Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

বসন্তেরও দিন চলে যায়

বসন্তেরও দিন চলে যায়

6 mins
745



আজকাল সকালে কিছুতেই তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙতে চায় না পূরবীর। রাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হওয়ার জন্যই বোধহয় ভোরের দিকে ঘুমটা একেবারে চেপে বসে দু'চোখের পাতায়। অকাতরে ঘুমিয়ে থাকে পূরবী। সৌরেশটাও যেন কী! নিজে দিব্যি ভোরবেলা উঠে মর্নিং ওয়াকে চলে যায়। পূরবীকে একটু ডেকে দিয়ে গেলেই পারে, তা না। রোজ এই চোখে রোদ পড়ে ঘুম ভাঙা, তারপর চলবে চরকি নাচন। ছেলে বুবকা আর ছেলের বৌ তানি, ওদের দুজনেরই অফিস। দুজনে একসাথেই বেরোয় ওরা। ওদের সকালের খাবার, চা, ওদের দুপুরের খাবার, তারপর আবার সৌরেশ আর নিজের জন্য দুপুরের ভাত মাছ ডাল অন্ততপক্ষে, সব ভাগেভাগে করা। হাঁফ ধরে আজকাল। এতো করতে আর শরীরটা আজকাল দেয় না পূরবীর। বুবকা তানি দুজনেই অবশ্য বলে, দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে। কিন্তু পূরবীরই মনটা মানে না। রোজ রোজ বাইরের খাবার খাওয়া কী শরীরের পক্ষে ভালো? সৌরেশও বলে, "অতকিছু করতে হবে না। এবার একটু নিজের মতো নিজের সময় কাটাও তো। অনেক করেছো এতোকাল সংসার সংসার!" পূরবী ভাবে, "ধূর, তাই আবার হয় নাকি? ওদের জন্যই তো আমার বেঁচে থাকা। সৌরেশটার মাথাটা গেছে একেবারে। রিটায়ার করে দিনে তারা দেখছে।"


নিজের মনে নিজের হাজারো কথার নাড়াচাড়া করতে করতে পূরবী ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে রুটির সাথে খাবার আলু ফুলকপির চচ্চড়িটা নামিয়ে নিলো। চায়ের জল চড়িয়ে গলা তুলে হাঁক দিলো, "তানি, বুবকাকে ডেকে নিয়ে আয় মা। রুটি জুড়িয়ে গেলে শক্ত হয়ে যাবে। বুবকাটা আবার শক্ত রুটি খেতে পারে না।" তানি সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় হুড়মুড় করে নামতে নামতে বলে, "মা, তোমার বুবকার কিন্তু দিব্য বত্রিশ পাটি দাঁত আছে। শক্ত রুটি খেতে পারে না আবার কি? তুমি আর এতো চাপ নিও না তো সর্বক্ষণ!" তানির কথা শুনে পূরবী হাসে মনে মনে, "সত্যিই তো, ছেলে বড়ো হয়েছে। সৌরেশও তো একই কথা বলে!" পূরবীর শুধু মনে হয় ও না খেয়াল রাখলে বোধহয় বুবকার খুব অসুবিধা হবে। তবে তানি ভারী মিশুকে মেয়ে। পূরবীকে বড্ড ভালোবাসে। প্রায় রোজই অফিস থেকে ফেরার পথে এটা ওটা হাতে করে নিয়ে আসে পূরবীর জন্য। পূরবী ভারী লজ্জা পায়। তানি ওসব পাত্তা দেয় না। পূরবীকে ঘরে শাড়ির বদলে কাফতান আর হাউসকোট পরা ধরিয়েছে। পূরবীকে ঠেলেঠুলে মাঝে মধ্যেই পার্লারে পাঠায়, ফেসিয়াল, হেয়ার স্পা, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর... কতকিছু যে করায়। আসলে তানিরই চেনা পার্লার। মালিক মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে টুঝিয়ে রেখেছে আগে থাকতেই। তানিকে দেখে আর মাঝে মাঝে নিজেরই অজান্তে বুবুনের সাথে তুলনা চলে আসে। নিজের পেটের মেয়ে বুবুন, অথচ পূরবী একটু বেশি রঙীন শাড়ি পড়লে মুখের ওপর বলে বসে, "মা, তোমার কী দিনদিন বয়সটা বাড়ছে না কমছে বলো তো? জামাইয়ের সামনে, মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর লোকজনের সামনে এমন ছুকরি সেজে চলে এসেছো!" পূরবী লজ্জায় সিঁটিয়ে যায়। ভাবে, "সত্যিই তো! বয়স তো হয়েছে।"




বুবকা আর তানি বেরিয়ে গেলো। পূরবী এইসময় একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসে সৌরেশের সাথে টুকরো টাকরা গেরস্থালির কথাবার্তা বলে। শ্যামাও এসে পড়ে তার মধ্যে। অবশ্য শ্যামা এসে পৌঁছে গেলে পূরবীর আর অত মাথা ঘামাতে হয় না। মেয়েটা বড্ড গুছুনি। একেবারে সাপটে সব সেরে দিয়ে যায়। রাতের রুটির আটা মেখে, তরকারির সবজি কেটে, এমনকি পরেরদিন সকালেও কী লাগবে না লাগবে পূরবীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে গুছিয়ে রেখে যায়। সকালে ওর আসতে একটু দেরী হয়, মা মারা গেছে, অসুস্থ বাবার দেখভাল ওর ওপরেই। নয়তো তানি বলেছিলো, "মা, শ্যামাদিকে আমাদের বাড়ীতেই সব সময়ের জন্য থাকতে বলো।" তবে পূরবী কথাটা পাড়তে পারেনি। হাজার হোক বুড়ো বাবার দেখাশোনা শ্যামার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। নিজের যত অসুবিধাই হোক, কষ্ট করেই পূরবী সকালটা ম্যানেজ করে নেয়। সৌরেশ অবশ্য বলে, "বুবকা তানি তো অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আর তোমার আর আমার খাবার হোম সার্ভিসে বলে দিলেই হয়। এবার একটু দায়িত্ব কমাও দেখি।" পূরবী রাজী হয় না কিছুতেই। ওরকম আবার হয় নাকি... ভাবে।






কথাবার্তার ফাঁকেই বুবুনের ফোন। সৌরেশ ধরেছে। পূরবীর মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু। নিশ্চয়ই অনেক কিছু জোরজার করছে বুবুন। সৌরেশ না না করছে, তা কি করে হয়... বলছে। তারপরই দুম করে বলে বসলো, "আচ্ছা, তোর মায়ের শরীরটা ঠিক নেই। না না, এখন দেওয়া যাবে না। তোর মা এখন বাথরুমে।" সৌরেশ মেয়ের কাছে এমন বেমালুম মিথ্যে বললো কেন?

শ্যামা বলে, "কি গো মামা, তুমি তো বেশ মিছে কথা কইতে পারো। ও মামী দেখো গো..." ফিকফিক করে হাসতে হাসতেই শ্যামা নিজের হাতের কাজ চালু রাখে। পূরবীর মনটা খুঁতখুঁত করে, কী এমন কথা মেয়ের, যে মেয়ের‍ কাছে সৌরেশ মিথ্যেকথা বললো। পূরবীর কুঁচকোনো ভুরু আর করুণ চোখদুটো দেখে সৌরেশ বলে, "এমন কিছু না, তোমার মেয়ের আবদার... তোমার মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে পনেরো দিনের বিদেশ সফরে যাবে। তাই তোমার যমজ নাতিদের তোমার কাছে পনেরো দিনের জন্য রেখে যাবে। কালই গুছিয়ে গাছিয়ে রাখতে আসবে তাদের।" পূরবীর বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো, ভীষণ দুরন্ত বাচ্চা দুটো। তার ওপর পান থেকে চুন খসলেই মেয়ের চোখরাঙানি আর বাক্যবাণ ফাউ পাওনা। কিছু বলতে পারে না পূরবী। ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে। খানিকক্ষণ পরেই তো বুবুন ফোন করবে, কি বলবে ওকে? সৌরেশ বলে তৈরী হয়ে নাও চটপট, একটা ব্যাগে দু-চারদিনের মতো জামাকাপড় গুছিয়ে নাও। খেয়েদেয়ে উঠেই আমরা বেরোচ্ছি। পূরবীকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে সৌরেশ ফোন হাতে নিয়ে ওপরে চলে যায়।




জামাকাপড় পরে তৈরী পূরবী। তানি একটা কমলা আর সবুজের কম্বিনেশনে খুব দামী সালোয়ার কুর্তা এনে দিয়েছিলো পূরবীর জন্মদিনে। প্রাণে ধরে সেটা পরতে পারেনি পূরবী। বুবুন মায়ের এসব উৎপটাং পোশাক আশাক পরা একদম পছন্দ করে না। আজ শ্যামা জোর করে সেই সালোয়ারটাই পরালো পূরবীকে। ঠোঁটে গাঢ় চকলেট রঙা লিপস্টিক, হাতে পায়ের নখে ম্যাচিং নেলপালিশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পূরবীর নিজেকেই অচেনা লাগলো। আর সৌরেশের মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে পূরবীর শরীরেও যেন কী একটা শিহরণ খেলে গেলো। বাড়ী থেকে বেরোনোর সময়ও পূরবী যে তিমিরে সেই তিমিরেই। "যাচ্ছি কোথায় আমরা? আর কেনই বা যাচ্ছি?" পূরবীর জিজ্ঞাসায় সৌরেশের সংক্ষিপ্ত উত্তর, "নিয়ম ভাঙতে।" বাড়ী বন্ধ করে শ্যামার হাতে চাবি ধরিয়ে সৌরেশ বলে, "দিনে যখন হোক একবার এসে গাছে জল আর অ্যাকোরিয়ামের মাছের খাবার দিয়ে যাস। মামী তো তোকে মোটে ছুটি দেয় না। ক'দিন একটু জিরিয়ে নে।" ট্যাক্সিতে উঠে বসেও পূরবী চুপচাপ হয়ে রয়েছে। সকাল থেকে ঝড়ের মতো কী একটা যেন চলছে।




মেয়ের ফোন এলো ট্যাক্সি চলতে শুরু করার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই। সৌরেশ খুব স্বাভাবিক গলায় বলে গেলো, "তুই বরং ছেলেদের রাখার জন্য অন্য ব্যবস্থা কর মা। তোর মায়ের শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না, ডাক্তার বলেছে একটু চেঞ্জের দরকার। তাই আমরা কদিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। সত্যি বলতে কি আমরা এখন বেরিয়ে পড়েছি। দিন পনেরো কুড়ি থাকবো ঝাড়গ্রামে আমার ঐ কলিগের পৈতৃক বাড়ীতে। এই কদিন তানি আর বুবকা ওদের অফিসের গেস্ট হাউসে থেকে যাবে। আর শ্যামার বাবাটাও খুব অসুস্থ। ওকেও তো কদিনের ছুটি দেওয়া দরকার ছিলো নাকি বল... এই অবস্থায় তোর বাচ্চাদের কে সামলাবে বল দেখি মা।" ওপাশে মেয়ে বুবুন কী বললো শোনা না গেলেও, সৌরেশ স্মিতমুখে বললো, "তোর মাতো কোনোদিন তোদের দুই ভাইবোনকে কারোর কাছে রেখে কোথাও যায়নি। আর এতোদিন তুই যখনই কোথাও গেছিস তোর বাচ্চাদেরও একাই সামলেছে। কিন্তু এবার তোর মায়ের শরীরটা ঠিক নেই, শরীর মন বিশ্রাম চাইছে..." সৌরেশের কথা পুরো শেষ হওয়ার আগেই বোধহয় বুবুন রাগ করে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো। ট্যাক্সি হাওড়া ব্রিজে ওঠার আগেই তানির ফোন, আর আব্দার, "একটা সেলফি পাঠাও, দেখি কেমন মানিয়েছে!" সত্যিই তানির বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। পুরো আইডিয়াটা অফিসে বসে ফোনেই অ্যারেঞ্জ করে ফেললো। বুবকার পছন্দকে স্যালুট। এলেম আছে মেয়ের! অথচ বুবুন? বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছিলো সৌরেশের।




পূরবী বড়ো বেশী বোঝে সৌরেশকে। ঠিক তখনই বোধহয় একযুগ পরে পূরবী নিজে এগিয়ে এসে সৌরেশের কাঁধে মাথা রাখে ঘাড় কাত করে, "কই, তোলো সেলফি!" সৌরেশ পূরবীর শরীরে তখন লক্ষ নূপুরের রিনিঝিনি ঝঙ্কার। পূরবী সেই কলেজবেলার মতো কাব্যি করে, "এই বসন্তের প্রতিটি মূহুর্তেই আমাদের বেঁচে ওঠার সময় নতুন করে। বাদাম গাছের পাতাগুলো ঝরে গিয়ে কেমন ন্যাড়া হয়ে যাওয়া, আর হঠাৎ তার ঝরাপাতার বোঁটার অগ্রভাগ থেকে নতুন মুকুলোদ্গম। কচিপাতার সবে গজানোর শুরু। কোমল কমল মুকুলদল খুলিলো বুঝি ঐ, আগুনে রং তার।"

ততক্ষণে ট্যাক্সি এসে থেমেছে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্সের ঠিক সামনেই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance