বিদায়ক্ষণ
বিদায়ক্ষণ


"আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার তলেতে...." দূরে কোথায় রেডিওতে ভেসে আসছে গানখানা,একমনে অন্ধকারের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে আছে রিনি।তার আটতলার ফ্লাটের ব্যালকনি থেকে আকাশ খুব কাছে মনে হয় তার,ইচ্ছে করে অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি শুয়ে থাকতে,স্মৃতির বালিশ মাথায় দিয়ে।
নীচের নিয়ন বাতির আলো কেমন ঘোলাটে আলো আঁধারি ছায়া রচনা করেছে,কোথা থেকে ভেসে আসছে কুকুরের তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ।সামনে খোলা রামের খালি বোতল গ্লাস জানান দিচ্ছে আজ নেশাটা চড়েছে পূর্ণমাত্রায়।ঘুম দরকার তার,শান্তির ঘুম,কতকাল ঘুমোয়নি সে,মুঠো মুঠো স্লিপিং পিলস এর পাতারা তাদের ব্যার্থতা ঘোষণা করেছে সোচ্চারে।এককালে কবিতা,গল্পদের অনায়াস আনাগোনা ছিল তার ডাইরির পাতায়,নিজ সৃষ্টিতে নিজেই মুগ্ধ হত একদিন,কালের প্রভাবে আজ সব মলিন,ছন্দ-শব্দেরা ধূলায় লুটিয়ে,কলমের সন্ধান নেই।
আরেকবার আকাশের দিকে তাকিয়ে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল রিনি,একলা বিছানায় নিজেকে সঁপে দিতে হবে এবার,ছটফট করতে হবে স্মৃতির চাবুকের জ্বালায়,সকালের অপেক্ষায়।দিনের আলোয় ব্যস্ততমা চাকুরে স্নিগ্ধা রায় ওরফে রিনিকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার রাতগুলো কয়লার চেয়েও কালো এক দমবন্ধ কফিন।ব্যার্থ সম্পর্কের সমীকরণ কষতে গিয়ে আজ সে ক্লান্ত,অবসন্ন,হেরে যাওয়া এক পাথরপ্রতিমা।
স্কুলের চাকরিটা অনেক কষ্টে এই বড় শহরে এসে জুটায় রিনি,ভালোলাগে সারাদিন বাচ্চাদের কলরবে সবকিছু ভুলে থাকতে,কিন্তু রাত আসলেই...........।নাহ আর পারছে না সে,মুক্তি চাই তার রোজকার এই টানাপোড়ন থেকে,অসহ্য যন্ত্রণা থেকে,ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনটা থেকে।আজ রামের সাথে মিশিয়ে খাওয়া ঘুমের ওষুধগুলো হয়ত মুক্তি দেবে তাকে রোজকার ক্ষয়ে যাওয়া থেকে,অবসন্নতা থেকে।
বিছানার ওপর শরীরটা ছেড়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে রিনি,মাথাটা ভার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শেষবার ভেসে উঠছে কত ছবি,ফেলে আসা সময়ের,হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার,জীবনের।
* * * *
--"রিনিইইইই.....কোথায় মরলি??এখনো একটা কাজ শেষ হলো না তোর??ধাড়ী মেয়ে,বিয়ের পর বর ছেড়ে দিয়েছে,বাপের অন্ন ধ্বংস করছে বসে।মরেও না মুখপুড়িটা....।" বাইরে গাছে জল দিতে দিতেই রান্নাঘর হতে ভেসে আসা মায়ের বাক্যবাণ শুনতে পায় রিনি,এ তার কাছে রোজকার জলভাত।যবে থেকে জয়ন্তর সাথে ডিভোর্স হয়েছে তার,এগুলো গা সয়ে গেছে।
--"হতচ্ছাড়ি বেয়াদব,এই বয়সে যেখানে মেয়েরা মা বাপের দায়িত্ব নেয়,বোঝা হালকা করে সেখানে ইনি বোঝা বাড়িয়েছেন।মানিয়ে গুছিয়ে চললে কি হত শুনি,এমন তো কত হয়।তা না ইনি জেদ ধরে চলে এলেন,বাপ ও হয়েছে একটা মেয়ে সোহাগি, ঝ্যাঁটা মারি তোদের মুখে।" রান্নাঘর থেকে সমানে বলে চলেছেন মন্দিরা দেবী,বারান্দায় বসে সবই শুনতে পাচ্ছেন পুলকেশ বাবু,রিনির বাবা।কিন্তু রণচণ্ডী পত্নীর মুখের ওপর কিছু বলার সাহস নেই তাঁর,রিনির মা রিনির জন্মের পর পরলোকপ্রাপ্তা হন,তারপর মন্দিরা দেবী এসে ধরেন সংসারের হাল,মা হারা মেয়েকে দুমুঠো দিয়েছেন এই ঢের।
আপন মনেই হাসে রিনি,ঘরের কাজ গুছিয়ে পুলকেশ বাবুর হাতে এগিয়ে দেয় বাজারের থলিখানা,--"কিছু মনে করিস না,তোর মা ওরকম একটু আধটু...।"
--"থাক না বাবা,আমি শুনছি তো,প্রতিবাদ করছি কি?জানো তো মা শব্দটির সাথে আমার বহুকালের অ্যালার্জি জড়িয়ে,ওই শব্দটা আমার সামনে তুলো না প্লিজ।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাজারের পথ ধরলেন পুলকেশ বাবু,রিনি নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিল দরজায়।
* * * *
--"আমি তোমায় ভালোবাসিনা,অন্য কাউকে ভালোবাসি।পারব না তোমায় তার জায়গা দিতে,ভুল বুঝোনা আমায়।সামাজিক চাপে বাধ্য হলাম বিয়ে করতে।" বিয়ের রাতে জয়ন্তর মুখে কথাগুলি শুনে একটুও চমকায় নি রিনি,নীরবে হেসেছিল,ভাগ্য এভাবেই তার সাথে খেলেছে বারবার,দেওয়ার আগেই কেড়ে নিয়েছে নিশ্চুপে।
--"এখন আমার কি করনীয়? চলে যাব? " চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে রিনি।
--"না যেও না,তোমার বাবার সম্মান আমার সম্মান সব জড়িয়ে তোমার সাথে,তুমি গেলে তার কি অবস্থা হবে ভাবো একবার।বন্ধু হয়ে থাকো। "
--"বেশ।" কথা আর বাড়ায়নি রিনি,দিনগুলোকে বয়ে যেতে দিয়েছিল এভাবেই,নদীর স্রোতের মত,নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছিল গল্পে,কবিতায়,নীরবতার মাঝে কাব্যিক বাঙময়তায়।
ধীরে ধীরে বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে রিনি,ঘুমের ওষুধের তীব্র মাত্রারা গ্রাস করছে চেতনা,স্মৃতিগুলো চোখের সামনে সরে সরে যাচ্ছে সেলুলয়েডের ছায়াছবির ন্যায়।
* * *
"আজকে ধ্রুবতারা সাক্ষী করি,হে বন্ধু মোর;বাড়ায়েছি হাত তোমার তরে,কভু ছিঁড়িবেনা ডোর।" মুঠোফোনে হটাত ভেসে এসেছিল এক অচেনা পথিকের বার্তা,ইতস্তত করে হাত বাড়ায় আজন্ম স্নেহ তৃষ্ণার্ত রিনি।
হ্যাঁ কথা রেখেছিল পথিক,আগলে রেখেছিল তাকে সকল যন্ত্রণা থেকে।প্রতি রাতে রিনির দগদগে ঘায়ে প্রলেপ লাগাত সে পরম মমতায়,একমাত্র তার জন্যই সাহস করেছিল রিনি জয়ন্ত,পরিবার সকলের কাছ হতে মুক্তি নিয়ে চলে এসেছিল অচেনা শহরে,বন্ধ দরজাটা হটাত রুপান্তরিত হয়েছিল মুক্তি সোপানে।
কিন্তু খুশি তার জীবনে বরাবরই ক্ষণস্থায়ী, দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়া আলেয়ার মত।মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছিল সে,ভালোবেসে ফেলার ভুল,বামন হয়ে চাঁদকে ছুঁতে যাওয়ার ভুল।ভুলেছিল পরীরা আকাশ থেকে নেমে আসে মানুষের কষ্ট দূর করতে, তাকে বাঁচতে শেখাতে,কিন্তু তাদের ছুঁতে নেই,বাঁধতে চেষ্টা করতে নেই,পাপী মানুষের আকাঙ্ক্ষার স্পর্শে ক্লেদাক্ত হয় তারা।
পথিক সরে গিয়েছিল,রিনি হারিয়েছিল নিজেকে এইবার,ফিরে পাওয়ার কোনো আশা ছিল না তার,অনুভূতিগুলো বিসর্জিত হয়েছিল বাস্তবের প্রতিঘাতে।
--"আর মেসেজ বা ফোন করবে না আমায়,দেখতে চাই না আর তোমায়।অনেক বুঝিয়েছি,কিন্তু তুমি বোঝোনি,নিজের মতো খুশি থাকো,আমার খোঁজ কোরোনা আর।"
নিথর রিনির একপাশে পড়ে থাকা মুঠোফোনে জ্বলজ্বল করছে শেষ মেসেজটা।কাল হয়ত আবার স্ক্রিনে ভেসে উঠবে পরিচিত নম্বরটা,পাশে লেখা থাকবে মা কলিং,শুধু থাকবে না উত্তর দেওয়া সেই অতি পরিচিত গলাটা,তা তখন যাত্রা করেছে মরনের পারে।