Sonali Basu

Drama

3  

Sonali Basu

Drama

চেক আর মেট

চেক আর মেট

5 mins
1.9K


“এই চেক আর এই মেট! আমি জিতলাম আর তুই সেই হারলি। এই নিয়ে চারবার” দাবার গুটিগুলো বোর্ডের ওপর আবার সাজাতে সাজাতে কথাটা কৌশিক বলল সমুদ্রকে। সমুদ্র হাসলো তারপর বলল “হারলেও আমার কোন দুঃখ নেই, তোর সাথে দেখা হয় গল্প হয় এটাই আমার বড় পাওনা দাবায় জেতার থেকে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিচয় বন্ধুত্ব বল তো। এক সাথে স্কুল কলেজ পেরিয়েছি দুজনে। পাড়ার সবাই বলতো হরিহর আত্মা। কলেজ পেরিয়েও সেরকমই তো থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এবার ভাগ্যবিধাতা অন্যরকম কিছু লিখলো আমাদের নামে। যার কারণে বাকি ত্রিশটা বছর আমরা একজন আরেকজনের থেকে কত দূরে সরে রইলাম। ভাগ্যিস চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তুই এখানে বাড়ি করে এলি নাহলে আর কোনদিন তোর সাথে দেখাও হত না”

কৌশিক বলল “তা ঠিক বলেছিস। আসলে কি জানিস চাকরি জীবনে যারা কাছে আসে বা পাশাপাশি থাকে তারা কেউ ঠিক বন্ধু হয় না কারণ প্রতিদ্বন্ধিতা। কে কাকে ফেলে ওপরে উঠবে সারাক্ষণ শুধু এই চিন্তাই থাকে। চাকরি জীবনে ওপরে উঠে আসতে আমাকেও অনেককেই কায়দা করে ফেলে দিতে হয়েছে। তখন ভাবার সময়ও ছিল না ভাবিওনি। শুধু পাওয়ার নেশা ছিল তাই দু হাতে শুধু নিয়ে গেছি। যখন উপচে পড়লো তখন দেখলাম জৈবিক চাওয়া পূর্ণ হলেও মনটা খালিই রয়ে গেছে। সবাই একটু একটু করে দূরে সরে গেছে। বয়েসটাও যথেষ্ট বেড়ে গেছে তাই আবার নতুন করে চেষ্টা করা সম্ভব না। তাই যেটুকু কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই করেছি”


“তা ভালোই করেছিস। তুই কাছে থাকিস বলে দুদণ্ড গল্প করতে পাই, এই কি কম”

“হ্যাঁ তার জন্য দাবায় প্রতিদিন হারতেও রাজি, কি বল” দুজনেই হেসে উঠলো। ওদের গল্পের মাঝে মীরা, কৌশিকের স্ত্রী ওদের দুজনের জন্য চা নিয়ে এলো। টেবিলে চায়ের ট্রেটা নামিয়ে বলল “কি ব্যাপার আজ দুই বন্ধুতে খুব গল্প হচ্ছে যে। কে জিতলো আজ খেলায়? তুমিই মনে হচ্ছে”

কৌশিক বলল “হ্যাঁ আমিই। আজ পর্যন্ত সব খেলাতেই তো আমিই জিতে এলাম তাই আমি ছাড়া আর কে জিতবে”

এই কথাতে সমুদ্র আর মীরার মধ্যে এক পলকের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো। কৌশিক ততক্ষণে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। মীরা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেলো। সমুদ্রও চা’টা শেষ করে বলল “আজ চলি রে। সন্ধ্যা হয়ে আসতে চলল। ঝুমা অপেক্ষা করবে চা নিয়ে”

“কাল আসবি কিন্তু” কৌশিক বলল।

“হ্যাঁ রে আসবো। তুই তো আর যাবি না তাই আমাকে তো আসতেই হবে”

“আসিস” মাথা নেড়ে সমুদ্র বিদায় নিলো। আজ কৌশিকের কথাগুলো খুব একটা ভালো লাগলো না সমুদ্রর। ও ফিরে আসতে দেখলো ঝুমা বাগানের ফুলগাছগুলির তদারকি শেষ করে বারান্দায় উঠছে। যাক সময়েই এসে পড়েছে তাহলে, ভাবলো ও। হাতমুখ ধুয়ে বারান্দার চেয়ারে বসতে বসতেই ঝুমা চা নিয়ে হাজির। “কি গো তোমাদের দাবা খেলা কেমন হল?” ঝুমা প্রশ্ন করলো। সমুদ্র উত্তর দিলো “ওই প্রতিদিন যেমন হয় আর কি, ও জিতলো আর আমি হারলাম। তারপর গল্প” ঝুমা হাসলো তারপর বলল “এরকম বন্ধুত্ব এতো বছর টিকে আছে এটাই আশ্চর্যের” সমুদ্র আর ও বিষয়ে কোন কথা তুলল না। তারপর চা খেতে খেতে নানা গল্প হল ওদের মধ্যে। তারপর ঝুমা উঠে গেলো রাতের রান্নার জোগাড় করতে।

সমুদ্রের মনে ঝুমার কথাই ঘুরেফিরে আসতে লাগলো। সত্যি কৌশিক আর ওর বন্ধুত্বের সমীকরণটা বেশ অদ্ভুত। কৌশিক বরাবরই একটু উন্নাসিক। ছোট থেকেই ওর মধ্যে, সব ভালো জিনিস আমার, আমিই নেবো আমি ভোগ করবো এরকম একটা ইচ্ছা কাজ করতো। জন্মসূত্রে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ার কারণে ওর মধ্যে এক অদ্ভুত রাগ কাজ করতো। তারপর উচ্চবিত্তের মাঝে জন্মানো সমুদ্রের সাথে আলাপ হল স্কুলে এসে যদিও ওরা এক পাড়ার প্রতিবেশী। বন্ধুত্ব হওয়ার পর এর ওর বাড়িতে যাতায়াতও শুরু হল। কৌশিকের মনে হতে লাগলো ভগবান দুচোখামি করেছেন। সমুদ্রকে অত বৈভব না দিয়ে ওকে কিছুটা দিত পারতেন। শুরু হল ওর মধ্যে কেড়ে নেওয়ার আগ্রাসী মনোভাব। সমুদ্রকে ডিঙিয়ে ভালো ফল করতে হবে পরীক্ষায়। প্রতিবারই কৌশিক প্রথম হত আর সমুদ্র দ্বিতীয়। স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা। সেখানে এসে সমুদ্রের আলাপ হল মীরার সাথে। মিরা সুন্দরী না হলেও সুশ্রী। ওদিকে কৌশিকের সুন্দর চেহারা আর কথাবার্তা আকর্ষিত করলো অনেক মেয়েকেই কিন্তু ওর কাউকেই মনে ধরলো না। ওর মনে হল সমুদ্র এবারেও ওকে টপকে গেলো প্রেমের ক্ষেত্রে। এটা ওর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। সমুদ্র আজও জানেনা কি উপায়ে ও মীরাকে টেনে নিলো ওর বৃত্তের মধ্যে। মীরাও সমুদ্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ওকে বিয়ে করে ওর ঘরণী হল।

সমুদ্র কোন অভিযোগ করেনি কারো কাছে। ও বুঝেছিল যে দূরে সরে যায় সে কাছে থাকবে বলে কখনই আসেনি। কলেজ জীবন পার করে যে যার নিজের জগতে সরে গেলো। সমুদ্রও আর খোঁজ রাখেনি কৌশিকের। ওর ভালো লাগতো অধ্যাপনা, পড়ার শেষে এক নামী কলেজে প্রফেসর হতে পেরেছে। বাড়ি থেকে দেখেশুনে ঝুমার সাথে ওর বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও ঝুমাকে বিনা কোন অজুহাতে মেনে নিয়েছে ওর জীবনে। ঝুমা অবশ্য ঘরণী হিসেবে খুবই ভালো। আজ পর্যন্ত কোন অভিযোগ ওঠেনি ওর বিরুদ্ধে, একজন বৌমা একজন স্ত্রী একজন মা, সব বিষয়ই ও দক্ষতার সাথে সামাল দিয়েছে।


কিন্তু শেষ বয়েসে এসে কৌশিক এ পাড়ায় বাড়ি করাতে আবার পুরনো সম্পর্কটা একটু হলেও জোড়া লেগেছে। যাক যা পেরিয়ে গেছে তা তো ফিরে আসবে না যা আছে সে কদিনই ঠিকঠাক বন্ধুত্বটা থাক তাহলেই হবে।

প্রতিদিন গেলেও পরপর কয়েকদিন যেতে পারলো না সমুদ্র। শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিলো, বয়েস তো হয়েছে না। কয়েকদিন পর ও কৌশিকের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালো প্রতি বিকেলের মতো। কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই শুধু কাজের লোক ছাড়া। তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো কৌশিক নার্সিংহোমে ভর্তি। কারণ সিভিয়ার হার্ট এ্যাটাক। সমুদ্র দৌড়ালো নার্সিংহোমে। আইসিইউতে হাজারো মেশিনের মাঝে নিস্তেজ কৌশিক শুয়ে। বাইরে মীরা ভাবলেশহীন মুখে অপেক্ষা করছে।

সমুদ্র গিয়ে ওর পাশে বসলো। প্রশ্ন করলো “কি করে হল এসব?”

মীরা মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো তারপর বলল “কি আবার হবে। যার হওয়ার ছিল তাই হয়েছে”

“তুমি একটুও চিন্তিত নও ওর জন্য”

“না” একটু থেমে মীরা বলল “তুমি হয়তো ভাবছো এ কেমন স্ত্রী যে স্বামীর অসুখের সময়ও তাকে নিয়ে চিন্তিত নয়। আচ্ছা একটা কথা বলতো কেন ও এতো বছর পর তোমাদের পাড়ায় থাকতে এলো”

“কেন আবার, ওদের পৈত্রিকবাড়ি তো এখানেই ছিল, ও তো আসতেই পারে”

“কিন্তু ওদের পৈত্রিকবাড়ির টানে ও আসেনি। তোমাকে দেখাতে এসেছিলো ও কত সুখে আছে তোমার জীবন থেকে আমাকে কেড়ে নিয়ে আর আমাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল এতো বছর পরে তুমি আবার আমার সামনে এলে আমার মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হয়”

সমুদ্র থ হয়ে গেলো। এরকম হতে পারে ও তো ভাবতেই পারছে না। কি সাংঘাতিক কথা বলছে মীরা! মীরা বলে চলল “আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না বলে ওর মধ্যে টেনশন হচ্ছিলো। পরশু সন্ধ্যায় আকণ্ঠ পান করে আমাকে সামনে বসিয়ে ওর মনের উত্তেজনা বাড়াচ্ছিল এইসব কথা বলে বলে। কিন্তু আমি বোবা হয়ে ছিলাম। হার্টের অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল এই উত্তেজনা নিতে না পেরে হঠাৎই মাটিতে পরে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর এই নার্সিংহোমে”

সমুদ্র স্থির বসে রইলো কিছুক্ষণ তারপর ফিরে এলো বাড়িতে। টাকার জোর আছে, কৌশিক নিশ্চই ভালো হয়ে ফিরবে তাড়াতাড়িই। কিন্তু না! পরেরদিন খবর পেলো কৌশিক ইহলোক ছেড়ে পরলোকে হাঁটা দিয়েছে। দামী শ্মশানবাহী গাড়িতে শ্মশানে গিয়ে হাজির হল কৌশিকের দেহ সাথে সমুদ্রও গিয়েছিলো। ওর ছাই হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে করতে সমুদ্রের মনে হল একটা কথা, কি অদ্ভুত না, যে বুদ্ধি আর টাকার জোরে সবাইকে মাত দিলো কৌশিক আজ সেই টাকার জোরকে মাত দিয়ে প্রাণ কেড়ে নিলো নিয়তি। একেই বোধহয় বলে ভগবানের চেকমেট!       

 


 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama