#"বসুধার আ্যডজাস্টমেন্ট"
#"বসুধার আ্যডজাস্টমেন্ট"
এক সুন্দর স্বচ্ছল ছোট্ট পরিবার থেকে মুখার্জি বাড়ির বড়ো বৌ হয়ে আসে বসুধা।
বসুধারা পরপর তিনটি বোন।ও বড়ো।
বসুধার বাবা কাজ করে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে।প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজের খুব চাপ, মাসের শেষের মাইনেটাও সেরকম আহামরি না হলেও ওদের পাঁচজনের সংসারটা বসুধার মা মায়া আর বাবা অখিলেশ সুন্দর করে গুছিয়ে চালিয়ে নিয়ে চলেছে।
মেয়েরা অন্তত কোনো অভাব কখনো টের পায়নি।অখিলেশের রিটায়ার্ডের আর দুবছর বাকী।
সে মনে মনে ভাবে চাকরীটা থাকতে থাকতে বড়োটার বিয়ে দিতে পারলে উনি একটু স্বস্তি পেতেন।নিজের বয়স হচ্ছে, সাথে মেয়েদেরও আস্তে আস্তে বয়সটা নেহাত কম বাড়ছে না।বড়োটা এই বছর সাতাশে পরবে।
মায়া যে একেবারে হাল ছেড়ে বসে আছে, এমনো নয়।চেনাজানা সবাইকেই বলে রেখেছে।স্বামী,স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয় যখন মেয়েরা অন্য ঘরে থাকে।
ছোটোটা এখনো পড়ছে।সামনে ওর ডিগ্ৰী কোর্সের পরীক্ষা।
মাঝেরটি টিউশনি করে।
আর বসুধা গান শেখায়।বাড়িতেই একতলার একটা ছোট্ট ঘরে তার গুটিকয়েক ছাত্রী।পাশের বসতি থেকে আসে।
ওদের মধ্যে আবার দু-তিনজন টাকা দিতে পারেনা।তাতে বসুধার কোনো হাপ্পিত্যেশ নেই।গানটাকে বসুধা খুব ভালোবাসে।ও যে কিছুজনকে শেখাতে পারছে,এর মধ্যেই ওর আনন্দ।
বাড়ন্ত বয়সের বোঝা,পাড়ার কাকীমা,জ্যাঠিমাদের চোখের ইশারায় কথা বলা,মা,বাবার ওকে লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলা,ওর কানে কি কিছুই পৌঁছোয়না!
কিছুই ওর অজানা নেই।
কিন্তু ও কিবা করবে?কথা কম বলে সে,মিশুখে নয়।দেখতেও অত আহামরি কিছুনা হলেও,চলনসই।গুনের মধ্যে ওর আছে শুধু গান।আর নিজের লাভ লোকসান ভুলে ভালোবেসে ফেলে সেইসব মানুষজনকে,যারা অক্ষম।সে অক্ষমতা শুধু শারীরিক নয়,মানসিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকে আসা মানুষগুলোর জন্য।হয়তো বেশী কিছু করার সামর্থ্য ভগবান ওকে দেয়নি।তার মধ্যে থেকেও, সাহায্য করার চেষ্টা করে নিজের মতো করে।
বড্ড আবেগ যে মেয়েটার।
বসতির বাচ্ছাদের বসুধা খুব ভালোবাসে।সপ্তাহে একদিন করে ওদের পেটপুরে ভাত,ডিমের ঝোল খাওয়ায়।পড়াশোনাতেও সাহায্য করে।সবার শরীরের খবর নেয়।
সেদিন পাড়ার শেষেরদিকের বাড়ির কৃষ্ণাবৌদি, বসুধার মা মায়ার কাছে এসেছিল দুপুরবেলা।
সবার যখন ভাতঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসার জোগাড়, কৃষ্ণাবৌদির দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে মায়ার ঘুমের ছন্দপতন ঘটলো।
বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ানোর পর,বসুধা গিয়ে দরজাটা খোলে।বসুধাকে দেখেই কৃষ্ণাবৌদির মুখ থেকে প্রথম বাক্যি,'কীরে,কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছি,তোরা মা মেয়ে কি কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমাচ্ছিলিস!' বসুধা এর উত্তরে কিছু বলবে,সঙ্গে সঙ্গে আরো একটি প্রশ্ন ধেয়ে এলো,তারদিকে।'আর কি চেহারা করেছিস নিজের,একটু যত্নআত্তি কর! মাঘে মাঘে বয়স তো কম হলো না।'
'কই মায়া, কি ঘুম সব তোমাদের! ঘাড়ের ওপর সমত্তো মেয়েরা নেত্ত করছে, আর নাকে সরষের তেল দিয়ে তোমরা ঘুমচ্ছো।কী আক্কেল! এদিকে আমি এই মেয়েগুলোর চিন্তায় চোখের দুটো পাতা এক করতে পারছিনা।'
পাশের ঘর থেকে বসুধার ছোটোবোন প্রিয়া বলে ওঠে,
'মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী।কী এমন খবর নিয়ে এলেন রে! এই বাড়ি থেকে চা,বিস্কুট,সিঙ্গারা খেয়ে বেরিয়েই আবার আমাদের নামেই পাড়ায় গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কত কি বলবে!
বসুধা ততক্ষনে এ ঘরে চলে এসে ছোটোবোনকে চুপ করে থাকতে বলে।
মায়া তাড়াতাড়ি করে উঠে কৃষ্ণাবৌদিকে চেয়ারটা টেনে বসতে দেয়।এগিয়ে গিয়ে ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দেয়।
বসুধাকে ডেকে বলে,কাকীমার জন্য একটু শরবত করে নিয়ে আসতে।
আবার প্রিয়া বলে ওঠে,'কাকীমা তো সাতসমুদ্র পার করে এসেছেন, যাও দিদি,মায়ের কথা মতো প্রথমে শরবত দিয়ে শুরু করো।'
ছোটোবোনের কথায় বসুধা হেসে ওঠে।সে রান্নাঘরে যায় শরবত বানাতে।
কৃষ্ণাবৌদি হাসতে হাসতে বলে,'তোমার বড়োটার জন্য কিছু পেলে?নাকি,হাতগুটিয়ে বসে আছো?'
শাড়ির আঁচলের খুটটা দিয়ে তন্দ্রা জড়ানো চোখটা পরিষ্কার করে বলে,'কোথায় আর পেলাম,যে কটা এসেছিল দোজবর,ছেলেপিলে আছে।নইলে,বসুধার থেকে বয়সের অনেক ফারাক।খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল বসুধার বাবা।সেখানেও দু-তিনজন এসে বাড়িতে দেখে গেছে।ছেলের বাড়ির থেকে পছন্দ হয়নি বসুধাকে।
কৃষ্ণা বৌদি ঠাণ্ডা শরবতে চুমুক দিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে শোনে সবকথা। তারপর একচুমুকে সবটা সাবাড় করে বলে,'শোনো মায়া,তোমার দাদার অফিস কলিগের দিদির একটি ছেলে আছে।বয়সটা ধরো,বসুধার থেকে বছর ছয়েকের বড়ো।দেখতে গেলে, ছেলের বয়স তেমন কিছুই না।ছেলের সরকারী চাকরী।কলকাতা শহরে ত্রিতল বাড়ি।
বাড়িতে বাবা,মা,দিদিশাশুড়ি,বছর কুড়ির ছোটোভাই বর্তমান।ভাইটি ওকালতি পড়ছে।
মায়ার শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে জল পড়ে।একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,'এতোটা সৌভাগ্য কী আমার বসুধার কপালে জুটবে!'এ তুমি কি স্বপ্ন দেখালে গো বৌদি? এযে হাতে স্বর্গ পাওয়া।তবে ওদের কি বসুধাকে পছন্দ হবে?
মায়ার মনে হঠাৎই প্রশ্ন জাগে,'আচ্ছা,বৌদি আমার মেয়ের জন্য তুমি এই সম্বন্ধ আনলে কেনো? ওরা তো বসুধার থেকেও আরো ভালো মেয়ে,সম্ভ্রান্ত পরিবার পেতে পারে।
মা হয়ে বলছি না,বসুধা দেখতে মোটামুটি হলেও ওর অমন সুন্দর ব্যবহার,সকলকে যত্ন করা,এ আজকালকার সময়ে বড়ো অভাব।
তবুও প্রশ্নটা মনে এলো,তাই তোমাকে বললাম।ছেলের কি কোনো রোগ আছে নাকি? আমার মেয়ের তুমি এমন সর্বনাশ কোরোনা গো বৌদি।'
--'নারে বাবা না।হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছো।খামতি তো একটা আছে।তবে সেটা ছেলের না।ছেলের বাবা,মায়ের।'
মায়া সন্দেহের চোখে প্রশ্ন করে,'কী?'
--'হ্যাঁ, ছেলের বাবা,মা দুজনেই জন্মান্ধ।এছাড়া আর কিছুই না।'
--'ও তাই বলো,সেইজন্য আমার বসুধার কথায় তোমার মনে পড়লো!
--'ছেলে তো দিব্য ভালোমানুষ।ওদের কোনো দাবিদাওয়া নেই।শুধু একটু শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে আ্যডজাস্ট করে চলা।
ঐ মানিয়ে নিয়ে থাকবে বসুধা।দেখবে বৌদি ও ঠিক পারবে।'
--'একে শুধু তুমি মানিয়ে নেওয়া বলছো কৃষ্ণাবৌদি!ঘরের বৌ তো নয়,ওদের বাড়িতে বসুধা হবে ওদের অন্ধের লাঠি।মেয়েটা সারাজীবন কষ্টেই কাটাবে।'
এতক্ষন আড়াল থেকে বসুধা ও তার ছোটবোন সবটাই শুনলো।ওর মনের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করলোনা কারোর কাছে।
রাতে মায়া,অখিলেশকে সবকিছুই খুলে বললো।
অখিলেশ মনে মনে চাইছিল, বসুধা নিজের থেকে এ সম্বন্ধে রাজি হলে ও কোনো আপত্তি করবেনা।
এইবয়সে অখিলেশের বা বসুধার কারোরই সে ক্ষমতা নেই, যে কোনো ভালো পরিবার বা সুপাত্রের সন্ধান পায়।
বসুধা যদি ঐ পরিবারের সাথে আ্যডজাস্ট করে থাকতে পারে, তবে তাদের কারোর কোনো আপত্তি নেই।
বসুধা কোনো আপত্তি করেনি।
সেই শক্ত মাটিটাই তো ওর নেই।ওর পরে আরো দুটো বোন আছে।তাছাড়া সত্যিই তো!সে তো কোনো অক্ষমতাকে কোনোদিনই দয়ার চোখে দেখেনি।
বরং সেইসব মানুষগুলোকে আরো বেশী করে ভালোবেসেছে।
তাছাড়া সুখেন পাত্র হিসেবে খুবই ভালো মনের মানুষ।
শ্বশুর,শাশুড়িও খুবই ভালো।বসুধা খুব সুন্দরভাবে আ্যডজাস্ট করে নিয়েছে ওদের সঙ্গে।
এখনতো,নতুন বাবা,মায়ের সঙ্গে আরো বেশী করে একাত্ম হওয়ার জন্য ব্রেইল ভাষা শেখা শুরু করেছে বসুধা।
বিয়ের পর,সুখেনের সাথে বসুধা খুব সুন্দর করে সেজেগুজে দ্বিরাগমনে এসেছিল বাপেরবাড়ি।
রান্নাঘরে মায়া চুপিচুপি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিল,'কীরে সুধা,তুই যা চাপা মনের মানুষ, শ্বশুরবাড়ির সাথে আ্যডজাস্ট করতে পারছিসতো? আর তোর শ্বশুড়,শাশুড়ি!,পারছিসতো মা ওদের সাথে মানিয়ে নিতে?নতুন জীবনে প্রবেশ করে হেরে যাবিনাতো মা আমার?'
বসুধা মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,'আ্যডজাস্টমেন্ট মানেই হেরে যাওয়া নয়,আ্যডজাস্টমেন্ট মানে সুন্দর করে বাঁচা।'
চোখের জল মুছে,মেয়েকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়া।
--'আমি শুরু করেছি মা ,ওদের নিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে, সুখেনের সাথে মিলে নতুন স্বপ্ন দেখতে।
ভালোবাসা দিলে যে সবকিছুই ফিরে পাওয়া যায়।এ আমার জীবনে নতুন অজানা শিক্ষা।
এখানে হারলে চলবেনা।এদের কাছ থেকেও যে অনেক কিছু শেখার আছে। আর এইভাবে মানিয়ে নিয়েই তো সুন্দর ভাবে বাঁচা সম্ভব।'
সমাপ্ত।
