বসন্ত হারিয়ে গেছে....!
বসন্ত হারিয়ে গেছে....!
' বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা,কারা যে ডাকিল পিছে,বসন্ত এসে গেছে....। '
সত্যিই তো বসন্ত এসে গেছে। প্রকৃতির দক্ষিণ দুয়ার হতে মৃদুমন্দ ফাল্গুনের বাতাস বয়ে এনেছে ঋতুরাজ বসন্তকে। বসন্তের আগমনে উচ্ছসিত সকল জীব। সে লাল পলাশ, শিমুলের গায়ে খেলা করা ভ্রমর, প্রজাপতি হোক বা কোকিলের কুহু কণ্ঠে গান শোনা; প্রতিটা কাজকর্মে প্রকাশ পাচ্ছে আজ বসন্তের কথা। এই ঋতুরাজ কে স্বাগত করতেই তো প্রকৃতি আজ সেজে উঠেছে নিজের বর্ণীল সাজে। শুধু তাই না প্রকৃতির সাথে সাথে সেজে উঠেছে গোটা শহর। আজ যে দোল পূর্ণিমা; আবার আজকের দিনে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের জন্ম হওয়ায় অনেকেই একে বলে গৌর পূর্ণিমা।
"" আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বৃন্দাবন লীলায় ব্রজবাসীগণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি রাধা রানীকে একত্রে পেয়ে সীমাহীন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাঁদের চরণে আবির ঢেলে রঞ্জিত করে দেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারাণীও এ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন।
কিন্তু, ঐ দিনটি ছিল ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথি। ঐ দিনটিতে এতটাই আনন্দ উৎসব হয় যে পরবর্তীতে বৃন্দাবন বাসীরা আর ঐ দিনটিকে ভুলতে পারেন নি। যা আজও মানুষ পালন করে চলেছে। এই দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর রাধারাণীকে বৃন্দাবনবাসীরা প্রেমানন্দে দোলনায় দোল দিয়েছিল বলে এই উৎসবটিকে ‘দোল উৎসব’ বলা হয়। আর ফাল্গুন মাসের এই পূর্ণিমাকে বলা হয় ‘দোল পূর্ণিমা’।""
বড়ো দালান বাড়ির উঠোনে বসে আছে রথীন বাবু ওনার নাতনী কে নিয়ে। বসে বসে অনেক গল্প বলে চলেছেন তিনি। আজকের দিনটাই স্কুল ছুটি থাকায় মহা আনন্দ সানিষ্কার। কিছুক্ষণ পরেই রং খেলতে বেরোবে ও। কেননা আজ যে সকলের প্রিয় রং উৎসব মানে 'বুরা না মানো হোলি হ্যা'! দরজার বাইরে থেকে বন্ধুদের কোলাহল শুনে সানিষ্কা ছুটে যায় বাইরের গ্রিল লাগানো বারান্দার কাছে ।
- " এই সানি বেরিয়ে আয়, রং মাখাবো!" বান্ধবী দের মধ্যে একজন বলে উঠল।
- " যাচ্ছি দাঁড়া জামা টা পাল্টে আসি আগে।"
- " হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি যা, আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি।"
- " হুম" কথাটা শেষ করে এক ছুটে উপরে চলে যায় সানিষ্কা। আলমারি খুলে একটা সুন্দর ফ্রক পড়ে চুলটা আঁচড়ে নেয়। তারপর ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়,
- " ও মা! আমি আসছি!.... আর একটু দেরি হবে হ্যাঁ!"
- " কই দেখি কি পড়লি!" রান্নার হাত টা ধুয়ে পেছনে ঘুরে মেয়েকে দেখতেই ধমকে উঠলেন,
- " সানি কি পড়েছিস এটা? উফফ! এই মেয়েটাকে কীকরে কি বোঝায়!"
- " কেন কি হয়েছে?"
- " কি হয়েছে মানে! নতুন জামা পড়েছিস কেন? যা আগের বছরের হোলির জামাটা বের করে পড়,,, আর হাতে পায়ে তেল কই? আর আগে মুড়ি খা তারপর বাইরে পা রাখবি, নয়তো তোদের বাড়ি ফিরতে দুপুর পেরিয়ে যাবে।"
- " মা প্লিজ! আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি.... ওই আগের বছরের জামা আর হবে না আমার!"
- " হবে না মানে, হতেই হবে। চল দেখছি কেমন না হয়!"
সানিষ্কার মা ওকে টেনে উপরে নিয়ে যায়। মোট-প্যাটরা খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে আগের বছরের রঙে ভর্তি জামাটা। 'না না' করলেও চিপে-চুপে জামা টাকে পরিয়ে দেন। চুল আঁচড়ে জম্পেশ করে তেল মাখিয়ে দিয়ে বেঁধে দেন মাথাটা। হাতে- পায়ে নারকোল তেল মাখিয়ে দিয়ে মুখে বোরোলিন ঘষে দিলেন উনি। সানিষ্কা তো বেজায় চটে গেছে, ওকে দেখে এবার সবাই রাগাবে বলে। মায়ের নির্দেশ মত মুখ ভোঁতা করে ছাদে গিয়ে শরীর টা শুকোতে যায়।
- " কই রে ভূত্নি! আরেহ সানা কি অবস্থা রে তোর!তেল মাখিয়ে তো জুবুজুবু বানিয়ে দিয়েছে তোকে কাকিমা!! হে হে হে!!"
- " এই এই একদম হাসবে না! হাসলে না সব দাঁত ভেঙে দেবো তোমার!"
- " আগে হোলি মেখে রং ধুয়ে দেখা তারপর বকবি.... আজ তো তোকে পুরো শাকচুন্নি বানাবো। চল বাইরে চল....!"
- " অ্যা!... আর তোমাকে কী বানাবো সেটা নিজেই দেখে নেবে.... হ্যুহ!"
অন্য একটা ছাদ থেকে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে আর্নিষ। ও আবার নিজেদের ছাদে এটা ওটা দিয়ে রং বানাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ ঝগড়া করে দুজন নিচে যায়, তারপর শ্রী রাধা-কৃষ্ণের এবং আরাধ্য ভগবানের পায়ে রং দিয়ে আর গুরুজন দের পায়ে রং দিয়ে ছুট লাগায় বাইরে। ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি, হাসি-ঠাট্টায় মুহূর্তের মধ্যে সবাই কালো বাঁদর হয়ে যায়। বাঘ রং, বাঁদর রং, আবির, গুঁড়ো রং এর ওর গায়ে লেপে দেই সবাই। পিচকারি, মগ, বালতি, ঘরের বাইরের দেওয়াল, রাস্তা, রাস্তার কুকুর, ছাগল সবাইকে রং মাখিয়ে দেয় ওরা। তারপর হাতে প্লাস্টিকে করে রং নিয়ে দৌড় দেয় অন্য বন্ধুদের ভূত বানাবে বলে।
.
.
.
.
.
.
.
.
ফোনের রিংটোন এর শব্দে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলো সানিষ্কার। ট্রেনের দুলুনি আর হালকা বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে মা ফোন করছে।
- " হ্যালো! হ্যাঁ মা বলো!"
- " সানি আর কত দেরি তোর আসতে?"
- (ফোনে টাইম চেক করে) " হ্যাঁ আর মোটে পাঁচ মিনিট।"
- " তোকে কতদিন দেখিনি,,,, তাড়াতাড়ি আই না সোনা মা!"
- " উফফ মা তুমি আবার কাঁদছো! আমি তো এসেই গেছি নাকি? আর যাবো না বললাম তো। এতগুলো বছর তোমাদের ছাড়া থাকতে আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল, তুমি কি জানোনা বলো?"
- " হুম রে....! আচ্ছা আর কাঁদবো না, তুই সাবধানে আয়। তোকে আনতে তোর বাবা গেলো স্টেশনে। অনেক কাজ পড়ে আছে আমি রাখছি কেমন?"
- " আচ্ছা।"
ফোন এর কল টা কেটে নেট টা অন করতেই টুং টুং করে অনেকগুলো নোটিফিকেশন ঢুকলো সানিষ্কার ফোনে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ অন করে লোকের স্ট্যাটাস দেখতে দেখতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারল না ও। চোখ বুজে পুরোনো স্মৃতি ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। ছোটোবেলার দিনগুলো না সত্যিই বড্ডো সুন্দর ছিল!
একটা সময় পর সব মানুষই বদলে যায়। নাহ্ নিজেরা চাইনা বদলাতে, সময়ই যেন ওদের বদলে দেয়। কাজের চাপ আর ব্যস্ততায় ঘেরা জীবনগুলো শুধু অতীতের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। ফিরে যেতে চাই ছোটবেলায়; যেখানে না ছিল স্বার্থ-হিংসে আর না ভবিষ্যতের প্রতি চিন্তা। তবে চাইলেই কি আর ফিরে যাওয়া যায় ছোটোবেলার সময়ে? সময় কি আর উল্টো পথে চলে? নাহ্, চলে না বলেই তো আজ বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের হারানো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে। পুরোনো বন্ধু-বান্ধবী সকলেই ব্যস্ত নিজেদের ভবিষ্যৎ গোছাতে, তবে তারা কি জানে এই ভবিষ্যতের চিন্তা করে কত সুন্দর বর্তমান টা তারা হারিয়ে ফেলছে? জানে না বলেই তো এই ডিজিটাল যুগে উইশ আর স্ট্যাটাস এর ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে বহু প্রানবন্ত অনুভূতি। হারিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান সময়। সত্যিই তো 'বসন্ত এসে গেছে' না, 'বসন্ত হারিয়ে গেছে' সেই ছোটোবেলার ভিড়ে।
~•সমাপ্ত•~
