চেক-মেট
চেক-মেট


"নমস্কার,আজ ঠিক দশ ঘটিকায় জেলাভিত্তিক মহিলা ক্রিকেট প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।বিজেতা দল পাবেন কুড়ি হাজার টাকা,সাথে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ যিনি হবেন তিনি ভারতীয় টিমের বর্তমান ক্যাপ্টেন সৌদামনি পলমলের কাছে একবছর বিনামূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের সুবিধা পাবেন"।
বলতে বলতে গাড়িটা লিফলেট ছড়াতে ছড়াতে চলে গেলো।মাঠে প্রতিযোগীরা সহ দর্শকরাও উপস্হিত হয়ে গেছেন।প্রথম খেলা কচিপাতা টিমের সাথে বিন্দুবাসিনী টিমের।দুপক্ষের খেলোয়াড়রাই চলে এসেছে মাঠে।নিজেদের শরীরটাকে ব্যায়াম করে আরো সচল করে নিচ্ছে।কচিপাতা টিমের সুস্মিতা এখন রাইজিং স্টার।মেয়েটার জন্য কচিপাতা টিমের নাম ডাক প্রচুর।কোচ অবনী ঠাকুরও ওকে খুব স্নেহ করেন।কচিপাতা টিমের গর্ব হল সুস্মিতা।এর জন্য কম শত্রু তার হয়নি।টিমের মধ্যে দু-একজন মেয়ে ওকে নিয়ে হিংসেতে জ্বলে।অবনীও বোঝেন সেটা।তবে টিমের মেয়েদের মধ্যে ফারাক করলে বা কাউকে মুখ ফুটে বললে টিম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কাউকে কিছু তেমন বলেন না।সুস্মিতাকে একটু বেশী স্নেহ করেন এটা সবাই বুঝতে পারে যদিও।কারণ মেয়েটার একাগ্রতা ওকে সবার প্রিয় করতে না পারলেও গুণীজনদের প্রিয় হতে সাহায্য করেছে।এই টিমেরই আর একজন ভালো খেলোয়াড় মিসমি।অবাঙালী পরিবারের মেয়ে।সুস্মিতা এই টিমের আসার আগে ও ছিলো সেরা।ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ খেতাব কেউ ওর থেকে কাড়তে পারতো না।এই অহঙ্কারটা চূর্ণ হলো সুস্মিতা টিমে আসার পর।মেয়েটার তেমন কোন প্রশিক্ষণই মেলেনি হাতে ধরে ক্রিকেটের।
অবনীর পৈত্রিক বাড়ি গ্রামে।জয়রামবাটি থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে।এমনি একদিন দেশের বাড়ি গিয়ে কিছুদিন ছিলেন।প্রতিদিন বাড়ির সামনে এদের দেখতেন তিনটে লাঠিকে ইঁট দিয়ে সাপোর্ট করে উইকেট বানিয়ে ক্রিকেট খেলতো।ছেলেদের সাথে একটি মেয়েকে দেখতেন খুব উৎফুল্ল হয়ে ক্রিকেট খেলতে।একটু আধটু ত্রুটি থাকলেও খেলত অসাধারণ।এদের প্রশিক্ষণ নেই দেখেই বোঝা যেত।মেয়েটা ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ পেলে অনেকদূর যাবে এটাও বুঝতে পেরেছিলেন অবনী।একদিন অবনী সুস্মিতার কাছে গিয়ে নাম জানতে চাওয়াতে সে খুব গম্ভীর ভাবে বলেছিলো,
"আমি এই টিমের ক্যাপটেন সুস্মিতা।"
এই কথা শুনে অবনী হেসে বলেছিলেন,
"তুমি ক্রিকেট খেলতে চাও?"
সুস্মিতাও এক বাক্যে হ্যাঁ বলেছিলো।সুস্মিতাদের বাড়ি গিয়ে অবনী দেখলেন বৃদ্ধ অসুস্হ বাবা,সেবাপরায়ণ মা,আর তিনজন ছোট ছোট ভাই।দশের ভেতর যাদের বয়স।ঠিকমত খাবার জোটে না শরীর দেখেই মনে হচ্ছে।অবনী ওদেরকে নিজের মনের কথা জানাতে ওরাও একবাক্যে রাজি হয়ে মেয়েকে ছেড়ে দিলেন।তারপর শহরে এনে অবনী সুস্মিতাকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন।বেশীদিন টাইম লাগলো না।মাস খানেকের মধ্যে ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে খেলার জগতে পা রাখলো।সেই থেকে যে সুনাম কুড়িয়েছে আজ দুবছরেও তার এতটুকু নড়চড় হয়নি।যা রোজগার করে তা বাড়িতে পাঠায়।তা দিয়ে পেটগুলো চলে যায় ভালো মতে ওর পরিবারের।অবনীর নিজের বোন হঠাৎ করেই অজানা এক অসুখে মারা যায়,সেই শূন্যতাটা সুস্মিতা পূরণ করে দিয়েছে অনেকটা।আর এইখানেই মিসমির রাগ।শিক্ষিতা,শহুরে ধনী পরিবারের মেয়ে হয়ে একটা গ্রাম্য,অশিক্ষিত গরীব মেয়ের কাছে পিছিয়ে থাকতে অপমানিত বোধ করে।আক্রোশে দূর্ব্যবহারও করে সব সময়,টিমের বাকী ঈর্ষান্বিত মেয়েদের নিয়ে দল পাকিয়ে।অবনী বুঝতে পারেন সব,কিন্তু জোড়ালো প্রতিবাদ করলে পক্ষপাতিত্ব হবে বলে চুপ থাকেন।
যথারীতি ম্যাচ শুরু হলো।আবারও সুস্মিতা ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়ে ট্রফিখানা জিতে নিলো।যেখানে খেলাটা হচ্ছিল সেখানে একটা পাহাড় আছে,নীচে ঝরণা। একদম হাঁটা পথ।টিমের সবাই ঠিক করলো বিকেলের দিকে দেখতে যাবে।অবনীও সাথে ছিলো।পাহাড়ে উঠে সুস্মিতার পাহাড় দেখার আশা পূর্ণ হলো। হঠাৎ নামার সময় সুস্মিতাকে দেখা যাচ্ছে না।তিনদিন খোঁজ করেও কোন খবর মিললো না।হতাশ হয়ে অবনী সহ সবাই ফিরে গেলো।
দুবছর পর আবার সেই এক জায়গায় ক্রিকেট ম্যাচ চলছে।নাইট ক্যুইন বনাম কচিপাতা টিম।ক্রিকেট টিমের কর্ণধার এখন সৌদামনি পলমল।নাইট ক্যুইনের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।তবে মাত্র একবছর ধরে তৈরী ক্লাবটার প্রথম ম্যাচ জেলা ভিত্তিক প্রতিযোগিতা।কেমন খেলে তারা কেউ জানেন না! কচিপাতা টিমের এখন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় মিসমি।তার এই ম্যাচ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই।কারণ একবছরে গজানো কোন টিম সাত বছরের টিমের সাথে পেরে উঠবে না।
খেলা শুরু হলো।প্রথম ব্যাট কচিপাতা টিমের।কচিপাতা টিম ২০০ রান করে অলআউট হয়ে গেলো।এরপর নাইটক্যুইন টিমের খেলা শুরু।চারজন ৭০ রান করে আউট হওয়ার পর নামলো ওদের ক্যাপটেন নাম সুসি।মেয়েটা মুখ ঢাকা হেলমেট পরে নামলো।সাথে রানার নিয়ে।মেয়েটার দুটো পা-নকল।সুসিকে দেখে সবাই ভাবছে নাইট ক্যুইন কি সব খেলোয়াড় এনে খেলাচ্ছে!এতো প্রথম বলেই আউট হয়ে যাবে।কিন্তু না! মেয়েটা শেষ অবধি টিকে গিয়ে টিমকে জিতিয়ে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ প্রাইজটা নিলো।মিসমি অবাক! নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী আসার ভয়ে আতঙ্কিত।সুস্মিতার খেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার।সৌদামনি পলমল সুসি নামের মেয়েটিকে নিয়ে ওর জীবনী বলতে থাকলেন।
"পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে ঝরণার জলে দুদিন অজ্ঞান অবস্হায় থাকে। তারপর ওকে খুঁজে পেয়ে ওর চিকিৎসা করি।কিন্তু পা-দুটো একদম অকেজো হয়ে যায়।হাঁটু থেকে বাদ পড়ে।নকল পা নিয়ে করে প্র্যাকটিস শুরু।এর আগেও মেয়েটি ভালো খেলতো।তাই সহজেই খেলাটা আয়ত্ব করে নিল নকল পা দিয়ে।তবে সবে দুবছর হয়েছে তাই এখনো রান করা নিষেধ।ক'বছর চিকিৎসা চললে সেটাও ঠিক হয়ে যাবে।এবার আপনারা জানবেন না,এই সুসি অরফে সুস্মিতা কি করে পাহাড় থেকে পড়ে গেল?"
নাম-কাহিনী শুনে মিসমি ঘেমে গিয়ে মাঠ ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেলো।কিন্তু পারলো না, ছদ্মবেশী মহিলা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলো।মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই সবার সামনে চেনা সুস্মিতা চলে এলো।ওকে যে মিসমি হিংসার বশে ঠেলে ফেলেছিলো সব বলে, কষিয়ে মিসমির গালে একটা চড় মারলো।দিয়ে মিসমিকে বললো,
"ট্যালেন্ট থাকলে পঙ্গু হলেও সে লড়ে যায়।তোমার আমাকে চেক-মেট করার ক্ষমতা কোনদিনও নেই,বরং তুমি আজ সব হারিয়ে আমার কাছে চেক অ্যান্ড মেট। তার প্রমাণ আশা করি আজ পেয়ে গেছো?"
মিসমি এ্যারেস্ট হলো পুলিশের হাতে।সুস্মিতা জানে কচিপাতাতে আর ওর অবনীদা নেই।কোন খেলার জগতেই আর নেই সে! দ্বিতীয়বার বোন হারিয়ে মানুষটা মরে গেছে মনে মনে।সব খবর রাখতো।সামনে আসতে পারতো না,মিসমির অপরাধকে প্রকাশ্যে আনবে বলে।ওর এখন গন্তব্যস্হল অবনীদার বাড়ি।সে চলল সেই পথে, জয়ের হাসি মুখে নিয়ে।
( সমাপ্ত)