনশনেই চলছে। এক্সট্রা খরচগুলো এবার তুই কর।"

গ্রাস নামিয়ে রাখে রণজয়," এক্সট্রা খরচ আমি একা কেন করবো? আমার একার গাছ আছে নাকি শুধু? মায়ের সাধের চাঁপা জবা নেই?"

আরতি মুখ ভেঙ্গান," আমার চাঁপা জবার জন্য খাঁচা দেওয়ার দরকার নেই। আর যদি তাই বলো, বউ নিয়ে বাপের সংসারে একটা টাকা না ঠেকিয়ে খাচ্ছো, এটাই কি তোমার সাধের মধ্যে পড়ে?"

পাত ঠেলে উঠে পড়েছেন বোধিসত্ত্ব। শিলাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিলার পাতের মাছের পেটিটা তুলে নিলো রণজয়।

অদ্ভুত বাবা-মা! চায়না, ছেলের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, সুদৃঢ় হোক। সবারই কেবল তার পকেটের দিকেই নজর।


****************


বেঁটে ঝাড়গাছের ফলগুলো কালো প্লাস্টিকে মুড়ে রাখতে হচ্ছে। হনুমানের নিশ্চয়ই প্লাস্টিক খুলে ফল খাওয়ার বুদ্ধি এখনও হয়নি!

শিলা এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে,"আমার ভাত কাপড়ের দায়িত্বটাও এতদিন বাবার হাতে ছিল তাহলে?

কেন? বউয়ের দায়িত্ব যখন নিতে পারো না, বিয়ে করেছিলে কেন?"

পাশের বাড়ির জানালাটা খুলে গেল যেন!

শিলা আর ঝগড়া করার জায়গা পেলো না?

ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা...!

- কী হলো? বলো...

পাশের বাড়ির বৌটা মুচকি হাসলো কি?

রণজয় চেঁচিয়ে ওঠে,"এত যখন সম্মান জ্ঞান তাহলে নিজের ভাত কাপড় নিজেই জোটাও!"

কয়েক সেকেন্ড পাথর সেজে হনহন করে বেরিয়ে যায় শিলা।



বেশ একটা হালকা হালকা অনুভূতি। পাথরের মানুষের সাথে বাস করলে মনে হয় পাথরটা বুঝি ঘাড়ের ওপরেই চেপে রয়েছে। ল্যাঠা গেছে বেশ হয়েছে। দুনিয়াটা কি ওতো সোজা?

ভাত কাপড়ের গুমোর! হুহ!

ঠিক যখন টান পড়বে, সুরসুর করে এদিকের পথ নেবে।

**************


ভোর থেকেই ছাদের উপর একটা দুমদুম শব্দ।

হনুমান এসেছে নিশ্চয়ই সদলবলে। ফলগুলো ঢাকা আছে, ভয় নেই।

রণজয় পাশ হয়ে শোয়।


ঘুম ভাঙতে দেরী হলো। চোখ কচলে ছাদে আসতেই যেন মাথায় বাজ!

ছাদ জুড়ে যেন আমফন বয়ে গেছে। গাছদের ডাল ভাঙা, কুলের মঞ্জুরি ছাদ জুড়ে ছড়ানো।

ব্যাটারা ফল না পেয়ে গাছ ভেঙে তান্ডব করে গেছে।

কী হবে এখন?

কাকে দোষারোপ করবে এখন?

জাল টা লাগানো থাকলে...

ইশ! ওতো না ভেবে লাগিয়ে নিলেই তো ভালো হতো।

কেন যে লাগালো না?

ইচ্ছে করছে চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে দোষারোপ করতে।

সব্বাই হিংসে করে রণজয়কে।

সব্বাই, সব্বাই।

কী মনে করে সমস্ত গাছের ডাল পাতা কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে থাকে। টব গুলো সরিয়ে রাখে পাশে। বেঁচে যাওয়া গাছগুলো উপড়ে ফেলে। এত কষ্টের ফসল, সব শেষ হয়ে গেল। আর কী হবে আগলে? কে তার কষ্টের দাম দেবে? এদের জন্যই তো কত তপ্ত গ্রীষ্ম, বর্ষা শীত অগ্রাহ্য করেছে।

কী দাম পেয়েছে তার?


ঘরে ফিরতে গিয়েও টবগুলো নীচে ফেলে দিলো।

বাথরুমে ঘষে ঘষে পায়ের গোড়ালি পরিষ্কার করলো, হাতের কাদা মাটি ধুলো।

মুখে ফেসওয়াশ লাগলো।

তোয়ালে দিয়ে শুকনো করে মুছে ময়েশ্চারাইজার লাগালো। পাতলা চুলে চিরুনি বোলালো।

হালকা সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়লো চারপাশ।

এইতো, বেশ একটা ফ্রেশ ভাব।

কুঁচকে থাকা ভ্রূযুগল টানটান করে বারান্দায় বেতের চেয়ারের শরীর ছাড়লো।

এবার একটা যেন স্বস্তি।

আর কোনও পিছুটান রইলো না।

এবার নিজের ইচ্ছেমত সব কিছুই করতে পারবে রণজয়। সব।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance