Drishan Banerjee

Inspirational

3  

Drishan Banerjee

Inspirational

বন্ধুর উপহার

বন্ধুর উপহার

6 mins
8.5K


আমাদের একমাত্র মেয়ে তানিয়া একটা নাম করা স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। ওদের স্কুলে কিছু সামাজিক কাজ হয়, সেই জন্য শিশু-দিবস উপলক্ষে সব বাচ্চাদের কাছেই একটা অনাথ আশ্রমে নিয়ে যাবে পরদিন। প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট অর্থের ভেতর চকলেট, বিস্কুট, পেনসিল এসব নিয়ে যেতে বলেছে। এছাড়া পুরানো ভালো জামা, শীতের পোশাক, ছবির বই, এসব নিতে বলেছে বাড়ি থেকে। 

মহুয়া, আমার স্ত্রী বক্স খাট খুলে কিছু পুরানো জিনিস বের করে দিয়েছে। আমি চকলেট, চিপস, বিস্কুট এনে দিয়েছি কিছু। বেছে রাখা জামা থেকে মেয়ে দুটো জামা কিছুতেই দিতে দেবে না। এই নিয়ে মা মেয়ের তুমুল চলছে।

মেয়ে দুটো জামা হাতে আমার পিছনে এসে শেল্টার নিয়ে বলতে লেগেছে -"আরও কত জামা আছে সেখান থেকে দাও। এ দুটো থাক। "

ওর হাতে ফ্রিল করা একটা গোলাপি জামা আর একটা জিনসে্র স্কার্ট টপ। গত বছর পূজায় সিটি সেন্টার থেকে কিনে দিয়েছিলাম। হঠাৎ করে মেয়েটা লম্বা হয়ে গেছিল বলে ওর আর হয় না। মাত্র দুচার বার পরেছে, নতুন বলতে গেলে। 

ভাবলাম ছোট হয়ে গেলেও নতুন বলে ওর মন হয়তো দিতে চাইছে না। মহুয়াকে বললাম -"ছেড়ে দাও, অন্য জামা দিয়ে দাও না। "

-"আরও আদর দিয়ে মাথা খাও। একে তো এই সব বাচ্চা ছোট থেকে একা থেকে থেকে কিছু শেয়ার করতে শেখে না!! ওগুলো ওর হবে না কোনোদিন, তাও দিচ্ছে না। " মহুয়া রাগে গজগজ করতে থাকে।

মেয়ে ততক্ষণে জামা নিয়ে চলে গেছে নিজের ঘরে।

বললাম -"বাদ দাও। ও শখ করে কিনেছিল ...."

-"না, তুমি জানো না, ও কাউকে কিছু দেয় না। কাল ভাইয়ের ছেলে আর বৌ এসেছিল। ওর ফ্রিজে রাখা চকলেট থেকে একটা দিয়েছি তাতে মেয়ের কি রাগ। সেদিন দিদির বাড়ি গেলাম। দিয়ার সাথে শেয়ার করে চিপস খেতে বললাম, দুজনের আলাদা প্যাকেট চাই!! মিশতেই শিখল না নিজের ভাই বোনেদের সাথে!!"

 

এগুলো অবশ্য আমিও দেখেছি। তবে দোষ একা আমার মেয়ের নয়। ঐ বাচ্চা গুলোও কিছু ভাগ করে খেতে শেখেনি। এদের শৈশব এদের ভাগ করতে শেখায়নি কিছু। যৌথ পরিবারে থেকে আমরা ছোটবেলায় যে সব সহবত নিজের থেকেই শিখেছিলাম সে সব এরা শেখেনি।

গত বছর ওদের সাথে একসাথে কাশ্মীর গেছিলাম। যে যার বাচ্চাকে খাবার কিনে খাওয়াচ্ছিল। মাঝে মধ্যে যদিও সবার জন্যই চিপস, চকলেট কেনা হচ্ছিল কিন্তু ভাগ কেউ কাউকে দিচ্ছিল না। কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনলেও সবার আলাদা বোতল!! আমার খুব খারাপ লেগেছিল ওটা।

রাতে শুয়ে শুয়েও মহুয়া এসব অভিযোগ করছিল।বললাম -"বড় হলে ঠিক শিখবে। আমরা শেখাবো। "

পরদিন বাড়ি ফিরে দেখি আরেক অশান্তি। দিয়ার কাছে একটা ছোট দশ টাকার ডেয়ারি মিল্ক। ওর মা যত বলছে কে দিয়েছে? কোথায় পেলো? ওর একটাই উত্তর" ফ্রেন্ড দিয়েছে।" আমি বললাম -"হয়তো কারো জন্মদিন ছিল, ও তো এমন পায় স্কুলে। "

-"ওদের স্কুলে কারো জন্মদিনে ঐ একটাকার দুটো এক্লেয়ার্স ছাড়া কিছু এলাউ না তুমি জানো না? পেরেন্টস মিটিং এ বলেই দেয় সবাইকে ওটাই পাঠাতে। " মহুয়া অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে।

-"আহা, কার পুলেও তো কত বাচ্চা আছে। তেমন কেউ দিয়েছে হয়তো।" আমি সমাধান খুঁজি। ওদিকে মেয়ে গুটিগুটি নিজের ঘরে চলে গেছে।

-"তার তো একটা নাম থাকবে? নামটাই বলছে না। ঐ অনাথ বাচ্চাদের জন্য সবাই চকলেট নিয়ে গেছিল । তার থেকেই যদি না বলে নিয়ে থাকে!" মহুয়া বেশ রেগেই বলে।

আমি একটু পরে মেয়ের ঘরে গিয়ে সারাদিন কি কি করল জানতে চাই। ও খুব উৎসাহ নিয়েই সব বলে। ওরা আজ বেশ আনন্দ করেছে বুঝতে পারি। একথা সেকথার পর বলি -"আর চকলেটটা কে দিয়েছে তোকে ?"

-"ওটা তো টিয়া দিল। " বলেই মেয়ে চুপ। ওর বন্ধুদের মধ্যে যে দু চার জনকে চিনি টিয়া বলে কেউ নেই। অবশ্য ওদের বন্ধু প্রতি মাসে বদলায়। তাছাড়া একটা দশ টাকার চকলেটের জন্য আর কি করবো।

রাতে মহুয়াকে বললাম -"ওর বন্ধু টিয়া চকলেট দিয়েছে ওকে। "

মহুয়া ভুরু কুঁচকে বলল -"এই নামে তো কাউকে চিনি না। ছয় বছর ধরে এই নাম শুনি নি। "

-"নিউ এ্যডমিশন হবে হয়তো। তুমি তো রোজ যাও না। " বলে পাশ ফিরলাম।

সেদিন হঠাৎ মহুয়া বলল -"তানিয়া বেশ গুড গার্ল হয়েছে। রোজ টিফিন পুরো খাচ্ছে। আগে রুটি দিলেই ফেরত আসত। এখন সেটাও খাচ্ছে। "

আমি বললাম -"বড় হচ্ছে তো। সব শিখবে এভাবেই। " মনে মনে ভাবি আমরা তো রুটি খেয়েই বড় হয়েছি। এত রকমারি খাবার ছিল কোথায় ? এখন আছে তাই খাচ্ছে।

পরদিন তানিয়ার স্কুলে পেরেন্টস মিটিং। বৌ বাচ্চা নিয়ে সকাল নটায় হাজির হলাম স্কুলে। মহুয়া নিজের বান্ধবীদের সাথে যোগ দিল। ওখানে এখন আলোচনা হবে কার মেয়ে কি বেশি জানে, কার মেয়ে কত নম্বর পাচ্ছে, কার হাতের লেখা কেমন, কার টিচার কেমন পড়ায়। বাবারা সব বিরস মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ মোবাইল দেখছে। আমি একটা নিউজ পেপার দেখছিলাম। বাচ্চারা সব ছুটোছুটি করছে মাঠে।

হঠাৎ মহুয়ার উত্তেজিত কথা কানে এলো। ও মেয়েকে ডাকছে। বেশ বিপদের গন্ধ!! 

মেয়ে আসতেই ওর প্রথম প্রশ্ন -"টিয়াটা কে ?"

এমন সময় আমাদের ডাক এলো। মেয়েটা বোধহয় এ যাত্রায় বেঁচে গেলো। 

তানিয়ার ক্লাস টিচার মিসেস রয়্ মেয়েকে ভালোই বাসে। উনি মেয়ের বেশ প্রশংসাই করলেন। রিপোর্ট কার্ডেও দেখা গেলো মেয়ে থার্ড হয়েছে। 

মহুয়া হঠাৎ মিসকে জিজ্ঞেস করল -"টিয়া নামে কোন বাচ্চা আছে ক্লাসে ?"

মিসেস রয়্ একটু অবাক হয়ে বললেন -"ক্লাসে নয় তবে ... আপনারা একবার প্রিন্সিপালের রুমে চলুন। উনিই ডেকেছিলেন, সব উনিই বলতে পারবেন।"

আমি আর মহুয়া মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি! কি এমন করলো তানিয়া? এই তো ভালো ভালো কথা শুনলাম। আবার প্রিন্সিপালের ঘরে কেন ? রাগ হচ্ছিল মহুয়ার উপর। ছোট ছোট ব্যাপারে ও কেন এত বেশি ভাবে কে জানে!!

মিসেস ডরোথী গোমস বেশ রাশভারী মহিলা, ছয় বছরে মাত্র চারবার ওনার রুমে এসেছি। উনি অবশ্য আমাদের হেসেই আপ্যায়ন করলেন। তানিয়া বেশ খুশি। বেচারা হয়তো বুঝতেই পারছে না ওর উপর কোন বড় ঝড় আসতে চলেছে। বেশ হাসি মুখেই মিস কে 'গুড মর্নিং' বলল। 

-"ইউ গো এন্ড প্লে উইথ ইওর ফ্রেন্ড ডিয়ার। " একটু হেসেই মিসেস গোমস মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। মিসেস রয়্ ও আমাদের বাঘের গুহায় ছেড়ে চলে গেলেন।

আমরা ভাবছি এবার কি হবে !!

-"আপনাদের আমি কেন ডেকেছি ভাবছেন তো? তানিয়া খুব ভাল মেয়ে। ও একটা সিঙ্গেল চাইল্ড হয়েও গরীবদের প্রতি ওর দয়া মায়া দেখলে অবাক হতে হয়। আপনারা ওকে এত সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন বলে আপনাদের ধন্যবাদ। ও আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছে। ও কি করেছে আপনারা জানেন ?" উনি এই প্রথম বাংলায় আমাদের সাথে কথা বললেন। অবাক হয়ে আমরা তাকিয়ে রয়েছি। 

-"আমাদের স্কুলের পেছনে বাচ্চাদের খেলার জায়গার পাশেই আয়াদের থাকার জায়গা। রাধা মাসি বলে যে আয়া আছে, আজ কয়েকমাস হল ওর বোন মারা গেছে বলে বোনের অনাথ মেয়েটাকে ও এনে এখানে রেখেছে। বাচ্চাটার পাঁচ বছর বয়স হবে। সবাইকে খেলতে দেখে বাচ্চাটাও একটু দোলনা দুলতে বা খেলতে আসত। কোনো বাচ্চারা ওর সাথে খেলতে চাইতো না। ওকে তাড়িয়ে দিত, মজা উড়াতো। তানিয়া ওর পক্ষ নিয়ে বাকিদের সাথে ঝগড়া করেছে। ও একাই অফ্ টাইমে বাচ্চাটার সাথে খেলে তারপর থেকে। ওর সাথে ভাগ করে টিফিন খায়। এমনকি নিজের পুরানো জামা, বই এনে দিয়েছে ওকে। শুধু তাই না, অন্য অনেক গার্ডিয়ান যখন ঐ মেয়েটাকে স্কুলের ভেতর রাখা নিয়ে কমপ্লেন করেছে তখন ও একাই নিজের বন্ধুদের বুঝিয়েছে যে, ওর সাথে এমন করতে না। আমায় এসে রিকোয়েস্ট করেছে মেয়েটাকে এই স্কুলেই ভর্তি নেওয়ার জন্য। ওর মনে হয়েছে টিয়া যদি এখানে ভর্তি হতে পারে ওকে আর কেউ তাড়াবে না। নিজে অফ্ টাইমে, ছুটির পর ওকে পড়াচ্ছে। ওর উৎসাহ দেখে আমি ম‍্যানেজম‍েন্টকে বলেছি টিয়ার ব্যাপারে, এন্ড শি ইজ লাকি। ম‍্যানেজম‍েন্ট বাচ্চাটাকে নিউ সেশনে ভর্তি নিয়ে নিতে বলেছে। আজ তানিয়ার জন্য বাচ্চাটা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার পেতে চলেছে। ..

উনি আরও অনেক কিছুই বলে চলেছেন। আমার কানে আর কিছুই ঢুকছিল না। আমার ছোট্ট মেয়েটা কবে এমন করে ভাবতে শিখলো জানি না। 

ওনার সাথে বাইরে এসে পিছনের দিকে গিয়ে দেখি স্টাফ্ কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে তানিয়া একটা বাচ্চাকে কিছু লেখা শেখাচ্ছে। বাচ্চাটার পরনে তানিয়ার সেই জিনসে্র জামাটা। গভীর মনোযোগ দিয়ে ওর ছাত্রীটি লিখছে ওর কথা শুনে। 

রাধা মাসী আমাদের দেখে দৌড়ে এসে অনেক ভাল ভাল কথা বলে গেল।টিয়াও সেদিন শিশু দিবসে কিছু উপহার পেয়েছিল। তার থেকেই ও একটা ডেয়ারি মিল্ক দিয়েছিল তানিয়াকে, তানিয়া যে রোজ নিজের টিফিনটা ওর সাথে ভাগ করে খায়। ওটা ওর বন্ধুর দেওয়া উপহার।মেয়ে সত্যি কথাই বলেছিল সেদিন আমাদের।

 আমরা অবাক হয়ে দেখছিলাম সব বাচ্চারা যখন খেলছে, আনন্দ করছে আমাদের মেয়ে আনন্দ এনে দিচ্ছে আরেকটি মেয়ের জীবনে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি আছে। এই শৈশবেই যে কাজ ও করছে তা আমরাও করিনি কখনো।আরেকটা শিশুর শৈশবকে সাজিয়ে দিচ্ছে আমার মেয়ে। পথে ঘাটে কত অনাথ গরীব বাচ্চা আমরা দেখি, এমন করে তো ভাবিনি কখনো! আমার চোখে জল এসে গেছিল। মহুয়ার মুখে কথা নেই। মেয়েটা শৈশবেই আমাদের চোখ খুলে দিল।

সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational