Swati Atarthi

Drama Classics Inspirational

4.5  

Swati Atarthi

Drama Classics Inspirational

#শুধু ভালোবাসা"

#শুধু ভালোবাসা"

5 mins
851



সাত বছর পর রায় বাড়িতে সুখবরটা তাহলে এল এবার।রায়গিন্নীর হেন কোনো মন্দির আর বাদ নেই, যে সেখানে গিয়ে পুজো দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে আসেননি।কোথাও কোনো মন্দির বাদ পড়লে বা উনি কিছু ভুলে গেলে, পদ্ম তো আছেই তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।সুখবরটা যবে থেকে শুনেছে রায়বাড়িতে সবার মন খুশীতে ভরপুর।রায়গিন্নীর একমাত্র ছেলে আবীরের বৌ রুমকীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে সবাই খুবই ব‍্যস্ত।পদ্মর উপর রায়গিন্নীর কড়া হুকুম, সে যেন সময় ধরে তার বৌমাকে খাবার, ফলের রস, ওষুধ সবকিছু ঠিকমতো দেয়। সুখবরটা শোনার পর থেকেই যেন রুমকীর আদর, আপ‍্যায়ন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।


আজ রায়বাড়িতে অতিথিদের ভিড়।রায়গিন্নী.....আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী কাউকে বাদ দেয়নি তার একমাত্র ছেলের বৌ রুমকীর ভরা মাসের সাধের নিমন্ত্রণ করতে। শাশুড়ির এই রকম ব‍্যবস্থায় রুমকী যারপরনাই খুশী। ওনার অত মন্দিরে মন্দিরে পুজো দেওয়ার ঘটা দেখে রুমকী বেশ ভয়ে ভয়েই ছিল। কিন্তু তার শাশুড়ি যে তার সাধে শুধুমাত্র মহিলা মহলকে নিমন্ত্রণ করে ক্ষান্ত থাকেননি,সেখানে পুরুষদেরও সাদর অভ‍্যর্থনা করেছেন, শাশুড়ীমায়ের এই আধুনিক মনের ভাবনাকে মনে মনে সে তারিফই করেছে।

রুমকীর বাপের বাড়ির সবাই ওর দিদি, জামাইবাবু ওদের একমাত্র মেয়ে ঐশীও এসেছে। রুমকীকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে, সামনে বেশ ভালো আয়োজন করে বসানো হয়েছে সকলের মাঝে। ওকে ঘিরে বসে আছে ওর পিসি শাশুড়ি, দুই খুড়তুতো ননদ আর ওর শাশুড়ি মা (রায় গিন্নী)। হঠাৎ পদ্মকে রায় গিন্নী কাছে ডেকে ওর কানে কানে কী যেন একটা ফিসফিস করে বললেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে রুমকীর মা, দিদি দূর থেকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজেরাই কথা বলতে লাগলেন। রুমকী ওর মাকে ইশারায় কাছে ডেকে খুব আবদার করে বললো.........

---- মা, খুব খিদে পেয়ে গেছে, সকাল থেকে তেমন কিছু খায়নি। তুমি একটু পায়েস তুলে,সামনে রাখা বাটি থেকে খাইয়ে দাও। রুমকীর দিদির মেয়ে সেই শুনে তার দিদুনের হাত থেকে বাটিটা নিয়ে তার আদরের মাসিমণিকে খাওয়াতে গেলে পেছন থেকে পদ্ম বললো,

----একটু দাঁড়াও, গিন্নী মার খুব ইচ্ছে আগে টুবাই দাদা বৌদীমণিকে পায়েসটুকু খাওয়াবে, তারপর সবাই তোমরা একএক করে খাইয়ে দিও।

আশেপাশে সবাই ব‍্যপারটা বুঝে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। রুমকীর মা ততক্ষণ 

ঐশীর হাত ধরে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এসেছেন। শাশুড়ির কথামতো রুমকীর খুড়তুতো ননদের ছেলে টুবাই ওকে প্রথম পায়েসটুকু খাওয়ালো। তারপর একে একে সবাই।সঙ্গে সঙ্গে ননদটিও রুমকীকে জানাতে ভুললো না যে আজ এই সাধের পায়েসটা সেই রান্না করেছে।

----আসলে বৌদিভাই, ছেলের মাকেই সাধে, বা কোনো শুভ কাজে পায়েস রান্না করতে হয়।

রুমকী কিছুক্ষণ আগে মনে মনে তার শাশুড়িকে যে আধুনিকা মনের তকমাটা দিয়েছিল, পরমুহূর্তেই সেই ভুল ভেঙে গেল। আরো একটু তাল কাটলো ঠাকুর ঘরে গিয়ে।লোকাচার অনুযায়ী ঠাকুরঘরে একটা প্রদীপ আর নোড়া ঝুড়িচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। রায়গিন্নী রুমকীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন

----যে কোনো একটা ঝুড়ি তুমি তোলো।দেখো আবার কাজটা একটু ভেবেচিন্তে কোরো।

রুমকী অতকিছু ভাবনা চিন্তা না করে একটা ঝুড়ি তুলে ফেলে।আর সেটি ছিল প্রদীপ।যার অর্থ কন্যাসন্তান হবে তার। তখনই রুমকীর পিসি শাশুড়ি থেকে খুড়তুতো ননদ এমনকি এতদিন ধরে যে খাতির ,যত্ন করা,সেই শাশুড়িমায়ের মুখ কালো হয়ে যায়।এতগুলো মাস ধরে তার পূজোপার্বণ , বৌমার যত্ন নেওয়া, তার আদর আপ‍্যায়ন সব যেন এক নিমেষে বিফলে চলে গেল রায়গিন্নীর। একমুহূর্তে গোটা বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল।

রুমকীর আরো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে ওর স্বামী আবীর ঘরে নিয়ে গেল। রুমকী বাড়ির সবার আচরণটা আসতে আসতে বুঝতে পারছিল।মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিল।ক্রমাগত ওকে ভাবতে বাধ্য করছিল,এরপর কী হবে? আবীর রুমকীর কাছে ব‍্যাপারটাকে সহজ করে দিতে চাইছিল।

----তুমি মনটাকে শান্ত করো রুম, তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে।এরকম অনেক বাড়িতেই মায়েরা করে থাকে।অতো গায়ে মেখো না।পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে একটা নাতির আশা করে থাকে..... তাই এই রকম....তুমি একদম টেনশন কোরো না please.....


কিন্তু রুমকী কিছুতেই যেন মেলাতে পারছিল না।এখনোতো সে জন্মায়নি, তার আগেই তোমার মা এরকম আচরণ করছেন।তাহলে এতো যত্ন, এতো মাসধরে এতো খাতির, মাঝেমাঝে আমার আবদার করে কিছু খেতে ইচ্ছে করা, সবকিছু তার একমাত্র ছেলের বংশধর পাওয়ার আশায়।ছেলের বৌয়ের ওপর তাহলে কোনো ভালোবাসায় ছিল না।


সেই রাতেই রুমকীর শরীর খুব অসুস্থ হয়, সোজা নার্সিংহোমে আ্যডমিট করা হোলো।ভোররাতে তার একটা ছোট্ট মিষ্টি ফুটফুটে মেয়ে হোলো।রুমকী বাপেরবাড়ির সবাইকে নার্সিংহোমে উপস্থিত থাকতে দেখলেও ,শ্বশুরবাড়ির কাউকে দেখতে পায়নি।একা আবীর মেঘকালো হাসিভরা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই হাসিতেও যে একটু দুঃখের ছিটেফোঁটা রেশ ছিল, রুমকীর চোখকে কিছুতেই তা আড়াল করতে পারলো না। মুহূর্তের ফারাকে শ্বশুরবাড়ির সবার কাছে তার আদর, সোহাগ যেন সব শেষ হয়ে গেল।আবীর শুধু রুমকীর মাকে বললো যে এইকদিন যেন তার মেয়ে, আর স্ত্রীকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখে।


নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরার পথে আবীর ও রুমকী গাড়িতে বসে, তাদের আদরের ফুটফুটে মেয়েকে কোলে করে বুকে আঁকড়ে ধরে, যে অমোঘ আবেশ ভরা হৃদয় স্পন্দন অনুভব করেছিল তা যেন তাদের মনের দুঃখকে অনেকটাই লাঘব করেছিল। মেয়ের কপালে স্নেহ চুম্বন এঁকে দিয়ে মনে মনে ভাবে ....... ঈশ্বরের অনেক আশীর্বাদ এক সুস্থ শিশু তাদের কোলে।রুমকী নিজের মনের মতো করে মেয়েকে গড়ে পিঠে তুলবে। আবীরের দিকে তাকিয়ে রুমকী বলে....... বাড়ি ফিরে মাকে বোলো...... সমাজে, সংসারে যেখানেই হোক এক নারীর সঙ্গে আর এক নারীর সেতু বন্ধন তখনই তৈরী হবে, যখন ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বিভেদ বন্ধ হবে।বাহ‍্যিক স্মার্ট বা মনের আধুনিক পরিবর্তন শুরু হবে তখনই ,যখন মেয়েরাই মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়াবে। তুমিও তো ছেলে, পুরুষ মানুষ, রায়বাড়ির বংশধর.....তোমার প্রতি ওদের এতো ভালোবাসা, তোমার সবকিছুকে মা যদি এতটা ভালোবাসেন তাহলে তার একমাত্র ছেলের ,মেয়েকেও তো ওদের ঠিক ততটাই ভালোবাসা উচিত। এক ভালোবাসা থেকে আরো ভালোবাসার সৃষ্টি হয়, যেমন আসল থেকে সুদ আরো বেশী মিষ্টি।মনের কুসংস্কার ব‍্যাধিকে সরিয়ে শেষ বয়সে মনকেমনের দিনগুলোকে দূরে ফেলে সংসারে নতুন সদস‍্যর সঙ্গে সময় কাটাক।আবীর হঠাৎ ড্রাইভারকে বলে গাড়ি ঘুরিয়ে শ‍্যামবাজারের দিকে চলো।রুমকী ভুরু  কুঁচকে আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে......

-----কী হোলো, তোমার বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাতে বললে কেন?

মোবাইলটাকে লাউডস্পীকারে দিয়ে রুমকীর মুখের সামনে ধরলো।

----হ‍্যালো, বৌমা, আমার নাতনীকে নিয়ে সোজা ওর বাড়ি এসো.....।আমরা সবাই ওকে দেখবো বলে অপেক্ষা করে আছি।আমার ঘরের লক্ষীকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।তোমার সব কথা আমরা শুনছিলাম মা...... বড়ো ভুল করেছি।সত্যি ই তো..... এই বুড়ো বয়সে ভালোবাসাটুকু নিয়েই থাকতে চায়। মনঃকষ্ট আর সইতে পারবো না মা।

রুমকীর চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠলো...... আবীরের বুকে মাথা রেখে, বললো শুধু একটা প্রশ্ন তোমাকে......

----বলো রুম

----তুমি খুশী?

----খুব খুশী।তুমি সুস্থ আছো, আমাদের মেয়ে সুস্থ আছে.... আর কী চাই!

 সব কুসংস্কারকে দূরে রেখে, নতুন জীবন শুরু হোলো ওদের আদরের মিষ্টুর ছোট্ট ছোট্ট হাত ধরে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama