Pronab Das

Inspirational

5.0  

Pronab Das

Inspirational

বিশ্বাসঘাতক ।

বিশ্বাসঘাতক ।

4 mins
1.2K




সময়টা ৪২ এর।  দেশাত্ববোধের চেতনায় আমরা তখন ভেতরে ভেতরে জ্বলছি। সমগ্র ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের উৎখাতের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে কেউ বা নরমপন্থী আবার কেউবা চরমপন্থীদের ভাব ধারার অনুপ্রাণিত। স্বদেশীকতার আবেগের চোরা স্রোত ঢুকে পড়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামও। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকেরা ক্ষেপা কুকুরের মতো স্বদেশীদের খুঁজে খুঁজে মারছে। কলকাতার কাছেই আমাদের গ্রাম গোবিন্দপুর । মাঝে মাঝে দিনের বেলা তো বটে, মাঝরাতেও ভারী বুটের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। খিল খুলে ঘর থেকে বেরোনোর দুঃসাহস না থাকলেও মনে মনে শঙ্কিত হই কোন হতভাগ্য দেশপ্রেমিকের ধরা পড়ে যাওয়ার শঙ্কায়। 


আমরা তখন সবে স্কুলের গন্ডী পেরিয়েছি। আমি ও আমার  স্কুলের আট জন বন্ধু বান্ধব আমাদেরই স্কুলের সিনিয়র দাদা হরিমোহন বন্দোপাধ্যাযের কাছে লুকিয়ে নিয়মিতভাবে স্বদেশীকতার পাঠ নিতে ব্যস্ত। হরিমোহনদা কে আমরা সবাই হরিদা বলে ডাকতাম। হরিদা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আদর্শ ও ভাবধারায় সম্পূর্ণ  অনুপ্রাণিত । নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ভারতমাতার চরণে উৎসর্গ করে দিয়েছে। এহেন ব্যক্তির সাথে নিয়মিত ওঠা বসা ও স্বদেশীকতার পাঠ নেওয়া আমাদের কাছে একটা মহৎ কাজ বলে মনে হত। গ্রামের পশ্চিমে ভাঙা ডাকাত কালীবাড়ির পেছনে বড় মাঠের লাগোয়া হরিদার একচালা মাটির বাড়ি। বাড়িতে হরিদার বিধবা বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাড়িটার একদিকে মাঠ আর অন্য দিকে নদী থাকায় বেশ সুরক্ষিত বলে মনে হত।   মাঠের ওপর দিয়ে বাড়ীর দিকে কেউ এগলে অনেক আগেই বাড়ির ভেতর থেকে তা দেখা যেত।


সেদিন হরিদা আমাদের বলল,.....


---  'মাস খানেক আমি গাঁয়ে থাকব না। আগামী পরশু ই বেরোচ্ছি। তোরা সবাই সতর্ক থাকবি, চোখ কান খোলা রাখবি। একান্তই কোন বিশেষ প্রয়োজন হলে দীপঙ্করদার কাছে শেখানো কোডে চিরকুট লিখবি, আমি পেয়ে যাব।


আমি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম ,....


--- হরিদা, তুমি কি যতীনদার দেশীয় বোমা বানাবার তালিম নিতে যাচ্ছ?'



হরিদা ভ্রু কুঁচকে আমার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,...--- 'দেখিস পাঁচ কান হয় না যেন। একবার শিখে আসি, তোদেরও শিখিয়ে দেব। তারপর ওই হতচ্ছাড়াদের প্রথমে গ্রাম ছাড়া, তারপর দেশ ছাড়া করব……. দেখেনিস।'


যে দৃঢ় প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসের আগুন আমারা সেদিন হরিদার চোখে দেখেছিলাম তার তেজ, তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা আমাদের  বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।


ঠিক মাস খানেক পর হরিদা গ্রামে ফিরল। দিন দুয়েক পর থেকেই ভোর রাতের দিকে শুরু হল আমাদের প্রতীক্ষিত সেই দেশীয় বোমা তৈরির কর্মকান্ড। আমাদের মধ্যে কানাইলাল, ইকবাল আর খুদে খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলল। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বস্তা দুয়েক দেশী হাতবোমা তৈরী হয়ে গেল। এর বেশ কয়েকটা হরিদা নিজের ঘরে মজুত করে রাখল। বাকিটা এদিকে সেদিকে। বোমা গুলোর গুনগতমান পরীক্ষার উদ্দেশ্যে কাকভোরে নদীর ওপারে দু-খানি ফাটিয়েও দেখা হয়। বোমাগুলি প্রত্যাশার অনেক বেশি কার্যকরী বলে আমাদের সেদিন মনে হল। দীপ্ত কণ্ঠে বন্দে মাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে আমরা সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম। তবে সেদিন বোমার গগন কাঁপানো যে শব্দ হয়েছিল, আমাদের অলক্ষ্যে, অজান্তেই তা ইংরেজদের কানে পৌঁছে গিয়েছিল।



ইংরেজদের অতি সক্রিয়তা দেখে একটা বিপদের আচঁ করেছিল। আমাদের ক-দিন চুপচাপ ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়। দুপুরে আমাদের দলের সদস্য পশুপতি আমাকে খবর দেয় যে ইংরেজরা হরিদার বাড়ির কাছে বোমা ফাটানোর অকুস্থলে পৌঁছে গেছে। কয়েকজন সেখান থেকে নমুনাও নিয়েছে। খবরটা শুনে হরিদাকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকলাম। মনে মনে ঠিক করলাম দিনের আলো কমলেই হরিদার সাথে একবার দেখা করতে হবে।  তবে সোজা পথে নয়, ঘুরপথে নদীর  ওপাশ থেকে। 


তখন সন্ধ্যা সাতটা হবে। মাইল দেড়েক হেঁটে নদীর পশ্চিম পাড়ে পৌঁছলাম। পরিস্কার আকাশ। একফালি শুরু চাঁদ মাথার ওপর তারাদের মাঝে মজে আছে। সবে একটা বাঁক নিয়ে এগোব দেখি দশ বার জন সশস্ত্র ইংরেজ হরিদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কিসব আলোচনায় ব্যস্ত। আর ওদের মাঝে আমাদের দলের সদস্য কানাইলালকে দেখে আমার আমি স্তম্ভিত। পায়ের তলার মাটি সরে যায়। মিনিট তিনেকের মধ্যে ওরা হরিদার বাড়ী ঘিরে ফেলে। গুটি গুটি পায়ে চার পাঁচ জন ঘরে ঢোকে। বাকিরা ঘরের কাছেই বন্দুকের নল উঁচিয়ে অপেক্ষারত। আমি প্রবল উৎকণ্ঠায় অসহায়ের মত গাছের আড়ল থেকে দেখছি। কি করব কিচ্ছুই মাথায় আসছেন। হরিদা কি ঘরে আছে !!.... ইশ,..... খবরটা যদি একটু আগে হরিদাকে জানাতে পারতাম। হটাৎই একটি তীব্র বিস্ফোরণে পায়ের মাটি কেঁপে উঠল। হরিদার সেই মাটির বাড়ি একলহমায় ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ঘরের বাইরে থাকা সশস্ত্র ইংরেজদের দেহাংশ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে। বুজতে বাকি রইলনা হরিদা আগেভাগেই তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায় এবং সুযোগ বুঝে নিজেই ঘরে মজুত করে রাখা সব কটি বোমা এক সাথে ফাটিয়ে দেয়। ওখানে উপস্থিত সকল ইংরেজ কে মেরে  হরিদা ও তার মা শহীদ হন।


পরবর্তী তে কানাইলাল কে আমরা তার প্রাপ্য সাজা দিয়েছিলাম, অর্থের লোভে তার কদর্য বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। ইতিহাসের পাতায় স্থান না পাওয়া হরিদার আত্মবলিদানের কাহিনী গোবিন্দপুরের পুণ্যভূমিতে কান পাতলে আজও শোনা যায়।।





********************************************




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational