উপহার
উপহার
গোপালগঞ্জের কানাই বাউরি, মেলায় ব্যাটারি খেলনা বিক্রি করে।কানাইয়ের বাপ-ঠাকুরদা পাতার সেপাই, মাটির লক্ষিপ্রতিমা,পাখি, ঘোড়া, ঘাড়নাড়াবুড়ো, কাঠির চরকা বেঁচতো গাঁয়ের হাটে।কত অন্ন জুগিয়েছে ঐসব পোড়ামাটির জিনিস,দুটো পয়সাও হয়েছিল তখন।কাঁচা ঘরগুলোতে খড়ের ছাউনির বদলে টিনের চাল দেওয়া হয়েছিল।কানাই তখন বাঈশ বছরের জোয়ান মরদ।কোনো কাজ সে তখন করতো না।বলা ভালো কাজে তার মন লাগতো না।নিজের থেকে কম বয়সের কিছু ছেলে ছোকরার সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো।তার লেখাপড়া বলতে গাঁয়ের ইস্কুলে পঞ্চমেই শেষ। এখন কানাইয়ের বাপের বয়স বেড়েছে, তার ওপর গেলো মাসে কোমরে চোট পেয়েছে।কানাই যদি এখন সংসারের হাল না ধরে,তবে কীভাবে চলবে?না.... কানাই তার বাপের দুঃখ বুঝেছে।তার জন্মদাতাকে সে নিরাশ করেনি।
কানাই এখন হাটে যায় মাটির খেলনাগুলো নিয়ে।বিক্রিবাটা সেরকম কিছু হয়না বললেই চলে।আসলে ঐ পাতার আর পোড়ামাটির খেলনা গাঁয়ের ছেলেপিলেরা এখন আর কেউ কিনতে চাই না।শুধুমাত্র শহরের দিদিমণিরা, দাদারা যখন মেলায় আসেন তখন এইসব পোড়ামাটির খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিস কেনে।কিন্তু সে করলে তো সারা বছরের জন্য ওদের সংসারটা চলবে না।গাঁয়ের ছেলেপিলেরা চাই সব কথাবলা, নড়াচড়া ব্যাটারী দেওয়া খেলনা।কানাই সেটা বুঝেছে।তাই এখন সে কলকাতা থেকে ব্যাটারী খেলনা কিনে নিয়ে এসে হাটে বেঁচতে যায়।গোপালগঞ্জের গাঁয়ে সপ্তাহে তিনদিন হাট বসে।সেই হাটে বিক্রি বাটা একটু কমই হয়। বছরে যে দুবার মেলা বসে ,সেখানে ব্যাটারি পুতুলগুলো সাজিয়ে নিয়ে বসলে তাও কচিকাঁচাদের ভিড় লেগে থাকে, কিছু টাকা পকেটে আসে।কিন্ত মেলা তো আর মাসে মাসে হয়না। সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হয়।
একবছর হয়ে গেলো বাড়ি থেকে দেখেশুনে পাশের গাঁয়ের ফুলমণির সাথে কানাইয়ের বিয়ে হয়েছে।বড়ো খাসা হয়েছে গো বৌটা।গায়ের রঙটা কালো হলেও চোখ দুটো তার ভাসা ভাসা।কানাইদের ঘরের পাশের দীঘির জলের মতো কালো,গভীর সেই চোখ।ঐ চোখেই যে কানাই মরেছে।বৌটার বড়ো সাধ হয়েছে সামনের বোশেখে ওদের বিয়ের মাসে একটা রূপোর সিঁদুর কাঠি নেবে।তিন-চারমাস আগে তাঁদের গাঁয়ে ভিডিও হলে কতকগুলি বাংলা সিনেমা লাগিয়েছিল পার্টি অফিসের ছেলেগুলো।কানাই ফুলমণিকে নিয়ে একটা বাংলা সিনেমা "স্বামীর রক্তে রাঙা সিঁদুর" দেখিয়ে নিয়ে আসার পথে, ফুলমণি কানাইকে আদুরে গলায় বলেছিল
---- আমার একটা ঐ সিনেমার নায়িকার মতো রূপোর সিঁদুরকাঠি চাই।সেখানে কেমন সিনেমার নায়িকা নিজের সিঁথিতে বারবার ট্রেনের ঐ হলুদ রঙের টিকিট দিয়ে আবার কখনো চিরুনি দিয়ে সরু করে সিঁদুর পরছিল, আমিও তো ঘরে ঐভাবেই আমার সিঁথি রাঙাই। তারপর দেখলে না সিনেমার নায়কটা একটা রূপোর সিঁদুর কাঠি এনে উপহার দিল। আমার ঠিক ঐরকম নকশা কাটা সিঁদুর কাঠি চাই।"
ঐরাতে বাড়ি ফিরে কানাই ফুলমণিকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে কথা দিয়েছিল,তার জীবনসঙ্গিনীকে ঐ সিনেমার নায়কের মতো সিঁদুর কাঠি উপহার দেবে।
আর তিনদিন পর গোপালগঞ্জের মাঠে মেলা বসবে।সময় বেশি নেই হাতে।তাই কানাই আজ ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়েছে কলকাতার ট্রেন ধরার জন্য।ফুলমণি রাতের কয়েকটি বাসি রুটি আর গুড় কৌটোয় ভরে দিয়েছিল সে রাস্তায় খাবে।ফুলমণি জানে খাওয়ার জন্য বাড়তি পয়সা কানাই খরচা করবে না।তবুও রাতে ফুলমণি ওর মাথায় দিব্যি দিয়ে বলেছিল," শহর থেকে ফেরার সময় দুপুরে কোনো সস্তার হোটেলে দুটো ভাত খেয়ে নিও।ঘরে ফিরতে ফিরতে আঁধার হয়ে যাবে যে"। রুটি গুড় আর কলের জল খেয়ে কানাইয়ের দিব্যি পেট ভরে গিয়েছিল। ফুলকে উপহার দিতে গেলে যেমন বাড়তি খরচা করাও চলেনা, তেমনই বাড়তি পেট ভরানোর প্রয়োজনও নেই তার।সে কলকাতার ক্যানিং স্ট্রীট, চীনে পট্টি থেকে খেলনা কিনে এনে মেলায় বিক্রি করে কিছু পয়সা করবে।ভাবছে এবারের মেলায় কিছু পোড়ামাটির খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিসও রাখবে। শহরের এত্তো লোক আমাদের গাঁয়ের মেলায় ভাগ্যিস আসে।এরা এইসব মাটি,বাঁশ, সুপুরি, নারকেলের পাতা,মালোই দিয়ে তৈরী জিনিসগুলো গাঁয়ের মানুষগুলোর কাছ থেকে কেনে বলেই না, আমরা আমাদের ঘরের বৌ-মেয়েদের শখ পূরণ করার জন্য ওদের কথা দিতে পারি। ফুলমণির মন ভেঙে যাবে এ কানাই সহ্য করতে পারবে না।শহরের মাটিতে দাঁড়িয়ে কানাইয়ের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে... "তোমরা সবাই এসো গো আমার গোপালগঞ্জের মেলায়। তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইলো।এখানে কোনো প্রবেশ মূল্য নাই"।ট্রেনে ফিরতে ফিরতে কানাই ভাবে.... ফুলমণির জন্য উপহার কিনে ওকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেবে।দুচোখ ভরে কানাই দেখবে তার আদরের বৌকে, খুশীর দোলায় সে নিজেকেও ওর আনন্দে ভাসিয়ে দেবে। ফুলমণির ঐ গভীর চোখের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, ওর খিলখিল করে হাসির জন্য, ওদের ছোট্ট ঘরটাকে পাশের বুনো জঙ্গল থেকে পাতা আর বুনোফুল দিয়ে ফুলমণির পরম যত্নে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার জন্য, কানাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে পারে।খুব ইচ্ছা করে কানাইয়ের, ফুলের ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে।
গোপালগঞ্জের জোড়া শিবমন্দিরের বড়ো মাঠে এবার মেলা বসেছে।মেলায় ভালো ভিড় হয়েছে।নাগরদোলা চক্কর মারছে একদিকে, প্যাঁ- পোঁ বাঁশি বাজছে এদিক-ওদিক।ঘটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শিবুময়রা জিলিপি ছাড়ছে, আর একদিকেগাঁয়ের মেয়ে বৌদের হাতের তৈরী জিনিস সাজানো রয়েছে।সেখানেও কিছুটা ভীড় হয়েছে।কিছুটা জটলা কানাইয়ের দোকানের সামনেও হয়েছে।সাতদিনের মেলায় এবার দোকানীদের মনে খুশী খুশী ভাব।ফুলমণিও এসেছে মেলার শেষ দিনে। দিনের শেষে ঘরে ফেরার পথে প্যাঁচার মাথায় পয়সা ঢোকানোর ছোট্ট একটা ছ্যাঁদা করা মাটির ভাড় কিনে দিয়েছিল কানাই।তাদের সংসারে বিপদে আপদে কাজে লাগাবে ফুলমণি। আসলে মেয়েদের যা স্বভাব।রাতে ঘরের আগল দিয়ে কানাই ফুলমণিকে কাছে টেনে বললো......" ফুল, আমার ফুল.... এবার তোমার জন্য একটা রূপোর সিঁদুরকাঠি কিনবো।কাল হাট থেকে ফিরে এসে নিয়ে যাবো তোমাকে গনেশ স্যাঁকরার কাছে, তুমি তৈরী থেকো।ফুলমণি কানাইয়ের কানের কাছে এসে, হেসে বলে...." আর আমিও তোমাকে একটা মিষ্টি উপহার দেবো, যে তোমায় বাবা বলবে গো"।কানাই আর ফুলমণি তাদের ভবিষ্যতের উপহারের জন্য এক সুন্দর অনুভূতির অপেক্ষায় আনন্দে দিন কাটাতে লাগলো।।।।