বিপ্লবীর রক্তে রাঙা বুড়িবালাম
বিপ্লবীর রক্তে রাঙা বুড়িবালাম


"আমার দেশ" কথাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আত্মম্ভরিতা লুকিয়ে থাকে। এমন একটা আত্মম্ভরিতা যা "ভালো"। আমার দেশ ভারতবর্ষ--- সেই প্রাচীন যুগ থেকে ধনসম্পদ, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই এগিয়ে আমার দেশ। ভারতের এই জৌলুস বারেবারে বিদেশি শক্তির ঈর্ষার কারণ হয়েছে, আক্রমণের স্বীকার হয়েছে। তবুও আমার দেশ মাথা নত করেনি। আজও এগিয়ে চলেছে সগৌরবে। দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের অনুকূল হয়তো নয়, তবুও এরই মাঝে ভারত মায়ের সুযোগ্য সন্তানেরা দেশকে সমৃদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। আমার দেশকে নিয়ে, ভারতবাসী হিসেবে আমার পরিচয় নিয়ে আমি যে কতবার গর্ব অনুভব করেছি তা হয়তো গুনে শেষ করা যাবেনা। তবুও আজ এখানে একটা বিশেষ স্মৃতির কথা ভাগ করে নিতে ভীষণ ইচ্ছে করছে, যেদিন ভারতবাসী হিসেবে শুধু গর্বিত হয়েছিলাম বলা ভুল, শিহরিত হয়েছিলাম আনন্দে।
★★★★★
"বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট।"
------ কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ন' দশ বছর আগের। সালটা ২০০৮-০৯ হবে, শীতকাল। তাতাইরা বেড়াতে গিয়েছে চাঁদিপুর। ওড়িশায় সমুদ্র ঘেরা এক সুন্দর শহর। পূর্ণিমার রাতে বঙ্গোপসাগরের উদ্দাম নৃত্য দেখে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল তাতাইদের। তাতাই সেই যে ফিরে এসে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছিল, সকাল আটটাতেও ঘুম ভাঙেনি তার। অনেক ডেকে ডেকেও ওঠাতে পারেনি কেউ। অগত্যা বাবা মা, দাদু ঠাম্মি, পিচাই সবাই এক এক করে রেডি হয়ে গিয়েছে। অবশেষে বাবার ধমক খেয়ে ঘুম ভাঙলো তার। সবাইকে সাজুগুজু করে রেডি হতে দেখে মনে পড়ল আজ তো তাদের প্রথম সাইড ট্যুরে যাওয়ার দিন। কি কি যেন জায়গাগুলোতে সব যাওয়া হবে! সেইসময়ও স্মার্টফোনের এতো হিড়িক আসেনি এখানে, তাই কোথাও যাওয়ার আগে গুগল করে সেই জায়গার সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়ার সুযোগ সেভাবে নেই।
হোটেল থেকেই একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হল তাতাইদের। সেই গাড়িতে চেপেই ওরা চলল সাইড ট্যুরে। তাতাইরা যাবে নীলগিরি পাহাড়, রাজবাড়ী, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির এইসব জায়গায়। শহর ছেড়ে গাড়িটা মোরাম রাস্তায় নামতেই কুলকুল করে ঠান্ডা বাতাস এসে কাঁচের মত বিদ্ধ করতে লাগলো চোখমুখ। বাবা বাধ্য হয়ে গাড়ির কাঁচ তুলে দিলেন। তাতাই কাঁচের জানালায় মুখ লাগিয়েই দেখতে থাকলো বাইরেটা। চাঁদিপুর জায়গাটা এমনিতে বেশ শান্ত, নির্জন। লোকজনের আনাগোনা কম তাই হয়তো সমুদ্রের পাশাপাশি এতো ব্যাপক হারে সবুজের সমাহার এখনও বজায় আছে । তো যাইহোক, গাড়ির দুলুনিতে তাতাইয়ের তন্দ্রামত এসে গিয়েছিল। আচমকা নাকে একটা বোঁটকা গন্ধ এসে লাগতেই তন্দ্রাটা কেটে গেল তার। চোখ খুলে দেখল রাস্তার ওপর লম্বা লম্বা সাদা সাদা কি যেন ঢালা রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আমাদের এখানে গ্রামাঞ্চলে যেমন রাস্তার ওপর ধান গম শুকোতে দেয় লোকে, অনেকটা সেরকমই। আর ওই জিনিসগুলো থেকেই আসছে গন্ধটা। তাতাই ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, "এগুলো কি গো কাকু?"
"মাছ।"
"মাছ!" চমকে উঠল তাতাই, "মাছ তো এভাবে রাস্তায় ঢালা কেন?"
"এই মাছ তো শুকনা করে টিনে ভরে বিদেশ যাবে।"
চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল তাতাইয়ের। জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে মুখ বাড়াল সে। চ্যাপ্টা সাদা সাদা মাছগুলোতে রোদ পড়ে সেগুলো চকচক করছে ছুরির ফলার মত। আঁশটে গন্ধ ভেদ করেও অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওগুলোকে। কিছুটা দূরে তাকালেই সিমেন্টের রাস্তার শেষে সরু রেখার মত জলের দেখা মিলল।
"ওটা কী নদী বাবা? নাকি সমুদ্রের অংশ?"
"নদী রে।"
"কি নদী গো?"
"বুড়িবালাম।"
বুড়িবালাম! দ্বিতীয়বারের মত আজ চমকে উঠল তাতাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সবুজ বৃক্ষ ঘেরা জায়গায় এসে গাড়িটা ওদের নামিয়ে দিল। সামনেই বুড়িবালামকে দেখা যাচ্ছে আরও স্পষ্ট ভাবে। এই জায়গাটা মোহনা, এখানেই বুড়িবালাম মিশেছে বঙ্গপসাগরের বুকে। শীতের নির্মেঘ আকাশ থেকে সূর্যের কিরণটা নেমেছে বাধাহীন ভাবে। রোদ পড়ে চিকচিক করছে বুড়ি বালামের জল। হালকা বালি মেশানো মাটিতে পা ছোঁয়াতেই সারা শরীর কেঁপে উঠল তাতাইয়ের। এই সেই বুড়িবালামের তীর? সেই ইতিহাস বইয়ের পাতায় কিছুদিন আগেই যে বুড়িবালামের যুদ্ধের কথা পড়েছে এই সেই রণক্ষেত্র!
★★★★★
…. যতীন দাসের একের পর এক মহৎ কর্মকান্ড সমূহ যখন দেশীয় পুলিশ কর্মীদের মনে এক শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তুলছে তখন একমাত্র ব্যতিক্রম সুরেশ মুখার্জী। ভারত মায়ের সন্তান হয়েও তিনি ইংরেজদের পদলেহন করতে ব্যস্ত। ব্রিটিশ অফিসার টেগার্টের নির্দেশে সুরেশ মুখার্জী মরিয়া হয়ে বিপ্লবী যতীন দাসকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যতীন দাস বুঝলেন এই সুরেশ মুখার্জীকে সরাতে হবে, নয়তো তাদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ করা অসম্ভব। সেই মত ২৮ শে ফেব্রিয়ারী, ১৯১৫, সুরেশ মুখার্জী ভোর বেলায় যখন টহল দিতে বেড়িয়েছেন তখন চুপিসারে যতীন দাসের সঙ্গী বিপ্লবীরা আঘাত হানলেন সুরেশ মুখার্জীর ওপর, নিহত হলেন তিনি।
জটিল এই পরিস্থিতিতে যতীনের আর কলকাতা থাকা সমীচীন নয়, বিবেচনা করে তার শিষ্য ও সহকারীরা খুঁজে পেলেন বালেশ্বরের আশ্রয়। ওখানকার উপকূলেই জার্মান অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রধান জাহাজটি আসার কথা। তার প্রতীক্ষায় যতীন ওখানে সঙ্গীদের নিয়ে আস্তানা গাড়লেন। স্থানীয় অভিভাবকরূপে রইলেন মনীন্দ্র চক্রবর্তী। দীর্ঘ ছ'মাস তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ে রইলেন বিপ্লবী দল।
কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাস চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই। যতীন দাস জানালেন আর পালিয়ে বেড়াবেন না তারা, এবার লড়াই হবে মুখোমুখি। সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে নিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জংগলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা তাঁরা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে। সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি অসংখ্য সশস্ত্র পুলিস ও সামরিক বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিল। পরীখার আড়ালে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন, হাতে মাউজার পিস্তল। যুদ্ধ শুরু হলে পুলিসের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। এই যুদ্ধের এমন নজির ইতঃপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সংগে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখনো রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন:
"এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।"
★★★★★
এই সেই বুড়িবালাম… যেখানে ভারতমায়ের বীর সন্তানেরা নিজেদের প্রাণের তোয়াক্কা না করেই দেশের জন্য লড়ে গেছে নিজেদের শেষ নিঃশ্বাস অবধি। তাতাই পড়েছিল কোথাও যে মৃত্যুকালে বিপ্লবী যতীন দাসের বয়েস ছিল মাত্র ৩৫ বছর। এত স্বল্প বয়েসে এই মানুষগুলো এতো মনের জোর এতো শক্তি কোথায় পেত কে জানে! ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকি যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তাঁরাও ছিলেন অষ্টাদশের তরুণ। সেই সময় বোধহয় ঈশ্বর ভারত মায়ের কোলের সন্তানদের এক অন্যরকম দৃঢ়তা দিয়ে তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন। নয়তো এমন হাসিমুখে আত্মবলিদান দিতে কে পারে? যে ফল হয়তো চোখে দেখতেই পাবেনা, যে ফল হয়তো কোনোদিনও আসবে কিনা জানা নেই তবুও সেই ফলের আশায় মানুষগুলো দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন, নির্ভয়ে লড়ে গেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। ইতিহাস বইতে তো মাত্র কয়েকজনের নাম পাই আমরা, কিন্তু এমন বহু বিপ্লবীর নাম ইতিহাসের বইতে স্থান পায়নি, তাঁরা রয়ে গেছেন সবার অজ্ঞাতে। আসলে তাঁরা তো কোনো পার্থিব স্বীকৃতির লোভে রণক্ষেত্রে নামেননি, তাঁরা চাননি নিজেদের পরিচয়, তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন নিজের দেশ মাতৃকার বুকে এক স্বাধীন সকাল।
বুড়িবালামের প্রান্তরের এক চিলতে মাটি নিয়ে কপালে ঠেকাল তাতাই। এই মাটি তো শুধু মাটি নয়, এ এক পুণ্য ভূমি, কোনো তীর্থ ক্ষেত্রের চেয়ে কম নয় এই প্রান্তর--- কত বিল্পবীদের পবিত্র রক্তে রাঙা এই বুড়িবালামের তীর। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন, ব্যতিক্রমী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ তো অনেক দেশেই আছে, কিন্তু এমন বীর সন্তান কি ভারত ছাড়া অন্য দেশে আছে যারা নিঃস্বার্থ ভাবে দেশের জন্য এমন করে রক্ত ঝরাতে পারে! জানা নেই তাতাইয়ের। কিন্তু আজ এই বুড়ি বালামের তীরে দাঁড়িয়ে ভারতবাসী হিসেবে তাতাইয়ের বুকটা গর্বে ফুলে উঠল। হ্যাঁ সে এমন এক দেশের সন্তান যে দেশে বিপ্লবী যতীন দাসের মত বীর বিল্পবীরা জন্মগ্রহণ করেছেন, সে এমন এক দেশের সন্তান যেখানে মানুষ নিজের আগে দেশ মায়ের কথা ভাবে।
তথ্যসূত্র :
১. প্রবন্ধ - "রক্তাক্ত বুড়ি বালামের তীরে" - জয়ন্ত মল্লিক
২. উইকিপিডিয়া