Drishan Banerjee

Inspirational

3  

Drishan Banerjee

Inspirational

বন্ধু (শেষ পর্ব)

বন্ধু (শেষ পর্ব)

7 mins
15.1K


এই মিঃ-দত্তর সুপারিশেই এরপর আরও তিনটি ক্লায়েন্ট পেয়েছিল ওরা। সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত নাম করা লোক। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি ওদের। তবে মাঝেমধ্যে কিছু উটকো ঝামেলাও হয়।

এই পেশায় আসার পর প্রচুর ডক্টর, বৃদ্ধাশ্রম ,স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে পরিচয় হয়েছিল ওদের। কাজল ওদের ছেড়ে বিয়ে করে চলে গেছিল বর্ধমানে। তিথির বৌদি পর্না জয়েন করেছিল। আস্তে আস্তে পর্নার তিনজন বান্ধবী ও এসেছিল। সংস্থার আয়তন বেড়েছে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে।

এই পেশায় এসে তিথিরা জানতে পেরেছে কত কত বৃদ্ধ বৃদ্ধা এভাবে একাকীত্বে ভুগছে চারপাশে। টাকা দিয়ে এই পরিষেবা কেনার ক্ষমতা আর কয়জনের আছে? এমন প্রচুর লোক আছে যাদের ডাক্তার দেখানোর ও টাকা নেই। তবে ইদানীং এদের কথা মাথায় রেখে তিথিরা মাসে এক দু বার ফ্রি সার্ভিস ও দিয়ে থাকে এই সব পরিবারকে। তবে উচ্চবিত্তরাই মূলত ওদের ক্লায়েন্ট। কারন অর্থের পিছনে ছুটতে গিয়ে এদের প্রিয়জনেরাই দুরে চলে যায় বেশি। কোথাও আবার মনের মিল হয়না বলে এক শহরেই আলাদা থাকে ছেলে,বৌ,নাতি নাতনি।

দমদমের এক প্রয়াত প্রফেসারের স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার প্রস্তাব এনেছিলেন ওনার পারিবারিক ডক্টর। আসলে তিথিদের তখন ভালই নাম হয়েছিল। সপ্তাহে দু দিন তিন ঘন্টার জন্য মিলি যাচ্ছিল ওনার বাড়ি। ওনার ছেলে বৌ নিয়ে বালিগঞ্জে থাকে, গত দুবছরে মাত্র দুবার এসেছিল ছেলে। স্বামীর টাকায় ওনার চলে যায় ভালমতো। মিলির কাজ ছিল ওনাকে মাসে দুবার চেক আপে নিয়ে যাওয়া, আর সঙ্গ দেওয়া। এছাড়া ওনার কাজের লোক,রান্নার লোক ছিল। একমাসেই কি করে খবর পেয়ে ওনার ছেলে এসে উপস্থিত হয়েছিল। মিলিকে নানা রকম ভাবে অপমান করেছিল ওর কাজের জন্য। মিলির সামনেই নিজের মা কে বকাবকি করেছিল এভাবে পয়সা নষ্ট করার জন্য। একথাও বলেছিল যে নিজের ছেলে বৌয়ের সাথে থাকতে ভাল লাগে না,ভাড়া করে লোক এনে আদিখ্যেতা হচ্ছে।

মিলি বেড়িয়ে এসে ঋজু আর তিথিকে ফোনে জানিয়েছিল। তিথি ডক্টর বোসকে সব জানাতেই উনি বলেছিলেন ছেলেটা নাকি অমানুষ। বাড়ি বিক্রি করে মাকে নিয়ে যেতে চায়। তারপর হয় বৃদ্ধাশ্রম নয়তো অবহেলায় পড়ে থাকবে এক কোনে। চিকিৎসাও করাতে চায় না । তিথিরা যেন ওনার কাজটা না ছাড়ে। একটু পরেই ঋজু আর তিথি মিলিকে নিয়ে আবার গেছিল। গিয়ে দেখে ছেলে জোর করে সম্পত্তির পেপারে সই করাতে ব্যস্ত। কাজের লোককেও ছাড়িয়ে দিয়েছে। মাকে সে নিয়ে যাবেই। জীবনে প্রথমবার থানা পুলিশ করেছিল ওরা সেদিন। ভদ্রমহিলা বেঁচে গিয়েছিলেন ওদের জন্য।

ঘোষাল বাবুর ভীষণ দাবার নেশা। বাবুয়া ভাল খেলত একসময়, ঐ জন্য ওনার বাড়ি বাবুয়ার অবারিত দ্বার। উনি দাবা সাজিয়ে পথ চেয়ে বসে থাকেন সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলো। ওনার স্ত্রী দুটো কথা বলার লোক পেলেই খুশি।

  

কয়েকটা ফোন এসেছিল মাসিমা আর মেসোমশাইয়ের ফোনে। যে সব আত্মীয় খবর পেয়েছিল তাদের। সাড়ে আটটায় কাজের লোক এলো। তিথি চা আর টোস্ট বানিয়ে মাসিমাকে ডেকে তুলল নটা নাগাদ। আস্তে আস্তে ওনার সব মনে পড়ছিল। বললেন -" কেমন আছে ও ? আমায় একবার নিয়ে যাবে?"

-"আপনি এটা খেয়ে রেডি হয়ে নিন।আমি নিয়ে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে। " তিথি ভরসা দেয়।

হাসপাতালে এসে জানা গেল দুটো ব্লকেজ্ পাওয়া গেছে। স্টেন্টে কাজ হবে না, বাইপাস করাতেই হবে।

 

ওনার ছেলেদের জানালে তারা বলল এত তাড়াতাড়ি তাদের পক্ষে ছুটি নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। একটু সময় চাই। ডক্টর যেটা ভাল মনে করবে করতে। মেয়ের ও এক মত। রমা দেবী চিরকাল স্বামীর উপর ডিপেন্ডেন্ট। ওনার কিছুই বলার নেই।

প্রায় দেড়দিন তিথি আর ঋজু হাসপাতালে। জোড়াতালি দিয়ে বাকিরা অন্যদের সামলাচ্ছে। আসলে সবাই অসহায় ,ওদের মুখ চেয়ে দিন কাটে এইসব বয়স্কদের। যদিও টাকার বিনিময়ে সেবা, তবুও এক আত্মীয়তা হয়ে গেছে সবার সাথে। এদিকে তিথিরা এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি। এত বড় একটা অপারেশনের দায়িত্ব ওরা কি করে নেবে কিছুতেই বুঝতে পারে না। বাকি আত্মীয়রা একবার করে খোঁজ নিয়েই চুপচাপ হয়ে গেছে। আটাত্তর বছরের বৃদ্ধর অপারেশনের মধ্যে কেউ থাকতে চায়নি, বিশেষ করে যেখানে ছেলে মেয়ে নেই কাছে।

তিথির দাদা বৌদি সব শুনে সাহস দিয়েছিল শুধু। অবশেষে ছেলেদের কথার উপর ভরসা করে অপারেশন হবে ঠিক হল। ৬ ইউনিট ব্লাড লাগবে। সে ব্যবস্থাও হল। রমা দেবীর কাছে সবসময় কেউ না কেউ থাকছে। অপারেশনের পরদিন ছোট ছেলে এসে পৌঁছলো। তখনো মলয়বাবু সি-সি-ইউতে। আরও ২৪ঘন্টা পার হলে ডক্টর কথা বলবেন বলেছেন।এই দুটো দিন তিথি আর ঋজুর মনে হচ্ছিল ওদের নিকটতম কেউ ভর্তি আছে।

অবশেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে মলয়বাবু দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। ছেলে চারদিন থেকে ফিরে গেছিল, ছুটি নেই। বড় ছেলতিথির বৌদি পর্ণা এখন পুরো জড়িয়ে গেছে "বন্ধু"র সাথে। মাঝে মাঝে মেয়ে তিতিরকেও নিয়ে যায় রায় বাড়ি। ওদের একমাত্র ছেলে তনয় পাঁচ বছর দেশ ছাড়া, নাতনি কৌশালীকে ঐ দুবছরের সময় একবার দেখেছিলেন রায় মাসিমা আর মেসোমশাই। ছোট্ট তিতিরকে দেখে ওরা সেই দুঃখ ভুলে থাকতে চায়। তিতির ও নেচে গেয়ে গলা জড়িয়ে ওদের আদর খেতে খুব ভালবাসে। এর সাথে কোন অর্থর সম্পর্ক নেই।

শোভাবাজারের শ্রী গগন মিত্র ও মালতী দেবীর দাম্পত্য জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছোট্ট একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তিথিরা। ইচ্ছাটা মাসীমারই ছিল। বহু বছর কোনো অনুষ্ঠান হয় না ঐ বাড়িতে। ছেলে মেয়ে বিদেশে। অবশেষে ওরাই সব ব্যবস্থা করেছিল। দুদিনের জন্য ছেলে অতীনবাবু ও উড়ে এসেছিলেন একাই। ওদের অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন অতীন বাবু। বলেছিলেন -" তোমাদের ভরসাতেই নিশ্চিন্তে পড়ে আছি ওদেশে। তোমরাই দেখবে জানি।"

যেদিন মিসেস দত্ত রাতে ঘুমের মধ্যে সব মায়া কাটিয়ে চলে গেছিলেন,মিঃ দত্ত প্রথম ফোনটা ওদেরই করেছিলেন। ওরাই দাঁড়িয়ে থেকে যাবতীয় কাজ করেছিল। মিঃ-দত্ত কেমন পাথর হয়ে গেছিলেন যেন। কিছুতেই ছেলেদের খবরটা দিতে দেন নি। মাসিমা ভীষণ ছেলেদের দেখতে চাইতেন শেষের দিন গুলো। কিন্তু ব্যস্ত ছেলেদের সময় হয়নি মায়ের কাছে আসার। তিথিরাই পুরোটা সামলেছিল। এরপর মিঃ-দত্ত না ডাকলেও ওরা মাঝে মাঝে যেত ওনার বাড়ি। উনি অনেক বার বারণ করেছিলেন, ওদের সময়ের দাম উনি জানতেন। বই পড়েই ওনার সময় কাটত। তবুও ঋজু আর তিথি সময় পেলেই যেত ওনার বাড়ি। সম্পর্ক টা অন্যরকম হয়ে গেছিল ওনার সাথে।

আবার উত্তর কলকাতার মিঃ বোসের মত ক্লায়েন্ট ও পেয়েছিল তিথিরা। একা বিপত্নীক মিঃ বোস এই শেষ বয়সেও নারী সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ায়। সাধারণত পুরুষদের কাছে বাবুয়া বা ঋজুকেই পাঠানো হয়। ওনার অনুরোধে একবার তিথি গিয়ে সেই নোংরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। খালি বাড়িতে তিথিকে একা পেয়ে ওনার পৌরুষ জেগে উঠেছিল এ বয়সে। তিথি একটা ফুলদানী দিয়ে ওনার মাথায় মারতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন।

পুলিশ দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেছিল তিথি, ঋজু ওদের বাড়িতেই ছিল সে সময়। দুজনকেই থানায় তুলে নিয়ে গেছিল পুলিশ। ওদের ক্লায়েন্ট মিসেস আলপনা চৌধুরীকে কেউ শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।ওনার বাড়ী চুরি হয়েছিল আগের রাতে। রাত আটটায় তিথি বেরিয়ে এসেছিল ওনার বাড়ি থেকে। সে দিন ব্যাঙ্ক থেকে তিথির সাথে গিয়ে উনি তিন লাখ টাকা তুলছিলেন বাড়ি মেরামতের জন্য। ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে দেবেন বলে গয়নাও বের করে এনেছিলেন বেশ কিছু। পরদিন তিথির ওনাকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।ঐ রাতে কাজের লোক ছাড়া কেউ ছিল না বাড়িতে।

এক্ষেত্রে পুলিশ যা করে, কাজের লোকটির সাথে তিথি আর ঋজুকেও তুলে এনেছিল থানায়। কাজের লোকটি নিচের তলায় শুয়েছিল, কিছুই জানে না বলছে।

কি করবে বুঝতে পারছিল না তিথি। ততক্ষণে টিভিতে ওদের নিয়ে খবর তৈরি হতে শুরু হয়ে গেছে। ওদের সংস্থাকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, কিছু ক্লায়েন্টের বাইট্ নিয়ে সব চ্যানেলের প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ ওদের কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ওরা যে রাতে গিয়ে এ কাজ করে নি,তা প্রমান করার দায়িত্ব ওদের। দাদা বৌদি, ঋজুর বাবা মা বাকি বন্ধুরা ভেবেই পাচ্ছিল না কি করবে। একজন উকিল দরকার নয়তো জামিন হবে না।

এমন সময় ত্রাতার মত এসেছিলেন মিঃ-দত্ত। ওনাকে কোনো চ‍্যানেল ঘটনাটা জানিয়ে ওনার মতামত জানতে চেয়েছিল। উনি তক্ষুনি টিভিতে সব দেখে ওদের ফোন করেছিলেন। পর্না ফোনেই সব বলেছিল ওনাকে। দীর্ঘ দশ বছর পর উনি আবার কালো কোটটা গায়ে দিয়ে থানায় এসেছিলেন শুধু ওদের জন্য। একসময়ের নাম করা ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের বেশি সময় লাগে নি ওদের ছাড়িয়ে আনতে। উনি প্রমান করে দিয়েছিলেন যে বাড়ি রিপেয়ারিং এর জন্য যে মিস্ত্রিরা কাজ করছিল,এটা তাদের কাজ। তারাও জানত সেদিন টাকা ও গয়না তোলা হয়েছিল।

কিন্তু কোর্ট ওদের নির্দোষ মানলেও এতবছরের "বন্ধু"র যে সুনাম তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকের বিদেশে থাকা ছেলে মেয়েরা আর ভরসা রাখতে পারে নি ওদের উপর। মন ভেঙ্গে গেছিল তিথিদের। চ‍্যাটার্জী মাসিমার ছেলে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার পর তিথি নিজেও বহুবার ওনার ওষুধ কিনে দিয়েছিল। টাকা দিতে পারছিলেন না বলে উনি ওদের আসতেও বারণ করেছিলেন, তবু তিথি সময় পেলে গিয়ে দেখা করে আসত। অথচ এই ঘটনার পর উনিও ওদের উপর ভরসা রাখেন নি। তিথি ফোন করায় অদ্ভুত আচরণ করেছিলেন।

কদিন গৃহবন্দী হয়েই ছিল তিথি। হঠাৎ করে রায় বাড়ি থেকেই এসেছিল প্রথম ফোনটা। তিতির আর পর্নাকে ওরা খুব মিস করছে।

মিঃ-দত্ত তিথিদের বুঝিয়েছিল সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সর্বদা সাহস জুগিয়ে গেছিলেন উনি। বাবুয়া আর মিলি অন্য চাকরী নিয়ে চলে গেছিল। ঋজু আর তিথি বিশ্বাস হারায়নি। ছমাসের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ওদের সংস্থা। আসলে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যাটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়ার ও লোকের অভাব।

এখন মাসে দুদিন ওরা এক বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সব বয়স্কদের সাথে সময় কাটায়। কোনো ভাল আলোচনা বা বই পড়া হয়, কখনো সিনেমা দেখানো হয়।

আবার ফোনটা বেজে ওঠে, আলিপুর থেকে লাবনী-দেবীর ফোন। ওনাকে একবার কালীঘাটে পূজা দেওয়াতে নিয়ে যেতে হবে পরের দিন, ওনার ছেলের জন্মদিন। যে ছেলে গত সাত বছরে দেশে আসে নি। স্কাইপ্ আর ফোনেই দেখা হয় মা আর ছেলের। মাঝে থাকে তিথিরা।

সুগারের পেশেন্ট দিবানাথ বাবুর জন্য সুগার ফ্রি মিষ্টি নিয়ে যায় ঋজু, স্মার্ট ফোনটার ব্যবহার শিখতে ওনার ভীষণ আগ্ৰহ। নতিটার সাথে ওটার মাধ্যমেই যোগাযোগ আছে।

 

পর্নাবৌদির হাত ধরে অলক বাবুর লেখা গুলো এখন তিনটে গ্ৰুপে পোষ্ট হচ্ছে। সারাজীবন ইচ্ছা ছিল ছাপা হবে নিজের লেখা। আজ পর্নাই ওনাকে এই জগতের সাথে পরিচয় করিয়েছে। প্রতিদিন পাঠক সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বেঁচে থাকার মজাটা উনি নতুন ভাবে উপভোগ করছেন আজকাল ।

আবার ফোনটা বাজছে..... তুলতেই একটা নতুন গলা .... -"হ্যালো.... "বন্ধু"?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational