চার বান্ধবীর দুঃখ সুখ
চার বান্ধবীর দুঃখ সুখ


ওরা চারজন, ইলা, নিশি, যুথিকা আর দিশা । ক্লাস ইলেভেন থেকে ওদের বন্ধুত্ব । এদের মধ্যে ইলা চমৎকার গান গাইতে পারে, স্কুলের অনুষ্ঠানে ইলাকে প্রায়ই দেখা যায় । নিশি খুব সাদামাটা স্বভাবের মেয়ে । আর যূথিকা পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে । তবে এদের মধ্যে দিশা বেশি চনমনে আর অহংকারী । দিশার বাবা ধনী ব্যবসায়ী । দিশা সবসময় তা নিয়ে গর্ব করে । দিশার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে ওর চেয়ে বছর খানেক বড়ো , দিশা তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে যেত আর সব কথাই তার বাকি তিন বান্ধবীকে বলতো । দিশার অতিরিক্ত অহংকারের কথাগুলো বাকি তিন জনের বিরক্ত লাগলেও ওরা খুব ভালো বন্ধুই ছিল চারজনে । একে অপরের পাশে থাকা, সাহায্য করা, এসব ব্যাপারে কোনো ও দ্বিধা ছিল না ওদের ।
স্কুল শেষ হবার পর ওরা একই কলেজে ভর্তি হয় । পড়াশোনা ছাড়াও একসাথে শপিং, পুজোয় সারা রাত ঠাকুর দেখা, সিনেমা দেখতে যাওয়া তাছাড়া ও দিশার বাড়ির গাড়িতে ওরা প্রায়ই দূরে ঘুরতে বেরোতো । এই ব্যাপারে দিশার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি থাকতো ।
দেখতে দেখতে কলেজের দিন একদিন শেষ হয়ে গেল । ইলা জানালো এরপর পর গানটা নিয়ে সে এগোবে । যূথিকা এম.এ পড়বে বলে ঠিক করলো । নিশি বললো, "আমার পক্ষে আর পড়াশোনা এগোনো সম্ভব নয়, টাকার সমস্যা আছে, একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে ।"
এরমধ্যে দিশা জানালো সে বিয়ে করছে তার বয়ফ্রেন্ডকেই , বাড়িতে সবাই রাজি । আরও বললো, "তোদের কিন্তু দুদিন আগে থেকে যেতে হবে আমার বাড়ি ।" দিশা তার বন্ধুদেরকে সেই আগের মতোই অহংকারের প্রকাশ ঘটিয়ে বলতে লাগলো, কত দামী শাড়ি, দামী গয়না, সে বিয়েতে পরছে, তার হবু বর তাকে কত কত দামী গিফ্ট দিয়েছে এবং বিয়ের পর সে কি পরিমান সুখে থাকবে ।
যথা দিনে সতীশের সাথে দিশার বিয়ে হলো । বিয়ের পর সে মুম্বাই চলে গেলো । দিশার বিয়েতেই চার বান্ধবী এক সাথে হল শেষ বারের মতো, তার পর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল । যোগাযোগ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হলো একরকম । দিশা একদমই যোগাযোগ রাখলো না , আর বাকিরাও না থাকার মতোই ।
এরপর কেটে গেলো প্রায় পনেরোটা বছর ..........
আকাশটা সেদিন বেশ মেঘলা, ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে । দিশা কি একটা খুঁজছে তন্ন তন্ন করে । দিশার মা ঘরে এসে বললেন, "কি হলো কি খুঁজছিস তুই?"
দিশা উওর না দিয়ে খুঁজতে থাকলো । অবশেষে পেলো পুরোনো নোটবুকটা যাতে আছে তার বান্ধবীদের ফোন নাম্বার । কিন্তু কারোর নম্বরই সে পেল না, কোনো নাম্বার সুইচ অফ তো কোনটার অস্তিত্ব নেই । দিশা ভীষণ আপসেট হলো । শেষে ইলার বাড়ির ল্যান্ড নাম্বারটা বাজল । ইলার মা'র কাছ থেকে সে জানতে পারলো ইলার শ্বশুর বাড়ি কোথায় এবং ফোন নাম্বার । দিশা এরপর ইলার কাছে ফোন করে এবং বাকিদের কথা জানতে চায় ।
ইলা এতদিন বাদে দিশার ফোন পেয়ে চমকে ওঠে, ইলা জানায় অন্যরা সবাই বিবাহিত আর যোগাযোগ তেমন একটা হয় না । দিশা জানায় আগের মতো সে সবার সাথে ঘুরতে যেতে চায় আর এতবছরের জমানো গল্প করতে চায় । সে আবার সবাইকে এক সাথে দেখতে চায় ।
ইলা বলে উঠে, "ইচ্ছে তো করে, কিন্তু সংসারের চাপে হওয়া মুশকিল।"
দিশা বার বার বলে সবাই যেন রাজি হয় । ইলা শেষ পর্যন্ত নিশি, যূথিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সবাই রাজি হয় । দিশার উদ্যোগে আজ আবার একসাথে ওরা । সবার চোখ খুশিতে ঝকঝকে, একটা অদ্ভুত মুক্তির আনন্দ যেন.....
ওরা পৌঁছালো কালিংপঙ।
তখন সকাল, পাহাড়ের ডাক শুনতে শুনতে বেরিয়ে পড়লো ওরা । সবুজ ভেজানো প্রান্তর, বাহারী পাখির আনাগোনা । বহুক্ষণ ওরা নিশ্চুপ । তারপর দিশাকে বাকিরা থ্যাংকস জানালো, সবাইকে এভাবে একসাথে আনার জন্য । এরপর একে অপরকে প্রশ্ন করলো এতগুলো বছর কে কেমন কাটালো, তাদের জীবনের দুঃখ সুখের গল্পটা .....
প্রথমে নিশি বলতে শুরু করলো, "দিশার বিয়ের পর আমরা কেমন ধীরে ধীরে যে যার মতো ছড়িয়ে গেলাম । দিশার বিয়ের দু'বছর পর দাদার বন্ধুর সাথে বিয়ে হলো আমার । শেখর খুব ভালো ছেলে জানিস তো, কিন্তু এতটা ভালো না হলেই পারতো ।"
ইলা প্রশ্ন করলো, "কেন রে?"
নিশি আবার বলতে শুরু করল, "শেখরের মা ভীষণ রাশভারী মহিলা, বাতিক আছে নানা ধরনের, এঁটোর বিচার, এটা সেটা একগাদা পুজোর নিয়ম । জাস্ট বিরক্তিকর । তাছাড়া দিন রাত আমার বাপের বাড়ি তুলে অপমান ।"
দিশা বললো, "আর তোর হাজব্যান্ড?"
নিশি বললো, "বললাম না তোদের, ও অতিরিক্ত ভালো, মায়ের ভয়ে কোনো কথাই বলতে পারে না । আজ অবধি মায়ের পারমিশন ছাড়া আমাকে কোথায় ও নিয়ে যেতেই পারেনি । আর ওনার পারমিশন পাওয়া মানে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া । আমার শ্বশুরও শাশুড়ির কথায় ওঠে বসে । বাড়িতে উনি একাই সব জানেন, বোঝেন আর বাকিরা যেন মূর্খ । আমার ছেলেকে পর্যন্ত আমার কাছে আসতে দেয় না, আমি নাকি বাজে শিক্ষা দেবো, আমি নাকি ভালো নয়, এসব বোঝায় ছেলেকে।"
যূথিকা বলে ওঠে, "তোর ছেলে আছে আর তাকে তোর শাশুড়ি এ ভাবে ..., তুই প্রতিবাদ কর ।"
নিশি বললো, "বরকে কোনো দিন পাশে পাই নি এ ব্যাপারে, আর প্রতিবাদ, শাশুড়ির মুখের যা ভাষা, শুনলে কান্না পেয়ে যায় । এক এক সময় মনে হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাই । বাবার অবস্থা যদি ভালো হতো, তাহলে বাপের বাড়ি চলে যেতাম, এখন যাওয়া মানে দাদার সংসারে ওঠা, সেটাও তো অশান্তি, তাই মুখ বুজে ওই কয়েদ খানায় পড়ে আছি, কি করবো বল....।"
দিশা বললো, "তাহলে তুই এখানে... , তোকে আসতে দিল?"
নিশি জানালো তাঁর মায়ের শরীর অসুস্থ, দেখতে যাবে এই অজুহাতে শাশুড়িকে কোনোক্রমে রাজি করিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে । আসার সময় সে তার মাকে সবটা জানিয়ে এসেছে ।
নিশির সব কথা শুনে বাকিদের মনখারাপ হয়ে গেল ।
দুপুর গড়িয়েছে, ওরা লাঞ্চটা সেরে নিল । বিকেলের মৃদু আলোয় ইলা হঠাৎ গেয়ে উঠলো দু কলি, যূথিকা বললো, "কতদিন তোর গান শুনি না, থামলি কেন? গা না রে ।"
ইলা বললো, "আমি গান ভুলে গেছিরে, মৃতপ্রায় জায়গায় থাকতে থাকতে, এখানের পরিবেশটা এতো সুন্দর তাই গেয়ে ফেললাম ।"
দিশা বললো, "কি সব বলছিস, কি হয়েছে তোর ?"
ইলা বলতে শুরু করলো, "একটা গানের অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে আমার শাশুড়ির আলাপ হয়, উনিও একজন সঙ্গীত শিল্পী, আমার গান শুনে ওনার ভালো লাগে আর তারপর আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আর দীপ্তর সঙ্গে আমার বিয়ে । দীপ্ত পারিবারিক ব্যবসা সামলাতো ওর বাবার সাথে । ওরা বেশ রিচ, হঠাৎ ব্যবসায় অনেকটা বড় ক্ষতি হয় আর দীপ্তর বাবা সম্পূর্ন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে আজ পুরোপুরি পাগল, তারপর শাশুড়ির স্ট্রোক হল, উনিও বিছানায় শুয়ে । যে বাড়িতে একদিন গানের রেওয়াজ এ জেগে উঠত সে বাড়িটা আজ বেসুরো ।"
নিশি বলে উঠল, "তুই অনেক দিন আগে একবার তোদের গানের অনুষ্ঠানে যাবার জন্য বলেছিলিস, আমি যেতে পারিনি আর তারপর তোর সাথে আর কথাও হয়নি, এর মধ্যে এত কিছু হয়েছে ।"
ইলা বলে, "হ্যাঁ তখন সবটা ঠিক ছিল । দিশা জানতে চায় দীপ্ত কেমন ছেলে । ইলা জানায়, খুব একটা সময় তাকে না দিলেও তার গানকে উৎসাহ দিত, কিন্তু এখন সবসময় কাজে ডুবে থাকে, ব্যবসাটা আগের মতো করার জন্য, এমনকি তাদের মেয়ে কেও সেভাবে সময় দেয় না ।
যূথিকা জিঞ্জাসা করে, ইলা তার বাড়ির এমন অবস্থায় কিভাবে আসতে পারলো । ইলা জানায় তার এক ননদ আছে, তাকে কটাদিন থাকতে বলছে । ননদ খুবই ভালো ।
সন্ধে নেমে এলো । ওরা ফিরল হোটেলের রুম এ । পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা চলছে সবাই হেসে উঠলো একসাথে, তখন যূথিকা বললো, "হাসতে যেন ভুলেই গেছি আজকাল ।"
দিশা বললো, "ও আবার কি কথা ।"
ইলা বললো, "তুই আর তোর হাজবেন্ড একই জায়গায় চাকরি করিস তো, তোদের লাভ ম্যারেজ হয়েছিল তাই না ।"
যূথিকা জানাল, "হ্যাঁ ।" আরও বললো, অনল খুব ভালো ছেলে আর তার পরিবার ও ভাল, কিন্তু আজ তারা সন্তানহীনতার সমস্যায় ভুগছে । চারিদিক থেকে এখন এত চাপ যে ওদের মধ্যে প্রায় অশান্তি হয় । সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে । বাকি বান্ধবীরা তাকে বলে, "এখন অনেক আধুনিক পদ্ধতি হয়েছে তুই চিন্তা করিস না ।"
পরের দিন সকাল কুয়াশাটা যেন কাটছেই না । ওরা হাঁটতে হাঁটতে থামলো আর উঁচু টিলার উপর যে যার মতো বসলো । ইলা বললো, "আচ্ছা দিশা তুই নিশ্চয়ই ভালো আছিস । বিয়ের পর সেই যে মুম্বাই গেলি, তারপর কি করলি এতকাল ।"
দিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "একদিন খুব তোদের কাছে আমি অহংকার করে সব বলতাম তো, তাই সব কিছু ভগবান কেড়ে নিয়েছে আজ ।"
বাকিরা অবাক হয়ে তাকালো দিশার দিকে । দিশা বললো , মুম্বাইতে সতীশের সাথে কিছু বছর থাকার পর সে জানতে পারে সতীশের অন্য আরেক জনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আর তাদের একটি সন্তানও আছে । দিশা জানায়, তার বিয়েটা ভেঙে গেছে । বলতে বলতে দিশার দু চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে, দিশা আরও বললো, "তোদের খুব মিস করছিলাম, খুব একা লাগছিল রে ।" বাকিরা দিশার কান্না থামাতে লাগলো ।
নিশি বললো, "তুই স্কুলে তখন আমাদের সতীশের কথা যা বলতিস, সে এরকম হতে পারে ?"
যূথিকা বলে, "তোকে ও ঠকালো আর তুই কিচ্ছু করলি না ।"
ইলা বললো, "তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো ।"
দিশা বললো, "আমি জানি না, কিচ্ছু জানি না, সতীশ এটা করতে পারে, তাই ভাবিনি কোনো দিন ।"
দিশাকে বাকিরা বোঝালো, "তোর সাথে যা হয়েছে তা ঠিক নয়", আরও বললো, "জীবনটা অনেক বড় এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না । অবলম্বন ছাড়া তুই নতুন করে বাঁচতে শেখ । জীবনের নতুন মানে খোঁজার চেষ্টা কর ।"
ওরা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, কুয়াশা সরিয়ে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে । ওরাও সেদিন একে অপরকে কথা দিল সবাই সবার পাশে থাকবে ঠিক আগের মতো । সবার সমস্যাগুলো এবার থেকে এক সঙ্গে সমাধান করবে । আর নিজেদের জন্য সময় বের করে সব বাধা পেরিয়ে এই ভাবেই বেরিয়ে পড়বে মুক্তির বাতাস নিতে । এবার থেকে শুধু সংসার নয়, মুখ ভার করে ভয়ে নয়, নিজের জন্যেও বাঁচবে ওরা ।
ইলা বলে ওঠে, "শোন নিশি, সংসারে যারা ক্ষমতার জাহির করে, তাদের মিথ্যে দম্ভ তুই ভেঙে দিস ।"
যূথিকা বলে, "যারা জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, ইলা তোকে তাদের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে অন্ধকার কাটবেই ।"
নিশি বললো, "লোকের কথায় কখনো এবার থেকে আর হতাশায় ভুগবিনা, যূথিকা এটা তোর জীবন ।"
"আর শোন দিশা, সব হারিয়েছি, এই বলে জীবনের অযত্ন করিস না, প্রাণ ভরে আবার নতুন করে বাঁচ।"
ওরা নতুন উদ্যমে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেলো আর যোগাযোগ বজায় রাখলো ।