Prakriti kundu

Classics Crime Thriller

4.0  

Prakriti kundu

Classics Crime Thriller

বোধন

বোধন

5 mins
410


" শোন আগেই বলে দিচ্ছি যদি ছেলে হয় তাহলে রাখবো আর মেয়ে হলে যদি দেখিস রুপবতী 

তাহলে তাহলে এখানেই বড়ো হবে নাহলে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবি। " হুংকার ছেড়ে কথাটা বললেন তাহমিনা বিবি। এই নিষিদ্ধ পল্লীর রক্ষা কর্তা বিধাতা সে। তার কথায় পল্লীর প্রতীটা মেয়েকে উঠতে বসতে হয়। তাহমিনা বিবি আসল নামটা কেউ জানে না অবশ্য এখানে প্রতিটা মেয়ের নামেই ছদ্ম। 


" রক্ষে করো বিবি বেগম আমার সন্তান যায় হোক না তাকে অত্যন্ত আমার কাছে থাকতে দিও। আমি তো আমার সারা জীবনটা তোমার নামে লিখে দিয়েছি এখন আমার ছেলে মেয়ে হলে তাকে দয়া করে এই রাস্তায় নামিও না। " 


কাতর কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো রুপসা। রুপসা এই পল্লীর সব থেকে সুন্দরী। বয়স পঁচিশ যুবতী মেয়েটি না জানি কোন অজানা পুরুষ এর সংস্পর্শে এসে তার বাচ্চা গর্ভে ধারন করেছে। তবে অন্য কোনো এস্কর্টের মতো করে বাচ্চাটিকে মেরে ফেলেনি বরং বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাহমিনা বিবি এতো বার ধরে হুমকি দিয়েছিল বাচ্চাটিকে নষ্ট করার কথা শোনেনি। বাচ্চাটা গর্ভে ধারন করলে তো ফিগার খারাপ হয়ে যাবে চর্বি জমে যাবে কোনো পুরুষ এর আকর্ষন পাবে না তারপর কতগুলো মাস কোনো টাকা পয়সা হাতে আসবে না। টাকা দিয়ে কোন পুরুষ কোনো গর্ভবতী এস্কর্টের সাথে শুতে! 


তবুও সবার নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে রুপসা বাচ্চাটিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন যেন মনে হয় বাচ্চাটিকে না রাখলেই ভালো হতো। তখন অনিকের আবেগের জন্য একটা শিশুকে নিজের অভিশপ্ত জীবন এর সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। জন্ম থেকে সেই শিশুটিকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। 


তাহমিনা বিবি এদিকে মুখ দিয়ে কিছু বিকৃত শব্দ বের করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মুখটা করলার থেকেও যেন বেশি তেতো। হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? রুপসার আটমাস চলছে। আজ কতগুলো মাস রুপসা কোনো টাকা ওনার হাতে দেয়নি। তারপর আবার ফিগার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়! রুপসা ওনার এই কুঠিবাড়ির সে সোনার ডিম পাড়া হাঁস রে! 


তাহমিনা বিবির কোনো রকমের মন্দ কথা বার্তা কানে গেল না রুপসার। সে নিঃশব্দে তাকিয়ে রয়েছে ঘরের জানলার বাইরে। চোখের জলটা ও যেন শুকিয়ে গিয়েছে। গরীব বাবার অবহেলিত রুপবতী মেয়ে রুপসা কিছু টা সুখের সন্ধানে প্রেমিকের সাথে এই কলকাতা শহরে পালিয়ে এলো। কথা ছিল বিয়ে করবে কিন্তু কোথায় কি? সেই প্রেমিক তাকে টাকা রোজগারের পথ ভেবে বিক্রি করে দিল এই কুঠিতে। তারপর! তারপর আর কি? চলছে তো জীবন। প্রথম প্রথম পালিয়ে যেতে চাইলেও এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বয়স তখন কতোই বা ছিল মাত্র পনেরো! আজ দশ বছর আশা হয়ে গেল এই কুঠিতে। 


জানলা দিয়ে বাইরের দিকে নিজের জীবনের কথাই ভাবছিল। এই কুঠি বাড়ির থেকে অনেকটা দুরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাদা কাশ ফুলের বাগান। মাঠঘাট এখানে কোথায় পাবে? ঘিঞ্জি ঘর। সূর্যের মুখটাও কোনো কোনো দিন দেখতে পায়না। নিজের রুপ জোলুস ধরে রাখতে তাহমিনা বিবি ওকে রোদের আলোয় বেরোতে দেয়না বেশি। কতো রকমের ক্রিম পাওডার মাখতে হয়। মাঝে মাঝে আয়নায় তাকিয়ে প্রশ্ন করে," ও কি এখানে ভালো আছে?" 

উত্তর আসে," নিশ্চয়ই আছে! বাবার বাড়িতে দুমুঠো ভাত জুটতো না। এখানে কতো ভালো ভালো খাবার কতো বড়ো বাড়িতে আছে। বাবার বাড়িতেও গতর খাটিয়ে খেতে হতো। এখানে না হয় গতর বেঁচে খাচ্ছে! প্রার্থক্য কোথায়? " 


নিজেই মনে মনে ভেবে নিজেই বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসতো। এখন সেই বিদ্রুপাত্মক হাসি টাও আসে না ঠোঁটের কোনে। এখন সারাদিন একটাই ভাবনা বাচ্চাটিকে কি ভাবে বাঁচাবে ও? ঠাকুর এর কাছে মনে প্রানে চাই যেন মেয়ে না হয়! মেয়ে হলেই তো একেইকাজ করতে হবে তাকে… আর ছেলে হলে? ছেলে হওয়াটাও কি বাঞ্চনীয়? ছেলে হলে তো তাকে মা এর মতো আর পাঁচটা মেয়ের সম্ভ্রমে হাতে দিতে শেখাবে। কি করবে? 


কদিন পরেই তো দূর্গাপূজা। দূর্গাপূজার জন্য তো কতো রকমের সাজ সজ্জা হচ্ছে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। বড়োই আজব ব্যাপার! যেই মাকে পূজো করা হচ্ছে সেই মাকেই অসম্মানিত করা হচ্ছে! আরো আজব ব্যাপার হলো এই নিষিদ্ধ পল্লীর মাটি ছাড়া নাকি পূজো হয়না?


আজ কাল শরীরটা আর সাথে দেয় না। বড়োই বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর ছোঁয়া পেতে চাই। শরীর ও যেন সাথ দিতে চাই না। আচ্ছা বাচ্চার সাথে সাথে যদি ও মারা যায়? কতোই তো শুনেছে মা বাচ্চা একসাথে মারা গেছে ও যদি মারা যায় তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে?


আচ্ছা ঠাকুরবাড়ির একজন বউ প্রতিবছর এখানে পূজোর জন্যই নাকি ষষ্ঠীর দিন মাটি নিতে আসে তার নাকি সন্তান নেই? বউ টা তো খুব ভালো কখনো ওদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেনি। ওর মনে আছে আগের বছর বউটার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল কতো সুন্দর ব্যাবহার বউটার! তাও বউটার কোনো সন্তান নেই কেন? অথচ ওর মতো পাপীর কোলে সন্তান!


মন্ডপে দূর্গা ঠাকুর কে সাজানো হয়েছে গহনা দিয়ে। মা বড়োই অদ্ভুত। হাসছে কিনা কাঁদছে বোঝার উপায় নেই! বুঝবেই বা কিভাবে? এক জায়গায় মায়ের এক সন্তান কাঁদছে অপর দিকে হাসছে। এই কান্নাহাসির দোলাচলে মায়ের কি করনীয়?


আজ ষষ্ঠী। ভোরবেলা। কিছুক্ষণ পরেই বোধন শুরু হবে। কুঠির বেশিরভাগ মেয়েই মন্ডপে শুধু দুজন বাদ দিয়ে। এক রুপসা আরেক তার সখী তনুজা। তাদের যেতে মানা। তাহমিনা বিবি রুপসাকে এখানেই রেখে দিয়ে গেছে। মন্ডপে যেতে মানা করে দিয়েছে একদম। রুপসা যায়নি বলে তার প্রানের সখীও যেতে পারেনি। তবে ওরা সুযোগ পেয়েছে পালিয়ে যাওয়ার। তনুজাই বুদ্ধি দিয়েছে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রুপসা পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে জানা নেই তবে এমন কোথাও যাবে যেখানে গিয়ে নিজের সন্তানকে একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে পারবে। 


বোধনের আগে নিশি ভোরে তনুজা সুযোগ বুঝে রুপাকে কুঠি থেকে বের করে দিল। রুপসা নিজেকে লুকিয়ে হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। শরীর আজকে যেন সাথ দিচ্ছে না। পেটে ব্যাথা উঠেছে। তাও যেন নিজের অসাড় শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। 


কিন্তু কিছু টা রাস্তা যেতেই একটা যেন চোখে সব কিছু আবছা দেখতে লাগলো। পেটে ব্যাথায় কাতর হতে থাকলো। হটায় করেই একটা গাড়ি এসে সামনে এসে দাড়ালো। রুপসার হাত থেকে পুঁটলিটা পড়ে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। শুধু জ্ঞান হারানোর আগে দেখলো গাড়ি থেকে একজন দামী শাড়ি পরিহিতা নারী নেমে এলো। সেই নারীটিই ঠাকুর বাড়ির সেই নিঃসন্তান বউ। 



বোধনের ঠিক পরেই কুঠি বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। তাহমিনা বিবির নজর কাটিয়ে পল্লীর সব থেকে সুন্দরী মেয়ে রুপসা পালিয়ে গেছে। তাহমিনা বিবি খবরটা শুনে আগ্নেয়গিরির ন্যায় গর্জে উঠলেন। নিজের সমস্ত পাওয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন রুপসাকে খুঁজে বের করার জন্য কিন্তু ওনার ধারনা তেওঁ নেই রুপসা আর এই পৃথিবীর মধ্যেই নেই। রুপসাকে খুঁজে বের করতে হলে ওনাকেও মৃত্যুর ওপারের জগতে যেতে হবে‌। কিন্তু ওনার মতো পাপীর কাছে যে এতো সহজে মৃত্যু আসবে না……


তাহমিনা বিবির এই পূজোর বিসর্জনের সময়ে পৃথিবীর অপর এক প্রান্তে বোধন নামে এক কন্যা সন্তান মায়ের কোলে বসে বসে কাঁদছে হাসছে ঘুমিয়ে আছে। তাই দেখে এক মায়ের প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে। মা দূর্গা যেন নিজের বোধনের সময়েই এক অশুভ এর বিসর্জন করে শুভশক্তির বোধন করেছেন।


সমাপ্ত…..






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics