বৃদ্ধাশ্রম ।
বৃদ্ধাশ্রম ।
তখন ভোর পাঁচটা। মোবাইলটা হঠাৎ ই বেজে উঠল। ঘুম জড়ান চোখে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল ফোনে 'আমার বাড়ি' লেখা দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠল। তবে কি মলিমাসির কি কিছু হল!!
--- হ্যালো, মলি সেনের বাড়ির লোক বলছেন?
--- হ্যা, বলছি…..
--- দেখুন, একটা দুঃসংবাদ আছে। উনি আজ ভোর চারটে পঞ্চাশ নাগাদ হার্টফেল করে মারা গেছেন। আপনারা দ্রুত চলে আসুন।
শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। দ্রুত স্ত্রী তিথীকে সঙ্গে নিয়ে 'আমার বাড়ি বৃদ্ধাশ্রমের' দিকে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে মলিমাসির মুখটা বারে বারে ভেসে উঠছে। তিথীকে মলিমাসি সম্পর্কে সব কথা বলা হয়নি। ওকে মলিমাসির সম্পর্কে বলতে বলতে কখন যেন আজান্তেই আমি চলে গেলাম আমার ফেলে আসা সেই সব দিন গুলিতে ,..........
আমি তখন গড়িয়াহাটের একটা একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করি। কতই বা বয়স হবে আমার……..পাঁচ কি ছয়। বালিগঞ্জের এক বস্তির ছেলে আমি। মদখোর, মাতাল বাবার অত্যাচারে আমার মা মাসখানেক আগে গায়ে আগুন দিয়ে মারা যায়। পরদিন থেকে বাবাও নিরুদ্দেশ। আমার নিজের কাকা মাস তিনেক আমার দেখভাল করার পর কাকিমার পরামর্শে আমায় বালিগঞ্জের এক মিষ্টির দোকানে কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই মিষ্টির দোকানেই মলিমাসির সাথে আমার আলাপ। মলিমাসি প্রায়ই মিষ্টি নিতে এই দোকানে আসতেন। আমাকে দেখতেন, মাঝে মধ্যে কথাও বলতেন। ওই ছোট্ট বয়সে মলিমাসিকে দেখলেই কেন জানি না আমার সরস্বতী ঠাকুরের কথা মনে হত। খুব সুশ্রী, মাথা ভরা লম্বা কোঁকড়ানো চুল ছিল। বেশিরভাগ সমযে তিনি তাঁতের শাড়ি পড়তেন।
ওই দোকানেই একদিন আমার হাত থেকে একটা বড় দইয়ের হাঁড়ি পড়ে যাওয়ায় দোকানের ম্যানেজার উমাকাকু আমায় বেদম মার মারতে থাকে। লোহার হাতা দিয়ে মারতেই আমার কচি হাতে খানিকটা কেটে যায়। সেকাটা দাগ এখনো আছে আমার হাতে। ভাগ্যক্রমে মলিমাসি সেই সময় এসে আমাকে উদ্ধার করে। উমাকাকু ক্রুদ্ধ মলিমাসির হাতে পায়ে ধরে এক প্রকার নিস্তার পায়। আমাকে তিনি তার বাড়িতে নিয়ে আসে, এর পর থেকে আমার জীবন সম্পূর্ন পাল্টে যেতে থাকে।
মলিমাসির একমাত্র ছেলে রাজা আমার থেকে প্রায় দশ-বার বছরের বড়। রাজা পড়াশোনায় তুখোড়, বই আর নিজের ক্যারিয়ার ছাড়া কিচ্ছুই চিনত না। কয়েক বছরের মধ্যেই সে ডাক্তারি পড়তে বিদেশে চলে যায়। এদিকে মলিমাসি আমায় বাড়িতেই পড়াশোনা শিখিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে কলেজে ভর্তি করে দেয়। ইতিমধ্যে মেসোমশাই গত হয়েছেন। কিছু দিন পরে আমি জানতে পারি যে ছেলেকে বিদেশে ডাক্তারী পড়াতে মলিমাসি তার এক মাত্র সম্বল, তার বাড়িটাকে ব্যাংকে বন্ধক রেখেছিলেন। বছর দুয়েকের মধ্যে রাজা বিদেশেই সংসার পেতে ওখানেই পাকাপাকিভাবে থাকার কথা মাকে জানিয়ে দেয়। মলিমাসিকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার কথা সে বলেনি এমন নয়, মাসি কিন্তু রাজি হয়নি।আগে নিয়ম করে সে মাকে দেখতে আসত। বেশ কয়েক বছর হল একমাত্র ফোনে ফোনেই মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের কাজটা চলছে। এবং সেটাও প্রায় অনিয়মিত। শেষবার এসে অসুস্থ মলিমাসিকে বালিগঞ্জের এক বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে দেখভালের জন্য।
এদিকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেই আমি একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলি। কিছুদিনের মধ্যেই বালিগঞ্জের কাছেই একটা ফ্লাটবাড়ি ভাড়া নেই। মনে মনে খুবই আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে মলিমাসিকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিজের কাছে রাখব। ঈশ্বর তুল্য যে মহিলা নিঃস্বার্থ ভাবে রাস্তা থেকে তুলে নিজের সন্তানের মত আমাকে মানুষ করে তুলেছে তাকে নিজের কাছে রেখে তার সেবা যত্ন করা এক পরমপূণ্যের কাজ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। ওই দিন বিকেলে বৃদ্ধাশ্রমে মলিমাসিকে ফ্ল্যাটের খবর ও তাকে নিজের কাছে রাখার প্রস্তাব দিলে সে হাত ধরে অঝরে কেঁদে ওঠে। স্বভিমানি মলিমাসি আমার মাথায় তার কাঁপা কাঁপা হাত রেখে অবশিষ্ট জীবনটা এখানেই থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করে।
ইতিমধ্যে তিথী নামের এক অনাথ মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি তাকে বিয়ে করি। বিয়ের দিন 'আমার বাড়ি' বৃদ্ধাশ্রমের সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে আশীর্বাদ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অসুস্থ দু এক জন বাদে প্রায় সকলেই হাজির ছিল বিয়েতে। মলিমাসি হুইলচেয়ারে বসেই তার সঙ্গীসাথী দের সাথে অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। অনেক অনেক দিন বাদে মলিমাসিকে এমন হাসতে দেখেছিলাম। সেই হাসি দেখে কেন জানিনা অজান্তেই আমার চোখের কোল ভিজে গেছিল,........ হয়ত সে অশ্রু ছিল তার প্রতি শ্রদ্ধামাখা একপ্রকার আনন্দাশ্রু ।।