Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

2  

Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

বড়দিন

বড়দিন

7 mins
851


ধুসস… বিরক্ত মুখে চোখটা খুলে ফেলে অরিন। ক্লাসের বাচ্চাগুলোকে অঙ্ক কষতে দিয়ে চোখ দুটো একটু বন্ধ করেছিল সে। না না ঘুমোবার জন্য নয়, একটা বিশেষ কারণে। আজ বাদে কাল বড়দিন। অরিনদের বাড়ির খুব কাছেই রয়েছে শহরের ক্যাথিড্রাল চার্চটা, তাই এই বড়দিনের মরশুম এলেই প্রায় চব্বিশ ঘন্টা অরিনদের বাড়িটা গমগম করতে থাকে চার্চ থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন রকমের শব্দে - কখনও সে চার্চের ঘন্টাই হোক বা প্রার্থনার শব্দ কিংবা কখনও প্রভুর গান তো আবার কখনও মেলায় আনন্দ করতে আসা উৎসুক মানুষদের কোলাহল। বড় আনন্দ করে কাটে অরিনের এই বড়দিন আর নিউ ইয়ার্স ইভ। এই এক সপ্তাহে এমন একটা দিনও যায়না যেদিন বিকেলে অরিনদের আড্ডা জমেনা মেলার মাঠে। এমনিতেই অরিন একটু হুল্লোড় প্রিয় ছেলে, পরিবার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে তার সময় লাগেনা একটুও, তবে বড়দিনের এই সময়টার তো ব্যাপারই আলাদা।

  কিন্তু এ বছর...! এ’বছর ভাগ্যের ফেরে আজ চব্বিশে ডিসেম্বরও অরিনকে পড়ে থাকতে হয়েছে এই প্রত্যন্ত গ্রামে, এবং আগামীকালও তাই থাকতে হবে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার। চাকরির সুবাদে মাস তিনচারেক হল তাকে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে এই প্রত্যন্ত গ্রামে, ঘাঁটি পাড়তে হয়েছে বড় বাস রাস্তার কাছাকাছি একটা চটি জায়গায়, যেখান থেকে আবার অরিনের স্কুলটা পাঁচ কিলোমিটার দূরে। যেখানে বাড়ি ভাড়া করেছে অরিন সেখানেই একটা সাইকেলও ভাড়ায় পেয়েছে সে, ওটাতে চেপেই রোজ পাঁচ পাঁচ দশ কিলোমিটার পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে মনে হয় যেন হাড়গোড়গুলো এই খুলে যাবে বুঝি। আর যেন পারেনা অরিন। এক আধদিনের ছুটি পেলেও দূরত্বের কারণে বাড়ি যাওয়ার উপায় থাকে না, তাই তো তাকে কালকের দিনটাও এখানেই কাটাতে হবে। বুকের ভেতর উপচে ওঠা কষ্টটাকে প্রশমিত করার চেষ্টাতেই একটু আগে সে চোখ দুটো বন্ধ করে চেষ্টা করছিল স্মৃতির অলিন্দ হাতড়ে এক টুকরো বড়দিন তুলে আনার। কিন্তু পারলো কই! একটানা বাইরে হয়ে চলা ওই খুটখুট শব্দটা কিছুতেই তাকে মনোসংযোগ করতে দিচ্ছেনা। কিসের শব্দ কে জানে! আজ কদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে কিন্তু অরিনের ইচ্ছে হয়নি উঠে গিয়ে ওপাশের বন্ধ জানালাটা খুলে দেখে। 


“সার…”

“কি হল?”

“পারছিনা গো।”

“কেন? কাল যে অতো করে বোঝালাম অঙ্কটা তাও কেন পারছিস না? বাড়িতে গিয়ে যে প্র্যাকটিস করতে বলেছিলাম করেছিলি?”

“না গো। ঘরে গিয়ে আর সময় হয়নি।”

“সময় হয়নি! বাব্বা! তা কি এমন করছিলি শুনি।”

“কত্ত কাজ আছে। মায়ের সঙ্গে…”

“থাক থাক আর বলতে হবে না। আজ টিফিনের সময় হয়ে গেছে এখন যা। পরে বুঝিয়ে দেব।”


  বাচ্চাগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে অরিন। এমন একটা জায়গায় প্রথম পোস্টিং পাওয়ার জন্য বরাবর ভাগ্যকে দুষেছে সে, এখন আরও একবার দুষতে শুরু করল। শুধু তো বাড়ির থেকে দূরেই নয়, এ এমন একটা জায়গা যেখানের মানুষজন এখনও একশো বছর পেছনে পড়ে আছে। এদের মধ্যে না আছে শিক্ষার আলো না আছে কোনো প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা। অরিনের নিজেকে একটা খাঁচায় বন্দি পাখি মনে হয়, সে না পারে চাকরিটা ছাড়তে আর না পারে এই মানুষগুলোকে মেনে নিতে। এমনিতেই শহুরে আধুনিক শিক্ষায় বড় হয়েছে সে, তাই এখানে আসার আগে তার কোনো ধারণাই ছিলো না গ্রামের স্কুল কেমন হতে পারে। এখানে এদের দেখে তার যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। এখনও তার সবসময় মনে হয় এই বাচ্চাগুলোকে পড়ানো বৃথা, এদের উন্নতি কোনোদিনও সম্ভব না। এদের বাড়ির বেশিরভাগ লোকই নিজের নামটুকু অবধি স্বাক্ষর করতে জানে না, সেই পরিবেশে থেকে এরাও কোনো উন্নতি করতে পারবেনা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা আরও তেতো হয়ে ওঠে অরিনের। এই একচালার ছোটো স্কুলঘরটাতে শিক্ষক বলতে সে একা। একজন সহকর্মীর অভাবেও হয়তো এই জায়গাটার প্রতি অরিনের বিতৃষ্ণা আরও বেড়ে উঠেছে।


                         ★★★★★


সকালবেলা কারুর ক্রমাগত দরজা ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল অরিনের। চোখ খুলে মোবাইলটা অন করে দেখে আটটা বেজে গেছে। এখানে এমনিতেই রাতে ভালো ঘুম হতে চায়না তার ওপর রোজ সকালে অতখানি সাইকেল করতে হয়, তাই আজকে ছুটি পেয়ে অরিন ভেবেছিল ঘুমিয়ে নেবে বেশ ভালো করে। কিন্তু তার সঙ্গে সকাল সকাল কার দরকার পড়ল কে জানে! দরজাটা খুলেই চমকে যায় অরিন; দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পান্তুয়া, জোনাকি আর অন্নপূর্ণা। এরা তিনজনেই তার স্কুলে ক্লাস ফোরের ছাত্রছাত্রী। 

অরিন অবাক হওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, “তোরা! কি ব্যাপার? আজ তো স্কুল ছুটি।”

মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে জোনাকি ছোটো কাপড়ের পুঁটলিতে বাঁধা একটা কিছু বাড়িয়ে দেয় অরিনের দিকে। অরিন আবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি?”

“খুলেই দেখো না।”

হতভম্ভের মত জোনাকির হাত থেকে পুঁটলিটা নেয় অরিন। পাশ থেকে পান্তুয়া বলে ওঠে, “খুলে দেখো কি আছে।” অরিন লক্ষ্য করে কথাগুলো বলতে বলতে পান্তুয়ার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে।

ঘরের ভেতর ঢুকে ছোট্ট টেবিলটার ওপর পুঁটলিটা রাখে সে, পেছন পেছন ঢোকে তিনটে বাচ্চাও। এরপর পুঁটলিটা খুলতেই অরিন দেখে তার মধ্যে রয়েছে একটা বড়সড় গোল পিঠের মত জিনিস।

“এটা কি রে?” জিজ্ঞেস করে অরিন।

পান্তুয়া জবাব দেয়, “কেক।”

“কেক!”

“হুঁ। আজ তো বড়দিন, তাই…” বলে ওঠে অন্নপূর্ণা। ওর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই পান্তুয়া বলে, “আমরা জানি শহরে তোমরা এইদিন কেক কেটে খাও।”

“সার বাড়ি গিয়ে কেক খেতে পারবেনা বলে কাল তোমার মন খারাপ ছিলো তাই না? এই দেখো ওই জন্য মাকে বলে তোমার জন্য কেক বানিয়ে এনেছি।” মাথার দুপাশে ঝুলতে থাকা বিনুনি দুটোকে দুলিয়ে দুলিয়ে কথাগুলো বলে জোনাকি।

বুকের ভেতর একটা বড়সড় ধাক্কা লাগে অরিনের। কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না যেন। পান্তুয়া ওর হাতটা ধরে বলে, “খাও না সার, পিলিজ।” 

মাথাটা নেড়ে ছুরি দিয়ে এক টুকরো কেটে মুখে ভরে অরিন, গুড়ের মিষ্টি স্বাদটা মিশে যায় গোটা মুখ জুড়ে। 


                           ★★★★★


“সার তোমাদের কেকও এই রকম হয়?”

“না রে।”

“ওহ… তাহলে তোমার ভালো লাগেনি না?” মুখটা কালো করে জিজ্ঞেস করে জোনাকি।

মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অরিন বলে, “আমি তাই বললাম বুঝি?”

“বললে যে তোমাদের কেক এরকম হয়না!”

“হয়নাই তো, কিন্তু জানিস তো আমার নতুন নতুন রকমের কেক খেতে খুব ভালো লাগে আর আজকে তোদের আনা কেকটাও দারুণ লেগেছে। খুব টেস্টি।”

“সত্যি বলছো তুমি?”

“হ্যাঁ রে, আমি তো ভাবছি এবার বাড়ি গেলে আমার মাকেও এরকম কেক বানাতে বলবো।

আচ্ছা এবার বল তো তোরা কি করে জানলি বড়দিনে কেক খেতে হয়?”

“আরে ওই যে দিনু দাদা আছে না সে বলল। দিনু দাদা তো শহরে কাজ করে তাই সে শহরের সওব জানে।” পান্তুয়ার “সব” বলার কায়দাটা দেখে হেসে ফেলে অরিন। 

এখানে আসা অবধি সে একদিনও প্রাণ খুলে কথা বলেনি এভাবে। আজ অনেকদিন পর এরকম করে কথা বলতে পেরে ভারী ভালো লাগছিলো তার। বাচ্চাগুলোর নিয়ে আসা কেকটা ওদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার পর বাচ্চাগুলোরই অনুরোধে ওদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে অরিন, খানিকটা গন্তব্যহীন ভাবেই। এই তিনচার মাস তো বাসা থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাসা এই ছিলো তার রুটিন, আজ একটু নিয়মের ব্যতিক্রম হোক না। সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে অরিন খেয়াল করে পছন্দমতো জায়গায় না পাওয়ার দুঃখে সে আজ অবধি এই গ্রামটাকে ভালো করে দেখেই উঠতে পারেনি।


   চারিদিকে সবুজ গাছপালায় ভর্তি পাতলা জঙ্গল, তার মধ্যিখান দিয়ে চলে গেছে মেঠো পথ। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো টিলা, ওগুলোর নীচেই রয়েছে মানুষের বসতি। পথের ধারে ধারে কত না জানা ফুল ফুটে রয়েছে আর সেগুলোর ওপর কত রংবেরঙের প্রজাপতি উড়ে চলেছে। এতো সুন্দর গ্রামটা!

“কি বললে সার?”

“কিছু না রে। বলছি তোদের গ্রামটা খুব সুন্দর।”

জঙ্গলের পথ ছেড়ে এবার সাইকেল নিয়ে ওরা গ্রামের পথ ধরে। রোজই এই পথেই আসা যাওয়া করে অরিন, শুধু কোনোদিনও এভাবে খেয়াল করে দেখা হয়নি। যত আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিল সে ততই মুগ্ধ হচ্ছিল যেন। কিন্তু সেই সঙ্গে বুকের মধ্যে কেমন একটা কাঁটাও খচখচ করে চলছিল অনবরত। তার শুধুই মনে হচ্ছিল এই তো কালকেও সে এই বাচ্চাগুলোকে অবহেলার চোখে দেখেছিল অথচ ওদের কিন্তু নজর এড়ায়নি অরিনের এই মন খারাপ। তাই তো সকাল সকাল পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অরিনের মন ভালো করতে ওর জন্য কেক বানিয়ে নিয়ে গেছে। আচ্ছা ওদের জায়গায় অরিন থাকলে সে পারতো এমন নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে!

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন সাইকেল নিয়ে স্কুলের পেছন দিকের রাস্তায় এসে পড়ে ওরা। অরিন খেয়াল করে গ্রামেরই একজন বৃদ্ধ ঝাঁকায় করে মাটি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ওই এলাকার বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে মাটি কাটা, একটা কোদালও পড়ে রয়েছে সেখানে। অরিন বুঝতে পারে এই কদিন ধরে তাহলে এই মাটি কাটারই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল স্কুলে বসে; কিন্তু সেই সাথে অবাকও হয় খানিক। এটা তো বাড়িতে মাটি দেওয়ার মরশুম নয়, তাহলে বৃদ্ধ এতো মাটি নিয়ে গিয়ে কি করবে! বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ে অরিন, “ও কাকা বলি এতো মাটি নিয়ে কি করবে?”

মাস্টারমশায়ের ডাকে বিগলিত হয়ে ছুটে আসে বৃদ্ধ, “মাষ্টমশয় বাদদুম বানাবো গো।”

“বাথরুম!”

“হ্যাঁগো। বাদদুম না থাকার জন্য জঙ্গলে শৌচ করতে গিয়ে গেল বর্ষায় আমার বড় মেয়েটাকে সাপ কামড়েছিল। তাই বাদদুম বানাচ্ছি যাতে আর কাউকে জঙ্গলে যেতে না হয়।” কতগুলো বলতে বলতে চকচক করে ওঠে বৃদ্ধের চোখদুটো।

আর আজকে দ্বিতীয়বারের জন্য একটা ধাক্কা খায় অরিন। নিঃশব্দে সে সরে আসে ওখান থেকে, তার বুকের ভেতর যেন একটা ঝড় শুরু হয়েছে, যে ঝড় কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। অরিনের মনের ভেতর ফুটতে থাকা কাঁটাটা তার অজান্তেই কখন যেন জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে তার দুচোখ বেয়ে।

“সার তুমি কাঁদছো?”

জোনাকির কথায় সম্বিৎ ফেরে অরিনের, “কই না তো।”

“এই যে তোমার চোখে জল…!”

মৃদু হেসে ওর চুলগুলো ঘেঁটে দেয় অরিন, “আনন্দেও অনেক সময় চোখে জল আসে রে। আর আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে… খুব।”

“কিসের আনন্দ গো?”

“নতুন কিছু শেখার আনন্দ, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার আনন্দ।” 

অরিনের কথা পুরোপুরি বুঝতে পারে না বাচ্চাগুলো; পান্তুয়া কেমন সন্দীগ্ধ স্বরে বলে ওঠে, “তুমি তো মাষ্টমশয় তোমাকেও শিখতে হয়?”

“শিখতে আমাদের সবাইকে হয় রে, শেখার কোনো শেষ হয়না। মাস্টারমশাইয়েরও অনেক কিছু শেখার থাকে… অনেক কিছু...” কথাগুলো বলতে বলতে দূরে রাস্তার দিকে তাকায় অরিন। দেখতে পায় বৃদ্ধ ঝাঁকা কাঁধে কোনোমতে এগিয়ে চলেছে রাস্তা ধরে। একটা জোরে শ্বাস নেয় অরিন। আজ তার এই সাতাশ বছরের জীবনে প্রথম প্রকৃত বড়দিন। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে গ্রামের সত্যিকারের মাস্টারমশাই হয়ে তাকে আলো দেখাতে হবে গ্রামের এই নিরীহ মানুষগুলোকে যাতে আর কোনোক্রমে নয়, ছুটতে ছুটতে তারা পার হতে পারে জীবনের সব রাস্তা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational