বোঝা
বোঝা
কুঁজো লোকটা যেদিন গ্রামে এলো সেদিন থেকেই কেমন আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক তার- আমাদের পাড়ার দুলাল-খুড়োর সঙ্গে। খুড়ো গ্রামের সবথেকে প্রবীণ লোক, সকলকেই তিনি সুপরামর্শ দেন, সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখে তাঁকে, সম্মান দিয়ে কথা বলে তাঁর সঙ্গে।
তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক, জীবনের ওঠা-পড়া, ভালো-মন্দ অনেক দেখেছেন তিনি। তাই তাঁকে কোনো কিছুতেই সহসা বিচলিত হতে দেখিনি আমরা কখনও। ধীর স্থির এবং ঠাণ্ডা মাথার মানুষ সেই তিনিই, ঐ কুঁজো বিক্রমকে প্রথমদিন দেখেই বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন!
সে বেচারা বহুদূর থেকে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছিল এই গ্রামে। খুড়ো কি বুঝেছিলেন জানিনা, কিন্তু তাঁর পরামর্শমতো তখন গ্রামের মুরুব্বীরা কুঁজোকে গ্রামের ভিতরে থাকতে দেয়নি। অবশ্য গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের বদান্যতায়, তার আশ্রয় একটা জুটলো- গ্রামের শেষপ্রান্তে নদীর ধারে বটতলায়।
যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই কুঁজো কিন্তু গ্রামে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। প্রথমদিকে গ্রামে ঢোকার অনুমতি না থাকলেও, গ্রামবাসীদের প্রশ্রয় পেয়ে সে তখন প্রায়ই গ্রামের ভিতরে যাতায়াত করতো। প্রথমদিকে, দিনে এক-আধবার, কিন্তু পরে প্রায় সারাটা দিনই সে গ্রামের মাঝখানে শিবতলাতেই কাটাতো।
এই প্রশ্রয় পাওয়ার কারণ, তার ঝাড়ফুঁকের জোর। তার ধুতির ভাঁজে সর্বদা গোঁজা থাকতো একটা চকচকে কষ্টিপাথর। পাথরটা নাকি মন্ত্রপূতঃ ছিল, কথাও বলতে পারতো- তবে শুধু ঐ কুঁজোর সঙ্গেই। তার জোরেই সকলের ভূত-ভবিষ্যৎ সব নাকি জানতো সে, আর ঐখানে বসেই বলে দিতো- গ্রামের কোন বাড়িতে, কার কি সমস্যা, কি রোগ, বা কার কোন রোগ বা সমস্যা কিভাবে সারবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
যা হয় আরকি, গ্রামের মানুষ তাই তাদের অফুরন্ত সমস্যা নিয়ে রোজ তার দ্বারস্থ হতো, আর সেও ঝাড়ফুঁক করে তাদের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতো। মোট কথা, এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই কুঁজো হয়ে উঠলো গ্রামের মসিহা। সমস্ত গ্রামবাসীই যেন হঠাৎ বশীভূত হয়ে হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছিলো তার!
ক্ষমতা বড় ভয়ংকর জিনিস, যাঁর আছে তিনি দায়িত্ববান ও সচেতন না হলে, তার অপব্যবহার হবেই। আজকের দুনিয়ায় মানুষের যত সমস্যা, তার নব্বই শতাংশই ক্ষমতাবানের দম্ভ এবং বেপরোয়া সিদ্ধান্তের ফল।
আমাদের কুঁজোও কোনো ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিল না। গ্রামবাসীরা তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার কথা মেনে চলছে দেখে, সেও নিজের ক্ষমতার দম্ভে দিশেহারা হলো। পরিস্থিতি একসময় এমন হয়ে উঠেছিলো যে, তার অতি মন্দ-আচরণকেও যেন মানতে বাধ্য হতো সবাই!
ওদিকে, দুলাল খুড়ো বহুদিন গ্রামের কারোর কোনও কাজে আসছিলেন না আর। কারণ, কারোর কোনও সমস্যার তিনি তুড়ি মেরে বা মন্ত্রবলে সমাধান করে দেবেন, এমন কথা তো দেন না কখনও। তাঁর কাছে গেলে, তিনি পরামর্শ দেন কিভাবে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারবে, যা করতে এখন আর ইচ্ছুক নয় কেউ। রেডিমেড সমাধান পাবার লোভে, সকলেই সেই কুঁজোরই শরণাপন্ন হয় এখন।
এদিকে কুঁজোর ক্রমবর্ধমান দাম্ভিক আচরণে একদিন গ্রামেরই কয়েকজন সম্মানীয় ব্যক্তির মানহানি ঘটলো। কুঁজো ততদিনে এত প্রভাবশালী হয়েছে যে, তাঁদেরকেও তুচ্ছজ্ঞান করছিলো। গ্রামেরও কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলো না দেখে, তাঁরা বুঝলেন যে কুঁজো এমন দুর্ব্যবহার এখন হামেশাই করবে।
গ্রামবাসীদেরও তখন এমন অবস্থা যে, কুঁজোর অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারোর। সুশীল মুখুজ্জে একদিন ঠাট্টা করেছিল তার পিঠের কুঁজটাকে নিয়ে। পরদিন থেকে পিঠের যন্ত্রনায় সে নাকি আর বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেনি! মাসখানেক যন্ত্রণাভোগের পর, অবশেষে কুঁজোর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হয় তাকে। তারপরেই তার পিঠের যন্ত্রণা নাকি আতরের মতই উবে গিয়েছিল!
কুঁজো তার ভক্তদের বলেছিল, বেতাল নামে তার একটা পোষা ভূত আছে যে তার পিঠে বসে থাকে। সেই বেতালের ভারেই সে কুঁজো হয়ে থাকে, আসলে সে কুঁজো নয়। সুশীল মুখুজ্জের ঠাট্টার জবাবে, সে বেতালকে পাঠিয়েছিল তার পিঠে ক'দিন থাকার জন্য!
এরপর, কেউ কোন সমস্যা নিয়ে এলে, সে আর সেই পাথরটা নিয়ে বুজরুকি করতো না। ঘাড়টা পিছনদিকে ঘুরিয়ে, তার পিঠে বসে থাকা বেতালকেই সরাসরি জিজ্ঞাসা করে নিতো সেই সমস্যার সমাধান! লোকমুখে বিষয়টা চাউর হতেই, কুঁজোকে রীতিমত ভয় পেতে শুরু করে সবাই।
যাই হোক, কুঁজোর থেকে অপমানিত হয়ে সেই সম্মানীয় ব্যক্তিরা গেলেন দুলাল খুড়োর কাছে। তিনি সব শুনে তাঁদের বললেন, তাকে একবার তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। সবাইকে টুপি পরিয়ে, বোকা বানিয়ে, বশ করে রাখার কুঁজোর সব বুজরুকির পর্দাফাঁস করে দেবেন তিনি।
কথাটা কুঁজোর কানে পৌঁছাতে মোটেই দেরি হয়নি। গ্রামের এক অশীতিপর বৃদ্ধ কিনা তার সব কাজকর্মকে বুজরুকি বলেছে! শুনে ক্রোধোন্মত্ত কুঁজো, নিজের সব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে, তখনই গিয়ে হাজির হল খুড়োর বাড়ি।
এই গ্রামে আসার আগে, কুঁজো আমাদের দুলাল খুড়ো সম্পর্কে ভালোমতই জেনে এসেছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম, ক্ষমতার দম্ভ বড় ভয়ঙ্কর। তাই সব ভুলে, সে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে হাজির হল এমন একজন ওস্তাদের সামনে, তার গুরুও একসময় যাঁর শিষ্য ছিল।
খুড়োর এই পরিচয়টা অবশ্য গ্রামের কেউ জানতো না। স্বেচ্ছায় ঐসব কাজকর্ম ছেড়ে, তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতোই গ্রামে বসবাস করছিলেন। নিজের অথবা অন্যের প্রয়োজনেও, তাঁর সেই ক্ষমতাকে তিনি প্রয়োগ করেননি কখনও। নির্বোধ কুঁজো কিনা সেই তাঁরই সামনে এসে হম্বিতম্বি করতে শুরু করলো।
বেশ কিছুক্ষণ তার কথাবার্তা শোনার পর খুড়ো বললেন- তা' হে বাপু, শুনেছি তোমার নাকি একখান পোষা ভূত আছে, কি যেন নাম, বেতাল না কি? তুমি গ্রামের লোকদের বলেছো, সে তোমার ঘাড়ে চেপে থাকে বলেই নাকি তুমি কুঁজো হয়ে গেছো, এসব সত্যি?
কুঁজো- সত্যি কিনা, সুশীল মুখুজ্জেকেই জিজ্ঞাসা করুন, তার ঘাড়ে তো চাপিয়ে রেখেছিলাম তাকে একমাস!
খুড়ো ঈষৎ হেসে তার মুখপানে চেয়ে বললেন- তেনাদের নামে এই যে বুজরুকি করছো, এর ফল কি হতে পারে তুমি জানো? গ্রামের সাদাসিধে লোকগুলোকে মিথ্যে বলে, ভূতের ভয় দেখিয়ে, কেন বশ করে রাখতে চাইছো? আমি হলফ করে বলতে পারি যে, তুমি নিজেই কখনও ভূত দেখোনি।
এই কথা শুনে, কুঁজো তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল একবারে। বললো- তাই? আমি ভূতই দেখিনি? বুড়ো, এত সাহস তোর, তুই আমাকে অপমান করিস? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা, এখনই যদি তোর সর্বনাশ না করেছি, তো আমার নামও...
তার মুখের কথা শেষও হয় না, দেখি দুলাল খুড়োর সদা-অর্ধনিমিলিত চোখ, বিস্ফারিত হয়ে রক্তাভ আকার নিয়েছে। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি কুঁজোর মুখ-পানে, তাঁর সম্মুখের শান্ত স্তব্ধ বায়ু যেন হঠাৎ করেই এক কালো ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ঈষৎ কম্পমান তাঁর ঠোঁটদুটো যেন অস্ফুটে কোনো মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে!
পদ্মাসনে বসা খুড়ো, ডানহাতের তর্জনী তুলে কুঁজোকে দেখিয়ে বললেন- যাও বেতাল, আজ থেকে এই বুজরুকের ঘাড়েই তুমি আশ্রয় নাও। তোমার ভারে ওর শ্বাসরোধ না হওয়া পর্যন্ত ওকে মুক্তি দেবে না! তাঁর কথা শেষ না হতেই, সেই ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে গেল কুঁজোর দিকে।
কুঁজোর বোধহয় তখন হুঁশ ফিরলো, নিজের ক্ষমতার দৌড় আর খুড়োর প্রকৃত পরিচয়ও স্মরণ হলো, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তবুও সাষ্টাঙ্গে খুড়োর পায়ে পড়ে সে ক্ষমা চাইতে লাগলো। ওদিকে সেই ঘূর্ণিঝড় ততক্ষণে দখল করেছে তার শরীর, আর সে চিৎকার করে নিজের প্রাণভিক্ষা চেয়ে আকুতি-মিনতি করছে।
খুড়োর হয়তো একটু মায়া হলো, তাই দয়া দেখিয়ে বললেন- যা বেটা, তোকে প্রাণে মারবো না এখনই। তোর পাপ তো কিছু কম নয়, লোকের একটু-আধটু ভালো করার অজুহাতে, তুই অনেকের অনেক ক্ষতিও করেছিস। তোর সেই পাপের শাস্তিটা ভোগ করা দরকার। বাকি জীবন তুই ঐ বেতালের ভার বয়েই বাঁচবি, তোর শেষ নিঃশ্বাস না পড়া অবধি রোজ সেই ভার বাড়তেই থাকবে। যা, ভাগ এখান থেকে, কখনও যেন এই গ্রামের ত্রিসীমানায় আর না দেখি তোকে।
তাঁর কথা শেষ হতেই সেই ঝড় থামলো, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো কুঁজো। তার পিঠের সেই কুঁজ যেন বেড়ে দশগুণ আকার ধারণ করেছে। কুঁজের ভারে আর যেন উঠে দাঁড়াতেই পারছে না সে। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়েই সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো সে। গ্রামের ত্রিসীমানায় আর কেউ কখনও দেখেনি তাকে।