Sourya Chatterjee

Romance Classics

4.6  

Sourya Chatterjee

Romance Classics

ভ্যালেন্টাইন'স ডে

ভ্যালেন্টাইন'স ডে

7 mins
425


হন্তদন্ত হয়ে বাজার থেকে এসে বাজারের থলিটা রান্নাঘরের সামনে রাখলেন অবিনাশ বাবু। 

-   সুলেখা, বাজার রইল এখানে। আমি বাইরের ঘরে পড়াতে চললাম। স্টুডেন্টরা এসছে।

-   ও হো হো হো হো হো!! উদ্ধার করলেন আমাকে! একঘন্টা ধরে কি করছিলে টা কি! 

-   মাছের বাজারে কেমন ভিড় দেখে এস। বুঝতে পারবে। যত্তসব। ঘরে এলেই কিচিরমিচির শুরু। দু দন্ড শান্তি নেই।

একটু হাত পা টা ধুয়ে নিয়ে বাইরের প্যান্ট টা ছেড়ে পাজামা টা পরে বাইরের ঘরে পড়াতে গেলেন অবিনাশ বাবু।


অবিনাশ রায়, রিটায়ার করেছেন বছর চারেক হল। কলেজের প্রফেসর ছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষক। এখন প্রাইভেট টিউশনি করান। ওনার স্ত্রী সুলেখা রায়, উনিও রিটায়ার করেছেন বছর খানেক হল। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। রিটায়ারমেন্টের পর নিজের হাতে সংসারের যত্নআত্তি করেন। স্বামী, ছেলের দেখাশুনা, ঘরপত্র গোছগাছ রাখা, আর দারুণ দারুণ রান্নাবান্না করে সময় অতিবাহিত হয়ে চলে।


-   আগের দিন কত দূর পড়িয়েছিলাম?

স্টুডেন্টরা নড়েচড়ে বসল স্যারের গলার আওয়াজ পেয়ে। স্যার যতক্ষন আসেন না, ততক্ষণ যা চলে আর কি! গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা! সেসব ই চলছিল।

-   তোদের দেখে কে বলবে যে তোরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়িস! ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের মত হা হা হি হি করেই চলেছিস! 

সৌমিলি ঈশানের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে গাল ফুলিয়ে ইশারায় বোঝালো “সাবধান! স্যারের মুড কিন্ত আজ সপ্তমে।” 

সবে পড়াতে শুরু করবেন স্যার! হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে সুলেখা ম্যাডামের চিৎকার! “ বলি! ইয়ার্কি হচ্ছে!”

সর্বনাশ করেছে। ম্যাডাম তো এদিকেই আসছেন মনে হচ্ছে। চিৎকার টা তো এগিয়ে আসছে।

স্যার ও উঠে দাঁড়ালেন। 

-   কি হয়েছে টা কি! চিল্লামিল্লি করছ কেন! জানো তো আজ একটু তাড়া আছে। একবার কলেজে যেতে হবে। একটা প্রোগ্রাম আছে। এদের পড়াতে দেবে নাকি দেবে না?

মনে মনে একটু খুশিই হল ঈশানরা। যাকগে! আজ স্যার তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন মনে হচ্ছে কলেজে কিসব প্রোগ্রাম আছে যখন।

সুলেখা দেবী অবিনাশ বাবুর সেই বাজারের ব্যাগটা নিয়ে হাজির হয়েছেন। 

-   বলি , কালই তো ডিম আনলে। আজ আবার নিয়ে এসছো কেন! ঘরে তো একটাই ফ্রিজ! এগুলোকে এখন কোথায় রাখবো! তোমার মাথায়?

-   সুলেখা, বেকার চিল্লামিল্লি করো না। লিস্টে ডিম লেখা ছিল বলেই এনেছি।

-   হতেই পারে না। আমি তো তোমার মত সারাদিন ইতিহাস পড়ে পড়ে পাগল হয়ে যাই নি যে লিস্টে ডিম লিখব।

-   তোমার চেঁচানো বার করছি । দাঁড়াও। এই যে লিস্ট। ভাগ্যিস পকেটে ছিল, ফেলে দিই নি।

পকেট থেকে লিস্ট টা বের করলেন অবিনাশ বাবু। ঠিক যেখানে ‘ডিম’ লেখা আছে সেখানে আঙ্গুল দিয়ে অত্যন্ত রেগে দেখালেন

-   দ্যাখো। কে পাগল হয়েছে আর কে পাগল হয়নি দ্যাখো। নিজে ডিম লিখেছো। যাও এখন। পড়াতে দাও।

-   মাথাটা তো আগেই গিয়েছিল। এখন চোখটাও গেছে। ওটা ভিম লেখা আছে, ডিম নয়। আমি কি এখন ডিম দিয়ে বাসন মাজবো!!! চোখ টা দেখাও। 

-   উফ! বড্ড জ্বালাও। আজ তো কলেজ যেতে হবে। ফেরার সময় না হয় ভিম নিয়ে আসবো। এখন প্লিজ একটু পড়াতে দাও।

স্যার যে একটু নরম হয়েছেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারল ঈশানরা। সৌমিলি তো ফিক করে একবার হেসেও ফেলল। অমনি স্যারের ধমক

-   হেসে কিছু লাভ নেই। যখন সাপলি পাবি তখন তোদের ডিম ই বেচতে হবে রে। নে, খাতা বের কর। তবে..

স্যার পড়াতে শুরু করতে যাচ্ছেন। হঠাৎ সৌমিলির ফোনে টিং করে হোয়াটস্যাপের নোটিফিকেশনের শব্দ আর সৌমিলিও উৎসাহের বশে ফোন টা বের করে ফেলল।

-   তোরা কি শুরু করেছিস! পড়াতে দিবি কি দিবি না! 

-   সরি স্যার।

-   কিসের সরি স্যার। সবকিছুকে ছেলেখেলা ভাবিস কেন! কি এমন ইম্পরট্যান্ট ম্যাসেজ শুনি যে এখুনি না দেখলে চলছিলোই না।

-   সরি স্যার। আর হবে না।

কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। স্যার আজ প্রচন্ড রেগে আছেন। তার উপর আবার এই। খুব মুশকিল! ঈশান স্মার্টলি ব্যাপারটাকে ম্যানেজ করতে গেল। 

-   স্যার, পড়ান স্যার। আর হবে না স্যার সত্যি। আজ তো আসলে স্যার ভ্যালেন্টাইন’স ডে। তো সৌমিলির ফিয়ান্স ওকে ম্যাসেজ করেছে হয়ত।প্লিজ স্যার।

কিন্তু হিতে বিপরীত হল। স্যার তো আরো রেগে গেলেন।

-   বড্ড চটাং চটাং কথা শিখেছ। ভ্যালেন্টাইন’স ডে টা আদতে কি! ইতিহাসের ছাত্র তো। বল! 

-   ভালোবাসার দিন স্যার। ভালোবাসার প্রসারের দিন।

-   আমি ইতিহাস টা জানতে চেয়েছি।

খানিক মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ঈশান আর সৌমিলি। অপরাধ প্রবণতার ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। স্যার ই নীরবতা ভাঙলেন।

-   পোপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সময়ের অনেক আগে থেকেই মিড ফেব্রুয়ারিতে একটা ছুটির দিন পালিত হতো, বুঝলি। দিনটা ফার্টিলিটি ডে হিসেবে সেলিব্রেশন করা হত। আর সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের গল্পটা হল তখন যে রাজা ছিলেন ক্লডিয়াস টু সম্ভবত। উনি দেশের সমস্ত সোলজারদের এটা বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন যে যুদ্ধ যখন করতে নেমেছ, তখন এসব প্রেম, ভালোবাসা করা যাবে না। কিন্তু পোপ ভ্যালেন্টাইন এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারণ করেছিল। এবার রাজা তো এসব দেখে পোপকে সোজা জেলে ভরে দিয়েছে। এদিকে কি হয়েছে! যে বন্দী করেছে ভ্যালেন্টাইনকে মানে যে জেলার সে,তার মেয়ের সাথে ভ্যালেন্টাইনের বন্ধুত্ব হয়। ১৪ তারিখ, ভ্যালেন্টাইনের যখন ফাঁসি হয় তার আগে সেই জেলারের মেয়েকে একখানা চিঠি লেখে ভ্যালেন্টাইন। তার শেষ লাইনে ছিল ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন। সেখান থেকে ভ্যালেন্টাইনস ডে। এছাড়াও অনেক গল্প আছে।পরে বলব ক্ষণ।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন অবিনাশ স্যার। কিছুটা থেমে আবার বলা শুরু করলেন

-   জেনে রাখা উচিত এগুলো। ইতিহাসের ছাত্র হয়ে জানবে না? তার থেকেও বড় ব্যাপার অবিনাশ স্যারের ছাত্র হয়ে জানবে না! যাকগে! শুরু করা যাক! তো…

না! আজ আর পড়ানো হবে না মনে হয়। যেভাবে বাধা আসছে একের পর এক! কলিং বেলের শব্দ এবার। একটু বিরক্তি নিয়েই সুলেখাকে দরজা খুলতে বললেন চেঁচিয়ে।

-   তুমি দ্যাখ! কিসব কুরিয়ারের মাল এসছে। 

-   নিয়ে নাও না। বই হবে।

-   নিজের জিনিস নিজে এসে নাও। আমার ঢের কাজ পরে আছে। যত্তসব।

-   বোস একটু। বই টা নিয়ে আসি। দেখছিসই তো আজ ম্যাডাম একটু রেগে আছেন। 


পার্সেলের প্যাকেট টা হাতে নিলেন অবিনাশ বাবু। ঠাওর করলেন ওজন কিংবা চেহারায় বই তো মনে হচ্ছে না। উল্টে পাল্টে খুঁজলেন একটু। কোথাও প্রেরকের নাম নেই। কি হতে পারে! কে পাঠাতে পারে! খানিক দোনামনা করে খুললেন প্যাকেট টা। একি! তার পছন্দের রংয়ের পাঞ্জাবী, একটা কলম। কে পাঠালো এটা! খুবই অবাক হলেন। কোনো নামই বা লেখা নেই কেন! ভাবনায় দু তিনটে নাম উঠে এলো বটে, কিন্তু সব  নিজেই নাকচ করলেন তিনি। নাহ! স্টুডেন্টরা ওয়েট করছে। পরে দেখা যাবে কে দিয়েছে। আবার প্যাকেটে ঢোকাতে গিয়ে অবিনাশ বাবুর চোখে পড়ল একটা চিঠি। বার করলেন চিঠিটা অবিনাশ বাবু। 


“প্রিয় শিবাজী,

এখনো চিনতে পারলে না আমায়? কি গো! অবাক হলে বুঝি? কেমন আছো শিবাজী? কতদিন পর চিঠি লিখছি তোমায়। খুব আনন্দ হচ্ছে জানো! তার সাথে একটা সংকোচ, ভয় ও কাজ করছে বটে। তুমি চিঠিটা হাতে পেয়ে যদি রেগে যাও, সেই ভয়! 

তোমায় এখনও ভালোবাসি শিবাজী। সেই চল্লিশ বছর আগের মতোই এখনো তোমায় ভালোবাসি শিবাজী। তুমি এখনো তোমার ইতিহাস বইয়ের মধ্যে আমার দেওয়া চিঠি টা লুকিয়ে রাখবে সেই আগেকার মতো? আজ তো ১৪ই ফেব্রুয়ারি। দেখা করবে একবার শিবাজী? চলো না, দেখা করি। মালতী সিনেমা হল টা আর নেই। ওখানে একটা শপিং কমপ্লেক্স উঠেছে। ওখানেই দেখা করি? এই পাঞ্জাবীটা পরে এস শিবাজী। বুকপকেটে ওই কলম টাও থাকে যেন। বিকেল চারটের সময় তোমার পছন্দের সাদা সিল্কের শাড়ী পরে জুঁই ফুলের মালা খোপায় বেঁধে অপেক্ষা করবো মালতির সামনে। এতদিন পর চিঠি লিখছি তো। হয়তো গুছিয়ে মনের সব কথা বলে উঠতে পারলাম না। দেখা হলে প্রচুর গল্প করব। কত কথা জমে আছে বল তো! আর তর সইছে না। তাড়াতাড়ি চলে এসো।

ইতি - তোমার ঝুমুর”


চিঠিটা পড়ে ওখানেই চেয়ারে বসে পড়লেন অবিনাশ বাবু। অবাক চোখে, মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বললেন

-   আমি আসছি ঝুমুর। দেখা হবে।

দেরী করলেন না অবিনাশ বাবু। টুকটাক একটু দেখিয়ে দিয়েই আজ ঈশানদের ছুটি দিয়ে দিলেন। তারপর কোনোরকমে দু মুঠো খাবার খেয়েই একটু মাথায় জল ঢেলে নতুন পাঞ্জাবি টার কাছে এলেন। না!, পুরোনো কলেজে একটা প্রোগ্রাম আছে। ওখানে একবার ঢুঁ মেরেই ওখান থেকেই পাঞ্জাবিটা পরে বেরিয়ে যাবেন। বাড়িতে পরলে রিস্ক হয়ে যায় যদি! ব্যাগের মধ্যে পাঞ্জাবী টা ঢুকিয়ে নিলেন উনি।

-   সুলেখা, আমি বেরোলাম। ফিরতে দেরী হবে। 

-   কবে দেরীটা হয়না শুনি! আগেও দেরী হত। এখন রিটায়ারমেন্টের পরও এই কাজ, সেই কাজ! লেগেই আছে।

-   উফফ! বেরোব, তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে!! আর শোনো, রাতে খেয়ে ফিরব।

দরজাটা বন্ধ করলেন সুলেখা দেবী।


রান্নাবান্না প্রায় শেষ। বেশি সময় ও হাতে নেই। ১২ টা বাজতে চললো। সকাল বেলা টুক করে বাজার গিয়ে জুঁই ফুলের মালা কিনে এনেছেন সুলেখা দেবী। সাদা সিল্কের শাড়ী টা নামাতে হবে। দেরি করলে শিবাজী বড্ড রাগ করে। ইতিহাসের প্রিয় চরিত্র ছিল শিবাজী। তাই ভালোবেসে শিবাজী বলে অবিনাশকে ডাকত সুলেখা। আর সুলেখা ভালোবাসত নাচ। তাই ঝুমুর। বছর পাঁচেক চুটিয়ে শিবাজী, ঝুমুরের প্রেম হল। তারপর আস্তে আস্তে কাজের চাপে, সংসারের চাপে শিবাজী আর ঝুমুর, চরিত্র দুটো আপাত দৃষ্টিতে হারিয়ে যেতে থাকল। দায়িত্ব, চিন্তা, কাজের চাপ ঠিক যেন ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ক্লডিয়াস টু, যে বিশ্বাস করতে শেখায় প্রেম, ভালোবাসার সময় নেই। খুনসুটির মুহূর্ত বা অন্তরঙ্গতার সময় অবশ্য শিবাজী আর ঝুমুর জেগে ওঠে। শিবাজী, ঝুমুর নিজের অজান্তেই জাগে অবিনাশ বাবু বা সুলেখা দেবীর শরীর খারাপ হলে কিংবা প্রচন্ড ঝগড়ার পর মান অভিমানের সময় কিংবা জানলার ধারে বসে অবসর যাপনের মাঝে স্মৃতি চারণের সময়। তখন তারা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন হয়ে লড়াই করে ক্লডিয়াস টু এর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। বেঁচে থাকে প্রেম। জিতে যায় ভালোবাসা।


-   মা, কিগো কোথাও যাবে নাকি? 

-   হ্যাঁ রে, আর বলিস না। একটু পুরোনো নাচের স্কুলটায় যেতে হবে। দ্যাখ তো বাবলু কেমন লাগছে এই সাদা সিল্কের শাড়ী টা পরে?

-   মা। মনে হচ্ছে বছর পঁচিশের সুন্দরী। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে মা। তাড়াতাড়ি বের হও তো এবার। বাবা তো ওয়েট করে আছে। নাকি?

লজ্জায় পরে গেলেন সুলেখা দেবী। কি করে জানল বাবলু।

-   আর শোনো তোমার শিবাজীকে বলো পার্সোনাল চিঠি যেখানে সেখানে যেন ফেলে না রাখে। ইতিহাস বইয়ের মধ্যেই যেন রাখে।

অত্যন্ত কাচুমাচু মুখে সুলেখা দেবী বললেন

-   শোন না বাবলু, আর কাউকে বলিস না প্লিজ। ফেরার সময় বিরিয়ানি নিয়ে ফিরব। প্রমিস। শিবাজীর হচ্ছে আজ, দাঁড়া! 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance