STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Inspirational

4  

Nikhil Mitra Thakur

Inspirational

বীণা দাস

বীণা দাস

4 mins
354

বীণা দাসের পিতার নাম বেণী মাধব দাস ও মা ছিলেন সরলা দাস। বেণী মাধব দাস ছিলেন কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ কর্মপ্রবণ ব্যক্তি। তিনি অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করতেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি র‍্যাভেনশ স্কুলে রাজদ্রোহ প্রচার করছেন। ফলে তাকে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বদলি করা হয়। ১৯১১ সালের ২৪শে আগষ্ট কৃষ্ণনগরে বীণা দাস জন্মগ্রহণ করেন।

পিতার আদর্শে প্রভাবিত হয়ে বীণা দেবী রাজনীতিতে যোগ দেন। তাছাড়া,তার দিদি কল্যাণী দাস ছিলেন একজন স্বদেশী বিপ্লবী। মেজো দাদা অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার জন্য কারাবরণ করেছিলেন। তার মা সরলাদেবী ছিলেন সমাজসেবিকা ও একজন দক্ষ সংগঠক। এমনকি ১৯২১ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে আসেন। তখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে তার পরিচয় ঘটে। তৎকালীন সময়ে এই রকম একটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও শিক্ষিত পরিবারে জন্ম হওয়ার জন্য বীণাদেবী জীবনের প্রথম থেকেই পরাধীন ভারতবর্ষে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও ইংরেজ শাসকের অত্যাচার ও নিপীড়ন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। 

ছোটবেলায় বাবা মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন বীনা দাস। এই সময়ে বাবা বেনীমাধব দাস তাকে সিরাজউদ্দৌলা শাহজাহান ইত্যাদি নাটকের বই পড়ে শোনাতেন। পরে তিনি সেন্ট জোন্স ডায়োসেশান গার্লস হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি মেট্রিক পাস করেন। এরপর বীণা দেবী উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনা করেন। বেথুন কলেজের লাইব্রেরী থেকে তিনি 'নির্বাসিতের আত্মকথা','কারাকাহিনী','বাংলায় বিপ্লববাদ' ইত্যাদি বইগুলি পড়ার সুযোগ পান।পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকে বীণাদেবী রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। সে সময় যুগান্তর দলের বেশ কিছু সদস্যের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে লতিকা ঘোষের সঙ্গে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। ১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ছোট ছোট দলের নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার হন।

বীণা দাস ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের নেত্রী ছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার চরমে উঠেছে,তখন হিজলি- চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তার প্রতিবাদেই গর্জে উঠেছিল বীণা দাসের বন্দুক। 

১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রী। সমাবর্তন কক্ষে অভিভাষণ পাঠ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। মঞ্চের দিকে তখন ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলেন গাউন পরিহিতা এক ছাত্রী। কেউ টের পাইনি খোঁপায় রিভলভার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছে এক ছাত্রী। 

আচমকাই তাঁর হাতে গর্জে উঠল বন্দুক। আত্মরক্ষায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন জ্যাকসন। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গুলি। সম্বিত ফিরে পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে ওই ছাত্রীকে ধরে ফেলেন উপাচার্য হাসান সুরাবর্দি। তখনও থামেনি বন্দুকের গর্জন। পাঁচ-পাঁচটি গুলি বেরিয়ে যায় তাঁর বন্দুক থেকে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার আরও একটি অদম্য বজ্রনির্ঘোষ সমাবর্তন কক্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।

ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার হন ওই ছাত্রী। তাঁর নাম বীণা দাস‌।চলে ইংরেজ পুলিশের টানা জেরা। রিভলবার কোথা থেকে পেয়েছিলেন, তা জানতে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ বীণা দাসের মুখ থেকে একটি কথাও বের করা যায় নি। মেয়ের মুখ থেকে তথ্য জানার জন্য তাঁর বাবা বেণীমাধব বাবুকে সাহায্য করতে বলেছিল পুলিশ। কিন্তু সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেন তিনি। 

এরপর বিচারের নামে প্রহসন চলল। আদালতে দৃঢ়তার সঙ্গে গভর্নরের ওপর আক্রমণের দায় নিজের কাঁধেই তুলে নেন বীণা দাস। আর স্পষ্ট করে দেন নিজের উদ্দেশ্যের কথা। আদালতে জবানবন্দীতে বীণাদেবী বলেন, দেশের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা থেকেই তিনি গভর্নরকে গুলি করেন। গভর্নরের প্রতি তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা ক্ষোভ নেই। কিন্তু গভর্নর সেই নির্যাতন-ব্যবস্থার প্রতিনিধি, যা আমার ৩০ কোটি দেশবাসীকে পরাধীনতার নিগড়ে বেঁধে রেখেছে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ শাসনের সীমাহীন অত্যাচার ও পরাধীনতার মধ্যে গুমরে কাঁদার চেয়ে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।

ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর নয় বছরের কারাদণ্ডের ঘোষণা করে ব্রিটিশ আদালত। বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বীণা দাসকে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি দিতে অস্বীকার করেছিল। সাত বছর বাংলার বিভিন্ন জেলে কাটিয়ে ১৯৩৯-এ মুক্তি পান বীণা দাস। 

 জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বীণা দাস কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন। এইসময় তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরম মমতায়। ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্কের সভা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আবার কারান্তরালে চলে যেতে হয় তাঁকে। তিনি রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন। ১৯৪৫-এ মুক্তি পান।

 ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। এরমাঝে ১৯৪৭ সালে তিনি বিয়ে করেন সহসংগ্রামী যুগান্তর দলের সদস্য যতীশ ভৌমিককে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংহতি জানাতে তিনি যশোর সিমান থেকে উপস্থিত হয়েছিলেন। অন্যান্য অনেকের মত স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি ফৌজকে তিনি সাহায্য করেছিলেন। ৭৫ সালে দেশজোড়া ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন। মরিচ ঝাঁপিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বারা ঘৃণ্য গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। 

স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। ১৯৮৬-তে ২৬ ডিসেম্বর হরিদ্বারে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যার মৃত্যু হয়।দীর্ঘ ৮১ বছর পরে ২০১২ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে কলকাতা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক শংসাপত্র প্রদান করে।

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational