sukanta debnath

Abstract Tragedy

4.3  

sukanta debnath

Abstract Tragedy

ব্যর্থ প্রেমের গল্প কথা

ব্যর্থ প্রেমের গল্প কথা

6 mins
8.4K


একটা শ্রাবণ পেরিয়ে গেল, শান্ত ধীর একটা শ্রাবণ পেরিয়ে গেল, মেঘলা ছিল আকাশ নিজেকে ঢেকে রেখে ছিল পর্দায়, অর্ধস্বচ্ছ, অদ্ভুত। আমি একটা ছায়া দেখলাম, এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চুপ ছায়া, কথা বলেনা, অথচ তার আকাশগঙ্গায় একটি পথ রেখে যায় আমি আমার পা আর এই পথ সর্বনাশা। জানতে চাইবো, যদি ভুল বোঝে, যদি সে তার পা খাদের দিকে রাখে, কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো।

 

অথচ আমি গল্পকার যদিও আমি চরিত্রহীন, থাক নাবলি কথা, থাকনা কিছুটা অংশ সেতু ভাঙা, থাকনা আমি কৌতূহলী থাকনা সে আত্মভোলা।

নেমে এলাম, আমার এখন অনেক কাজ, কাজ! অবশ্যই আমি প্রেম জানিনা, দুঃখ জানিনা, কষ্ট জানিনা। আমি শুধু কাজ জানি। নেমে এসে দাঁড়ালাম ফুটপাতে, বাস আমাকে রেখে এগিয়ে যাবে আরও। নাম না জানা হাজার মানুষ তাদের ঘরে পৌঁছে যাবে। আমার বেলা, জানিনা। অথচ নামলাম কিন্তু মন পড়ে রইলো পাশের সিটে। ফেরার সময় ভাবছি তাকাই আবার ভাবছি আমি বড় নির্লিপ্ত। না তাকানোই হয়তো ঠিক। তবু আমাদের সবার কাছেই একটি প্যাসিভ ভিউ থাকে। যেখানে তাকাই সেখানে দেখিনা, মেয়েরা অবশ্য বেশি করে। সেও হয়তো এতক্ষণ তাই করেছে। কিন্তু এবার একবার অন্তত তার কি বুক চাইবে? প্রেম কি আর আছে অবশিষ্ট, অনেক পুরুষ তো দেখেছে নিশ্চয়ই। 

এতক্ষণ সে বসেছিল বছর চব্বিশ হয়তো পঁচিশ। বিবাহিত! অবশ্যই। হাত জোড়া মোটা গয়না কিছুটা পুরনো আমলের দেখে আমার অন্তত যা মনে হল।

আর চোখ? দেখতে পাইনি

চোখ দেখতে মানা কারণ চোখেই যত মায়া চোখেই যত পাপ।                               

চোখ না থাকতো, লোভ না থাকতো, লোভ না থাকতো, পাপ। কখনও শুনিনি জন্মান্ধ বড় কোনো স্ক্যাম করেছে। আমি তো আমার চোখ নিয়েই জন্মেছি, দেখলাম মনে হল ফুটপাত থেকে বাসের জানালয় কুয়াশা।

হ্যাঁ আমি গল্পকার কল্পনা করতে ভালবাসি। বাসের মধ্যে একা একটি মেয়ে যার বছর খানেক বিয়ে হয়েছে। গয়না গায়ে কোথায় যেতে পারে। সে কি পালিয়ে ছিল বিয়ের আগে, অমতে ছিল সবার। আবার সে কি পালিয়েছে, অসহ্য শ্বশুর বাড়ি?

না: আমার অত ভেবে কাজ কি, আমি তো কর্ম যোগী। সে যদি এমুহূর্তে বাস থেকে নেমে যেত, হাঁটা দিত হাইওয়ে ধরে, এগিয়ে যেতাম, ডাকতাম।

সে সাড়া দিত না, যেভাবে আমার হাজার ডাকে কেউ কখনও সাড়া দেয়নি। বিরাট এক বিষাদ নিয়ে কলেজ যখন সদ্য শেষ করেছি তখন উঠে এসেছিল আমার জীবনের সুবর্ণময় একটি দিন। হ্যাঁ একটিই দিন ছিল যখন আমি আর আমারই মতো ঘর হীন কেউ পাশাপাশি বসেছিল কিছুক্ষণ।

 

তেমন কিছুই না এ মেয়ের বাপ ছিল আমার কারখানারই ঠিকা শ্রমিক। আমার থেকে অবশ্য বয়সে বড় ছিল অনেক তবু নিপাট ভালো মানুষ। এক বৈশাখে বলেছিল খুব ভালো আম নাকি হয় তার বাড়ি। বাড়ি অবশ্য নিজের নয় ভাঁড়া বাড়ি, ডাকেনি এমনিই বলেছিল।

 

তবু একদিন বৃষ্টির মাঝে তার বাড়ির পাশে আটকে পড়ি, তারপর একটি সন্ধে অনন্ত যার বিস্তার। বাড়িতে থাকেন মেয়ে আর বাপ, মায়ের তেমন কোনো কথা শুনিনি কোনো দিন। সে সন্ধে মেয়ে একাই ছিল, আমাকে আম কেটে দিয়েছিল। বটির উপর উপুড় হয়ে বসে একটি মেয়ে ধীর লয়ে আম কাটছে। থ্রি কোয়াটার হাতা দেওয়া একটি কুর্তি গায়ে। এ ছবি আমার চোখে গেঁথে গেছে জন্ম জন্মান্তরের মতো। রাত বাড়লও, হালকা বৃষ্টি মাথায় করে চলে এলাম। এটুকুই আর কিছুই নয়, আমাদের জীবনে এমন অনেক মুহূর্তই আসে যখন, সে সময়টা পেরিয়ে যাওয়ার পর তার মূল্য বুঝতে পারি। কতটা হারালাম বা পেলাম কতটা। আমিও এরপর সারাটা জীবন অনুভব করেছি, ফর্সা একটি হাত ধরার ইচ্ছে কি প্রবল হতে পারে। অথচ না ধরতে পারার ব্যর্থতা কোনো ব্যর্থতাই না। গোটা জীবনটাই যার ব্যর্থ।  

সেটাই বুঝলাম একদিন, যেদিন একটি ফোন পেয়ে দৌড়ে গেলাম। দেখলাম পায়ের পাতাটুকু, বাকি সাদা চাদরে ঢাকা ছিল। বেঁচেছিল তখনও। নিজে থেকেই আগুন লেগেছিল বা লাগিয়ে দিয়েছিল কেউ। সে খবর আর জানা যায়নি। লাস্ট স্টেটমেন্ট দেওয়ার মতো অবস্থাই ছিলনা। জেলে গেল শ্বশুর বাড়ির সবাই কিন্তু মেয়েটি তো আর ফিরে এলনা। আমাদের মনে এক শোকের ছায়া রেখে গেল, যতদূরে যাবে এ ছায়াও সাথে যাবে। তুমি বাঁচাতে পারতে, হ্যাঁ তুমি বাঁচাতে পারতে। দু’মুঠ ভাত আর বছরে কটা মাত্র কাপড়, এটুকুই তো চাহিদা ছিল। আর কি থাকতে পারে, পারতাম না। অন্তত বেঁচে থাকতো।  


মৃত্যু আর কান্নার মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে, একজন না থাকলে অন্যজন অসম্পূর্ণ দেখায়। এখানেও তেমনই ছিল সংসার, হাঁড়ি কড়াই চুলা সব একলা হয়ে পড়ে ছিল এদিক ওদিক। কারোর সাথেই কারোর কোনো ঠোকা লাগেনা, শব্দ হয়না। মেয়ে গেল তো বাপ মনে হল বাঁচল হাঁপ ছেড়ে। মনে হল সে চাই ছিল এমনই কিছু হোক, মুক্তি পাবে সে, মুক্তি পাবে তার মেয়ে। জন্মেছে আর মা হারিয়েছে, না মরার আগে যাবে বাপ। চারজন লোক নেই, এত বড় শহর এত লোক, বন্ধু বান্ধব অথচ। হসপিটালে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পোষ্ট মর্টোম রিপোর্ট আসার অপেক্ষা অথচ কোনো অপেক্ষা নেই। দুজন মাত্র প্রাণী দুটি কোনে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমাদের মাঝে শুয়ে আছে এক অপার শূন্যতা। মানুষ যখন যন্ত্র হয়ে যায় তখন কাজ করে যন্ত্রের মতো কিন্তু যন্ত্রে যখন প্রাণ আসে তখন। এখন অগতির গতি মানেই ঠেক, ঠেকের ছেলে। আমিও তো এমনই এক ঠিকা শ্রমিকের ছেলে ছিলাম ঠেকের ছেলে হওয়ার আগে। একছুটে এলো জনা পনেরো, আরও আসতো বললাম থাক। নিজের মড়াই যখন বয়ে নিতে হবে তখন ভিড় বাড়িয়ে লাভ কি। তারপর আবার মুখাগ্নি আছে।

 

কে করে এত, আমি, না না আমি পারবোনা। কিন্তু মেয়ের বাপ বেহেড মদ খেয়ে পড়ে আছে। আর এও তো এক কাজ, কর সুকান্ত তুই কর এদের যে আর কেউ নেই। সত্যি এদের তো আর কেউ নেই। পাট কাঠির আগুন, আমি আর ওঃ। আমি এ মুখে প্রাণ দিইনি আজ নিজেকে ঘৃণা করতেও ঘৃণা হচ্ছে।


এর চেয়ে খারাপ ছেলে হলে! আমার বন্ধু সুভাষ আমার চোখ পড়তে পারে। আমার হাত ধরলও বলল, সব সময় ভালো ছেলে হয়ে কোনো লাভ নেইরে, কখনও কখনও খারাপ হলে তুইও বাঁচতি সমাজও বাঁচত। কি করছিলাম যেদিন এমেয়ের বিয়ে হয়েছিল। কারখানায় গিয়েছি, কাজ করেছি, টিফিন খেয়েছি, বাড়ি এসেছি, হাত পা ধুয়ে বসেছি সন্ধ্যে বেলা। তারপর হ্যাঁ মনে পড়েছে আজ একটি বিয়েবাড়ি ছিল। ভুলে গেছিলাম, কিন্তু ভুলিনি বাস্তবে, ভোলার ভান করেছি তারপর মনেও করেছি, গিয়েছি রাত করে, সোজা খাওয়ার যায়গায়। কারণ এত আত্মপ্রতারণা করে আর পারিনি সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। অবশ্য কোনো কথা তো ছিলনা, দিইনি। নির্লিপ্ত থাকার অদ্ভুত এক অভিনয়ে আমি অভিমন্যু। সেও অভিমন্যুর স্ত্রী হয়ে জেনে গেছে আজ সব কপাল-লিখন প্রমাণ হবে। যাই হোক শুভ হোক সব, কিন্তু তুমি যদি দেবতায় বিশ্বাস রাখো অপদেবতাকেও ভয় পাওয়া কর্তব্য। সেখানেই কিছুটা ফাঁক রয়ে গেল। রয়ে গেলাম আমি, মাও গেল একদিন। মা কি আমাকে চিনতে পেরেছিল, বলেছিল কিছু?


আজ আমার বাইক নিজে থেকেই ঘুরে গেল। ঘরের দিকে না গিয়ে সেই বাসের চলার দিকে উড়ে গেল সে। কোথায় যাচ্ছি জানিনা, কেন যাচ্ছি জানিনা, নাম কি তার তাও জানিনা। অথচ সে উড়ে যাচ্ছে বাসের জানালার পাশ বরাবর। দেখতে পাচ্ছে চোখের ভিতর কষ্ট লুকিয়ে আছে। স্বজন কাউকে হারানোর কষ্ট, কথা ভাঙার কষ্ট। আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে বলছে কি গোঁসাই কি চাও আবার আমি যে পরস্ত্রী। দেখতে পাচ্ছোনা আমার শাড়িতে রং লেগে আছে। দেখতে পাচ্ছোনা আমার হাতে গয়না। তুমি শুধু তাকিয়ে আছো আঙুলের দিকে, কি আছে ওতে। আর আমি, আমি হয়তো উত্তর বঙ্গের মেয়ে বিয়ে করেছিলাম আসানসোল আজ তোমার শহর দুর্গাপুরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি। কোথায়? যেখানে আমার কেউ নেই, কেউ চেনেনা আমাকে।

 

ওদিকে আমি দেখছি আরেকটি নতুন গল্পের খসড়া খুঁজে পাচ্ছি। অনুভব করছি জীবন দিয়ে শাড়ি যেমনই দামের হোক কোনো ডানা থাকে না।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract